আপনারা মানুষের পর্যায়ে নেই, শ্যামলী-এনআর পরিবহনের এমডিকে হাইকোর্ট

অ্যাম্বুলেন্সে করে স্ত্রীর মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সবজি বিক্রেতা আয়নালের পরিবারের সদস্য ও আহতদের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে আজ। এর আগে আয়নালের পরিবারের সদস্য ও আহতদের এক কোটি ৭১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। ওই রুলের শুনানি হলো আজ।
শুনানিতে হাইকোর্ট শ্যামলী-এনআর পরিবহনের এমডিকে কঠোর বার্তা দেন। আদালত বলেন, মানুষ মারা যাওয়ার পর মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনা ঘটলো, আপনি একবার খোঁজও নিলেন না। আর কত? আপনারা কোনো মানুষের পর্যায়ে নেই। দুর্ঘটনার দীর্ঘদিন পরেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কোনো আর্থিক সহায়তা না করায় শ্যামলী এনআর পরিবহনকে ভর্ৎসনাও করেন হাইকোর্ট।
বুধবার (৭ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন। শ্যামলী এনআর ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শুভঙ্কর ঘোষ রাকেশকে উদ্দেশ্যে করে আদালত এ মন্তব্য করেন।
আদালতে এদিন রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শিশির মনির। শ্যামলী এনআর ট্রাভেলসের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তাজুল ইসলাম। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
আদালতে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের বলেন, মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের উপার্জনক্ষম লোকটি মারা গেলেন, পরিবারের অন্য সদস্যরা পঙ্গু হয়েছেন। আপনারা একটি বারের জন্য খোঁজখবরও নিলেন না। আপনারা মানুষের পর্যায়ে নেই।
এ সময় তিনি আরও বলেন, আপনারা আইন বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছেন না। সড়কে যা ইচ্ছা তাই করছেন। আর কত? টাকা লুট করছেন। আপনারা কোনো মানুষের পর্যায়ে নেই।
এ সময় বিচারক রিটকারীদের আইনজীবী শিশির মনিরকে ডেকে বলেন, তারা কি কোনো টাকা দিয়েছেন?
তখন আইনজীবী বলেন, না, মাই লর্ড কোনো টাকা দেননি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তিন সন্তান পঙ্গু হয়েছেন।
তখন বিচারক শ্যামলী এনআর পরিবহনের এমডি রাকেশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অথচ এখানে আপনার অবহেলা দেখা যায়। মরদেহ নিতে গিয়ে মানুষ মারা গেলো, আপনারা একজন দেখতেও গেলেন না। আপনাদের কি মানবিকতা নেই।
তিনি বলেন, আপনারা চালকদের কোনো শিক্ষা দেন না। আপনাদের চালকরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না। কাউকে পরোয়া করেন না। যত্রতত্র গাড়ি চালান। এটা ঠিক নয়। পুলিশও এসব দেখে না। ভাবখানা যেন পুলিশের থেকেও আপনারা পাওয়ারফুল।
গাড়িচালকদের পর্যাপ্ত ঘুমের সুযোগ দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন আদালত।
পরে আদালত দুইপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে বসে অবিলম্বে টাকা দিতে নির্দেশ দেন। এছাড়া আগামী ১৪ ডিসেম্বর ফের আদালতের হাজির হতে নির্দেশ দেন।
অ্যাম্বুলেন্সে স্ত্রীর মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সবজি বিক্রেতা আয়নালের পরিবারে সদস্য ও আহতদের জন্য এক কোটি ৭১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে গত ৭ আগস্ট রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে সড়ক পরিবহন আইনের অধীনে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের ফান্ড গঠনে কী অগ্রগতি হয়েছে তা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতকে জানাতে বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর আগে আদালতের নোটিশে সাড়া না দেওয়ায় শ্যামলী এনআর ট্রাভেলেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তলব করেন হাইকোর্ট। আজ তিনি হাজির হন।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ঢাকার রূপনগরের সবজি বিক্রেতা আয়নাল হোসেনের মৃত স্ত্রী ফিরোজা বেগমের মরদেহ অ্যাম্বুলেনেস করে নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরছিলেন। বগুড়ার শেরপুরে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের ঘোগা সেতুর পাশে ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহনের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে আয়নাল হোসেনের মৃত্যু হয়। পর অ্যাম্বুলেন্সের চালকেরও মৃত্যু হয়। আর আহত হন আয়নাল হোসেনের তিন সন্তানসহ বেশ কয়েকজন।
এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। শ্যামলী পরিবহনের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। পরে বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়।
আদালত শুনানি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সাতজনকে এক কোটি ৭১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। আর সড়ক পরিবহন আইনের অধীনে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের ফান্ড গঠনে কী অগ্রগতি হয়েছে তা দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতকে জানাতে বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য ডলি পারভীনকে ৭০ লাখ ৫০ হাজার, রোজিনা খাতুনকে ৭০ লাখ ৫০ হাজার টাকা, নিহত আয়নালের তিন ছেলে যথাক্রমে ফরহাদ হোসেনকে ৮ লাখ টাকা, ফিরোজ হোসেনকে ৫ লাখ টাকা, ফরিদ হোসেনকে ৫ লাখ টাকা, আহত দুলফিজুর রহমান রতনকে ৯ লাখ টাকা এবং ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাম্বুলেন্স বাবদ পিপল রিনেমেট অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট কাউন্সিলের পরিচালক আব্দুল আলী বাশারকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রিট করা হয়।
এফএইচ/কেএসআর/এএসএম