দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণুর গল্প
সুবর্ণ সন্ধ্যা

আনন্দ আর বিশালাক্ষী রমনা উদ্যানে মুখোমুখি বসেছিল | তাদের বন্ধু আবির হাসান ও রতি হাসান আসে মুঠোভর্তি আবির নিয়ে | সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা | সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির তাগিদ থেকেই ওরা আবির নিয়ে এসেছিল | চারজন ওই সন্ধ্যায় এ জায়গায় মিলবে তা পূর্ব নির্ধারিতই ছিল | রতি একটু ইয়ার্কির ছলে বিশালাক্ষীকে প্রশ্ন করে , ' কিরে মুখোমুখি কেন , পাশাপাশি নয় কেন? '
বিশালাক্ষীর সরলতা কাছের সবারই জানা | সে যেন রাতের নির্জনতার দ্রুপদী আকাশ | রতির প্রশ্নটা তাকে সেভাবে স্পর্শ করেনি | আনন্দ আর আবির কথা বলছিলো অন্য প্রসঙ্গে একটু দূরে দাঁড়িয়ে | বিশালাক্ষীর মৌনতায় রতির ফের প্রশ্ন , ' কিরে তুই কিছু বলছিস না যে ! '
বিশালাক্ষী রতির চোখে চোখ রেখে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলতে থাকলো , ' আমাদের জীবন উপাখ্যান পোড় খাওয়া অধ্যায় | তারপরও প্রকৃতির উদ্যানে গন্ধভরা ঘাস হতে চেয়েছি আমরা | চোখের ভেতর চোখ রেখে বহুবার শুষে নিয়েছি নোনা জল | আমাদের শরীরে সময়ের শাসনের কালোদাগ | এরপরও ইচ্ছাগুলো ইচ্ছে করেই অসংযত রেখে নির্মল আনন্দে অতিক্রমের সব অসম্ভবের দেয়াল টপকে ছুঁয়েছি সম্ভব-রেখা | মাটিতে শুয়ে শরীরে মাখি কাদামাটির ঘ্রাণ | কতদিন কতজন জানতে চেয়েছেন , তোমাদের ধর্ম কি গো ! সমস্বরে বলেছি , শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা | আমরা জীবনের সব অন্ধকার ও কষ্টের পারদ বিসর্জন দিয়েছি কালের বেগবান স্রোতধারায় | গতানুগতিকতার বাইরে পরস্পরের বাইরে ঢেউ হয়ে আছি | অনেকেই জানেন না যে , কষ্টের সব ক্ষত দৃশ্যমান নয় | '
রতি ফের অবাক | বিশালাক্ষীর কপাল ছুঁয়ে বললো , ' তোর কথার মানে সহজে বুঝে নেওয়া কঠিন | তুই এত গভীর কথা বলিস কি করে ! মনে হয় তুই প্রায় সময়েই দিগন্ত ছড়ানো ভাবনায় ডুবে থাকিস |'
বিশালাক্ষীর চোখ জলে ভরে গেল | রতিকে টেনে পাশে বসালো | রতির কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলতে থাকলো . ' তুই আমার বন্ধু , স্বজন | তোর কল্যাণেই আবিরের মতো বড় মাপের মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া | তুই তো সবই জানিস , যতটা আবিরের জানা নেই | আমরা চারজন আজ বলতে গেলে একবিন্দুতে | আনন্দ নিজেকে নিঃশেষ করে অন্যকে অশেষ করা মানুষ | আমার কখনো কখনো মনে হয় , তার কাছে মানুষ হওয়ার আমার নতুন করে দীক্ষা নেওয়া প্রয়োজন | তুই জানিস সানন্দ ছিল আনন্দের কত কাছের বন্ধু | আমার যখন সানন্দের সাথে সম্পর্ক এবং তা ক্রমেই পরিণতির দিকে যাচ্ছিলো তখনই নেমে এল বজ্রাঘাত | করোনার ঝাপটায় সানন্দের জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার পর আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে আনন্দ আমার সামনে নির্ভরতার স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায় | সানন্দের সাথে যখন আনন্দকে দেখেছি তখন তাকে এতটা পড়া হয়নি | কিন্তু সানন্দের চিরপ্রস্থান যে প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল তাতে আনন্দ ক্রমেই আমার মনোজগতের মেঘ চিরে আলোকরশ্মি হয়ে আমার সামনে আসছিলো | আনন্দ আমাকে বুঝাতো , তুমি আমার বন্ধু | আমি তোমাকে বুক দিয়ে আগলে রাখবো | আমি তোমার ছায়া হয়ে থাকবো | আমি বললাম , আনন্দ তোমার মাঝে আমি সানন্দকে পেয়েছি | তুমি আমাকে নাও | আনন্দ আমাকে বললো , আমাকে তোমার যোগ্য হয়ে উঠতে দাও | আমি হতবাক | মানুষ এত বিনয়ী হতে পারে ! নিজেকে সবার মাঝে এভাবে বিলিয়ে দিতে পারে ! জানিস রতি , তারপর আমরা একে অন্যকে নিয়ে বিমোহিত হতে থাকলাম | স্থির করলাম ঘর বাধবো | ' একটানা কথাগুলো বলে বিশালাক্ষী যেন বুক খালি করা বাতাস ছাড়লো | মনে হলো সে যেন অনেকটা নির্ভার হলো |
কেউ কোনো কথা বলার আগেই বৃদ্ধ পা বাড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'সবার জীবন হোক অমল-ধবল | ' এটুকু বলেই বৃদ্ধ সামনের দিকে যেতে থাকলেন | আনন্দ, আবির, বিশালাক্ষী, রতি অপলক তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধের দিকে | সুবর্ণ সন্ধ্যায় রমনা চত্বরে ওরা যার যার মতো করে ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে পড়লো|
রতি বললো , ' আমি ও আবির ঠিক করেছি তোদের দ্রুতই বিয়ের ব্যবস্থা করবো | তোর মায়ের সাথে আবির ও আমার কথা হয়েছে | তিনিও বলেছেন আনন্দকে তার খুব পছন্দ | মাসিমা চাচ্ছেন তার চাকরির মেয়াদ ফুরাবার আগেই তোদের বিয়েটা সেরে নিতে | আর আনন্দের তো অভিভাবক বলতে একমাত্র তার মামা | উনার সাথেও আমাদের কথা হয়েছে | তিনিও বলেছেন , আনন্দের স্বাধীনতা ও পছন্দই চূড়ান্ত | তোর সাথে আনন্দের সম্পর্কের ব্যাপারে তিনি খানিকটা জানেন | তাই আমাদের এখন এগুনোই উচিত | কিন্তু বিশালাক্ষী , আনন্দকে এত বিষণ্ন লাগছে কেন ! '
বিশালাক্ষী খানিকটা বিরতিতে বলা শুরু করলো, ' রতি আনন্দ খুব অন্তর্মুখী তা তো তুই জানিস | আমি আজই পরস্পর শুনলাম আনন্দ খুব বড় সমস্যায় পড়েছে চাকরি নিয়ে | আমি জানতে চেয়েছিলাম বিষয়টা তার কাছে | কিছুই না বলে শুধু আমার মাথায় হাত রেখে বললো , ক্ষমতার তাপে পুড়ছি | কিছু ভেবো না , সব ঠিক হয়ে যাবে | জীবন জয়ী হবেই | '
রতি বিশালাক্ষীকে অভয় দিয়ে বলে ' আমি জানি বিশালাক্ষী , সানন্দ তোর যৌবনে স্পর্ধা এনে দিয়েছিলো | তোর দুচোখে যখন শোককাতর হিম , জীবনের আকাশে থোক থোক মেঘ তখন তোর পৃথিবীকে আনন্দই আবার অসীম করে তুলে | তোর জীবনে তুই হয়ে পড়েছিলি বেদনার গাঢ় স্মারক ; সেখান থেকে আনন্দই আবার ঝঙ্কারমুখর জীবনের সান্নিধ্যের অপরূপ ঘ্রাণ দিয়ে তোর অজান্তে জীবনে রেখেছিলো হারানোর ক্ষত মুছে দেয়ার সাক্ষর। আমার তখন মনে হয়েছিল বুদ্ধের মূর্তির মতো আনন্দর শান্ত দুই চোখে তোকে সানন্দকে হারানোর শোক শক্তিতে পরিণত করতে আনন্দ পণ করেছিল | তুই এত ভাবিস না | আনন্দ কখনো জীবনের কাছে হেরে যাবে না | তার বিচক্ষণতা,বুদ্ধিমত্তা,অপার সহনশীলতা দিয়ে সে প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠবেই | তাছাড়া প্রকৃতির সুবিচারও আনন্দ পাবেই | নিজেকে নিঃশেষ করে যে অন্যকে অশেষ করে সে আর যাই হোক দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়ে পরে না , এ কথাটি তোর কাছ থেকেই একদিন জেনেছিলাম | তুই দুশ্চিন্তা ভুলে জীবনের নুতন নির্মাণরেখা নির্ণয়ের প্রস্তুতি নিতে থাক | ' রতির কথায় অনেকটাই স্বস্তি পায় বিশালাক্ষী |
তাদের কথা শেষ হতে না হতেই একজন বৃদ্ধ পথচারী তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন | আনন্দ আর আবির তাদের আলাপে মগ্ন | প্রায় কাছাকাছি পাঁচজন মানুষ অথচ তাদের বর্তমানটা যেন দুভাগে বিভক্ত | একদিকে আনন্দ আর আবির অন্যদিকে বৃদ্ধ ও বিশালাক্ষী আর রতি | বিশালাক্ষী দাঁড়িয়ে বৃদ্ধকে সম্ভাষণ জানিয়ে বললো , ' দাদু , আপনার আপত্তি না থাকলে বসুন আমাদের সাথে | আপনার নাম কি ? কি করেন ? '
বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন , ' কালের সাক্ষী | '
বিশালাক্ষী আর রতি বাকরুদ্ধ | তাদের অন্তর জিজ্ঞাসা , মানুষের এমন নাম হতে পারে ? তাদের খানিকটা কাছে এলো আনন্দ আর আবির | আনন্দ প্রশ্ন করলো , ' কি ব্যাপার সবাই নির্বাক ! উনি কে ? '
কেউ কোনো কথা বলার আগেই বৃদ্ধ পা বাড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'সবার জীবন হোক অমল-ধবল | ' এটুকু বলেই বৃদ্ধ সামনের দিকে যেতে থাকলেন | আনন্দ, আবির, বিশালাক্ষী, রতি অপলক তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধের দিকে | সুবর্ণ সন্ধ্যায় রমনা চত্বরে ওরা যার যার মতো করে ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে পড়লো |
এইচআর/জেআইএম