স্টাইল আইকন বঙ্গবন্ধুর পোশাক-আশাক যেমন ছিল

বদরুন নাহার রক্সী
সাদা পাঞ্জাবি-পাজামার সঙ্গে ৬ বোতামের কালো মুজিব কোট, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, ব্যাকব্রাশ চুল- এই ছিল তার পরিপাটি সাজ পোশাক। এটাই হয়ে উঠেছিল প্রতিটি বাঙালির মানসপটে ভেসে ওঠা এক অনন্য বঙ্গবন্ধু। যা এদেশের মানুষের কাছে তাকে করে রেখেছে স্টাইল আইকন।
বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশের স্বপ্ন, সংগ্রাম, স্বাধীনতা, অধিকার। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর পোশাক ও অনুষঙ্গ নিয়ে কাজ করতে পারা আমি মনে করি আমার জীবনের বিশাল অর্জন। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
বঙ্গবন্ধুর পোশাকের তাালিকায় আছে—সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি, মুজিব কোট, শর্টহাতা শার্ট, ফুলহাতা শার্ট, প্যান্ট, নাইট গাউন, শাল, লুঙ্গি, গেঞ্জি। অনুষঙ্গ হিসেবে আছে জুতা, স্যান্ডেল, টাই, চশমা ও পাইপ। এসব কিছুরই রেপ্লিকা তৈরি করেছি, যা শিগগিরই প্রদর্শিত হবে।
আমার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে একটি হলো বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে আমি ১০০ রকমের মুজিব কোট তৈরি করেছি। এ মুজিব কোট তৈরিতে আমি দেশীয় কাপড় ব্যবহার করেছি। এর মধ্যে পাট, খাদি, জামদানি, মসলিন, বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁত অর্থাৎ দেশীয় যতগুলো কাপড় আছে, সবগুলো নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি।
বঙ্গবন্ধু প্রথমদিকে খাদি কাপড়ের তৈরি মুজিবকোট পরেছেন। তারপর কটন কালো কাপড়ের মুজিব কোট পরতেন। এরপর পরা শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক মুজিব কোট, যা সবার কাছে অতিপরিচিত।
বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোটের বৈশিষ্ট্য ছিল কালো রঙের কোটে ছয়টি বোতাম। কালো হচ্ছে বিপদ, মৃত্যু, দূর্বলতা ও অশুভশক্তির প্রতীক। বঙ্গবন্ধু তার এ কালো রঙের মাঝে ফুটিয়ে তুলেছেন বিপদের মোকাবেলা করা, মৃত্যু ভয়কে পেছনে ফেলে অন্যায়ের প্রতিরোধ করা, দূর্বলতাকে পায়ে মাড়িয়ে রুখে দাঁড়ানো, অশুভশক্তিকে পরাজিত করে সত্য, ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা।
আর ছয়টি বোতাম ব্যবহার করার কারণ হলো—বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয়-দফা আন্দোলনের প্রতীক। ভাবতে অবাক লাগে, একজন নেতা কতটা দেশপ্রেমিক হলে পোশাকের মধ্যেও দেশপ্রেম ধারণ করেন। বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোটের আরেকটি বিশেষত্ব হলো—কলারের ভেতরে আলাদা কাপড়ের ডাবল কলার ছিল। যেটা বোতাম দিয়ে আটকানো থাকত।
এ আলাদা কাপড় ব্যবহারের কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, পোশাক ব্যবহারের পর পোশাকের কলারটাই বেশি ময়লা হয়, যাতে বেশি নোংরা না হয় সেজন্য বোধ হয় বোতাম দিয়ে আটকানো থাকত। মুজিব কোটের বোতাম নিয়েও আমি অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছি। বোতামে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, দেশের মানচিত্র, বর্ণমালা ব্যবহার করেছি।
সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরতেই পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। সাদা হলো শান্তি, নিরাপত্তা, আলো, পবিত্রতা, সততা, বিশুদ্ধতা, জ্ঞান, বিদ্যা, বিশুদ্ধতা ও ধার্মিকতার প্রতীক। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের সব গুণাবলী ধারন করতেন এ পোশাকে। পাঞ্জাবি-পাজামা একটু ঢিলেঢালা থাকত, পাঞ্জাবির হাতা একটু বড়। এর কারণ হলো তিনি একটু ফোল্ড বা ভাঁজ অর্থাৎ গুটিয়ে রাখতেন, কাপড় ছিলো সুতি।
সে সময়ে এতো এয়ারকন্ডিশনার ছিল না, সাদা কাপড়ে গরম কম অনুভূত হয়, এটাও বোধ হয় একটা কারণ। সাদা-কালোর কম্বিনেশন ছিল বঙ্গবন্ধুর পোশাকে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর যখন ইংল্যান্ডে যান; সেখানকার সেভিল রয়ের একটি টেইলার্স থেকেও মুজিব কোট তৈরি করেছিলেন।
প্রতিষ্ঠানটি আজও আছে, আমি তাদের কাছ থেকেও দুটো মুজিব কোট তৈরি করেছি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এত বড় মাপের একজন মানুষ ছিলেন অথচ তার পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল খুবই সাধারণ। পোশাকে কোনো বাহুল্য ছিল না। সাদামাটা জীবন-যাপনের মতো তার পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল সাদামাটা।
৪১ সাইজের জুতা পরতেন বঙ্গবন্ধু। খুব বেশি জুতা ছিল না তার। মাত্র ৫ জোড়া জুতা ও স্যান্ডেল ছিল। জুতাগুলো সেই সময়কার দেশীয় কোম্পানির। এক জোড়া জুতা ছিল সুইজারল্যান্ডের বেলি সুজ কোম্পানির।
কাজ করতে গিয়ে আমি অবাক হয়েছি, তার কয়েক জোড়া জুতায় মুচির তারকাঁটা দিয়ে ঠিক করা। অর্থাৎ জুতা ছিঁড়ে যাওয়ার পর তিনি তা ঠিক করিয়ে পরতেন। সত্যিই এ সময়ে কোনো রাজনীতিবিদ কি এটা ভাবতে পারবেন? দেশের প্রধান হয়েও তিনি সেলাই করে জুতা পরতেন। বাংলাদেশের এপেক্স ফুটওয়্যার থেকে সবগুলো জুতা ও স্যান্ডেলের রেপ্লিকা তৈরি করেছি।
বাড়িতে যখন অবসরে থাকতেন; তখন তিনি আট-দশজন আটপৌরে বাঙালির মতো সাদা চেকের লুঙ্গি ও ছোট হাতার হোসিয়ারি গেঞ্জি পরতেন। খুব বেশি পোশাক তার ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি যখন বিদেশে যেতেন; তখন তাকে স্যুট, প্রিন্স কোট, সাফারি স্যুট পরতে দেখা গেছে।
যা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এবং নিউ মার্কেটের এক টেইলার্স থেকে বানাতেন। এমনকি বিদেশে গেলেও বানিয়ে আনতেন। দেশে থাকলে পাঞ্জাবি-পাজামা আর মুজিব কোটই বেশি পরতে দেখা গেছে তাকে। শীতের সময় মুজিব কোটের ওপরে শাল পরতেন। অবসরে হাফ হাতার শার্ট পরতেও দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুকে। তরুণ বয়সে মুজিব কোট পরার আগে বঙ্গবন্ধুকে সাদা ও কালো রঙের শেরোয়ানিও পরতে দেখা গেছে।
এছাড়া বঙ্গবন্ধুর দুটো নাইট গাউনও ছিল সাদা, কালো, মেরুন এবং ডট প্রিন্টের। স্যুট বঙ্গবন্ধুকে কমই পরতে দেখা গেছে, বিদেশে গেলে বেশি স্যুট পরতেন। অনেক সুন্দর সুন্দর টাই ছিল। বঙ্গবন্ধু তার আপনজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে টাই ও পাইপ উপহার পেতেন। অনেক সাদামাটা পোশাকের মধ্যেও কোথায় যেন একটা অসাধারণত্ব ছিল। নিজের সাধারণ পোশাক দিয়েও তিনি যেন বাঙালির স্টাইল আইকন।
যখন আমি প্রথম বঙ্গবন্ধুর পোশাকের মাপ নিচ্ছিলাম; তখন আমি অনেক ইমোশনাল হয়ে যাই। আমার এরকম অনুভূতি হয়েছিল, আমি এই অপরাজেয় নেতাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পেরেছি। যিনি আমাদের একটা স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনযাপন ও পোশাক নিয়ে কাজ করার সময় আমি দেখেছি, তিনি জীবনযাপনে যতটা সাধারণ ছিলেন। পোশাক-পরিচ্ছদে ছিলেন ততটাই অসাধারণ।
অনুষঙ্গ বলতে বঙ্গবন্ধু কালো মোটা ফ্রেমের চশমা ব্যবহার করতেন। চশমাগুলো তৈরি করতেন অপটিকসম্যান ও সুরুচি বিতান নামক স্টেডিয়াম মার্কেটের দুটো দোকান থেকে। এছাড়া পাইপের অনেক সংগ্রহ ছিল। দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটা পাইপ ছিল। বিদেশে গেলে অনেক পাইপ উপহার পেতেন।
অনেকগুলো পাইপের রেপ্লিকাও তৈরি করেছি। রুচিতেও অনন্য ছিলেন তিনি। খুব সাদাসিধে পোশাক-আশাকের মধ্যেও পরিপাটি ভাবটা ফুটে উঠত। তার চুল-দাড়ি কাটার জন্য ছিলেন নির্দিষ্ট একজন নরসুন্দর। শুনেছি তিনি প্রতিদিন বাড়িতে আসতেন। শেভিং কিটসের মধ্যে ওল্ড স্পাইস আফটার সেভও ছিল। তার হেয়ারস্টাইল ছিল ব্যাকব্রাশ।
বঙ্গবন্ধুর স্টাইল ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। মিছিল, মিটিং, আন্দোলন, দেশ শাসনের মতো নানা ব্যস্ততার পরও তার পোশাক থাকত ফিটফাট। রাজনীতিক থেকে শুরু করে ফ্যাশন সচেতন সাধারণ জনতার কাছেও মুজিব কোট অনেক জনপ্রিয়। সরকার চাইলেই মুজিব কোটকে বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক ঘোষণা করতে পারে।
শিশুকাল থেকেই আমার জীবনবোধের মধ্যে তাই বঙ্গবন্ধুর ছায়া গেঁথে গিয়েছিল। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে (বিইউএফটি) পড়ার সময় থেকেই ভাবতাম, বঙ্গবন্ধুর ওপরে কাজ করব। তাই প্রচুর পড়াশোনা ও রিসার্চ ওয়ার্ক শুরু করি ২০১৩ সাল থেকে।
২০১৬ সালে ভাবলাম, বঙ্গবন্ধুর পোশাক ও অনুষঙ্গের রেপ্লিকা তৈরি করে তা নিয়ে ‘স্বর্ণালী যুগ’ নামে প্রদর্শনী করব। ২০১৭ সালে অনুমতির জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টে আবেদন করলাম। বঙ্গকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার প্রেজেন্টেশন পেপার দেখে অনুমতি দিলেন। গবেষণা ও প্রর্দশনী করার অনুমতির চিঠি পেলাম ২০১৮ সালে।
২০১৮ সালে এসে পুরোদমে কাজ শুরু হলো আমার। বঙ্গবন্ধুর পোশাক ও অন্যান্য অনুষঙ্গের ছবি ও মাপ নিলাম। লাইব্রেরি ওয়ার্ক করলাম। ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে নিয়মিত যাওয়া, যারা বঙ্গবন্ধুর পোশাক তৈরি করতেন তাদের খুঁজে বের করা, তাদের পরিবারকে খুঁজে তথ্য সংগ্রহ করা, যেসব অনুষঙ্গ যেখান থেকে কিনতেন; সেসব দোকানের খোঁজ ও তথ্য জোগাড় করি।
যেহেতু এ বিষয় নিয়ে এর আগে কেউ কাজ করেননি সুতরাং আমার সামনে রেফারেন্স ছিল না। তাই সে সময়কার পত্র-পত্রিকার ছবি এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচরদের বক্তব্যের ওপর নির্ভর করেই কাজ করতে হয়েছে।
‘স্বর্ণালী যুগ’ প্রদর্শনীটি ২০২০ সালের মার্চে মুজিববর্ষ উপলক্ষে করার কথা ছিল। তবে বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ এর কারণে তা যথাসময়ে করা হয়নি। খুব শিগগিরই প্রদর্শনীটি আয়োজন করতে যাচ্ছি।
জাতির পিতার শত ব্যস্ততার মাঝেও এতো সুন্দর ও পরিপাটি জীবনে সবচেয়ে বেশি যার অবদান তিনি হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তাই এ প্রদর্শনী বঙ্গমাতাকে উৎসর্গ করবো এবং একপাশে বঙ্গমাতা কর্নার রাখবো।
আমার প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে সেমিনার করব। বঙ্গবন্ধুর পোশাক ও মুজিব কোট নিয়ে ফ্যাশন শো করব। এছাড়া তরুণ ডিজাইনারদের জন্য একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকবে। থাকবেন বুনন কারিগর ও সেলাই কারিগররাও। এ বিষয় নিয়ে বই লেখার কাজও শেষ পর্যায়ে, তৈরি করেছি থিম সং ও ডকুমেন্টারি।
লেখক: ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা।
জেএমএস/এসইউ/এএসএম