কবিতা আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে: আশিক বিন রহিম

আশিক বিন রহিমের জন্ম ১৯৮৬ সালে, চাঁদপুরের পুরানবাজারে। প্রায় দেড়যুগ ধরে লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, অনলাইন জার্নাল ও ছোটকাগজে নিয়মিত লিখছেন। সম্পাদনা করছেন কবিতার কাগজ ‘তরী’। চাঁদপুরের শিল্প ও সাহিত্যের সংগঠন সাহিত্য মঞ্চের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘পদ্মপ্রয়াণ (কাব্য, ২০১৮)’, ‘জাল ও জলের আখ্যান (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)’, ‘চাঁদপুরের চাঁদমুখ (লোকগবেষণা গ্রন্থ, ২০২০)’, ‘সংগ্রামে অর্জনে চাঁদপুরে নারীগণ (লোকগবেষণা গ্রন্থ, ২০২৪)’, ‘জলের কলতান (যৌথ কবিতাগ্রন্থ, ২০২৩)’।
আশিক বিন রহিম সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, চতুরঙ্গ ইলিশ উৎসব পুরস্কার, ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম পুরস্কার, নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা, নতুন কুঁড়ি লেখক সম্মাননা। তিনি ২০১৯ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন।
সম্প্রতি লেখালেখিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও কথাশিল্পী মুহাম্মদ ফরিদ হাসান—
জাগো নিউজ: আপনার ভেতরে কবিতা কীভাবে আসে? শব্দ কি আগে আসে, না অনুভব?
আশিক বিন রহিম: যখন খুব বেশি আনন্দিত, ব্যথিত কিংবা ক্ষুব্ধ হই; তখন আমার অন্তরাত্মার সাথে দেহের কথোপকথন হয়। আমরা ক্ষাণিক নির্জনতা খুঁজি। তখন কল্পনার সেই নির্জন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে উঠে আসে কিছু শব্দ, অনুভূতি, কিছু পঙ্ক্তি। তাদের সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে কিংবা সুঁই-সুতোয় গেঁথে নিতে পারলেই কখনো কখনো একটি কবিতা হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে শব্দ নাকি অনুভব—কোনটি আগে আসে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব।
জাগো নিউজ: আপনি যখন লেখেন; তখন লেখার মাধ্যমে কি নিজেকেই প্রকাশ করেন?
আশিক বিন রহিম: আমি সব সময় অন্যের ব্যথা কিংবা আনন্দে নিজেকে উপলব্ধি করি। ধরুন ফিলিস্তিনের যুদ্ধাহত একটি শিশুকে বুকে ধরে তার বাবা চিৎকার করছেন; কিংবা সুখী কোনো রাষ্ট্রের একজন তরুণ সমুদ্রপাড়ে তাবু যাপন করে চাঁদ দেখছেন; আমি দুটি চরিত্রেই নিজেকে উপলব্ধি করি। ফলে আমার উপলব্ধি থেকে জন্ম নেওয়া কবিতায় মূলত আমি মানুষকে প্রকাশ করি। নিজের ভেতরের সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করি।
জাগো নিউজ: আপনার প্রথম বইটি কবে প্রকাশিত হলো? বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন?
আশিক বিন রহিম: আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মপ্রয়াণ’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে অমর একুশে বইমেলায়। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি এককথায় প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার মতো। যে অনুভূতি শব্দে কিংবা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; যে অনুভূতি অনন্য-অন্যরকম। প্রথম বই হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের ভেতর প্রবল উচ্ছাস, উদ্দীপনা অনুভব করেছি। যা স্পর্শ করার পর নিজের সন্তানের মতো অনাগত প্রতিটি শব্দের প্রতি যত্নশীল এবং দায়িত্বশীল হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে।
জাগো নিউজ: কবিতার জগতে কীভাবে পদার্পণ করলেন?
আশিক বিন রহিম: ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি আমার প্রগাঢ় প্রেম ছিল। ওই সময়টাতে সাহিত্যের ভালো বই সংগ্রহ করা কঠিন ছিল। হাতের কাছে যা পেতাম, তাই পড়তাম। তবে কবিতা এবং গল্প আমাকে বেশি টানতো। মাধ্যমিকে পড়ার শুরুতে কবিতা পড়া এবং লেখার প্রতি আমার প্রেমটা গাঢ় হতে থাকে। তখন জসীম উদ্দীনের কবর, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, নজরুলের মানুষ কবিতা আমাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে।
জাগো নিউজ: এ পর্যন্ত কী কী বিষয়ে লিখেছেন?
আশিক বিন রহিম: আমি মূলত গল্প এবং কবিতা লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। সম্প্রতি লোকগবেষণা নিয়ে কাজ করছি। এ পর্যন্ত আমার একটি করে কবিতা ও ছোটগল্পের বই এবং দুটি লোকগবেষণার বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত দুটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি ‘তরী’ নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করছি।
জাগো নিউজ: একজন লেখক হিসেবে নিজের স্বাতন্ত্র্যের ছাপ কীভাবে রাখেন?
আশিক বিন রহিম: সাহিত্যের বিশাল মহাকাশে নিজেকে ক্ষুদ্র আলোর কণা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হলেও স্বতন্ত্র থাকা খুব জরুরি। আমরা বেতফল কিংবা গোবরেপোকা পড়লেই বুঝতে পারি এটা জীবনানন্দের কবিতা। লালসালুর কয়েকটি লাইন পড়লেই বুঝতে পারি, লেখার এই ধরনটা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নিজস্ব। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আল মাহমুদ কিংবা সৈয়দ শামসুল হক কিছু শব্দ, কিছু ধরন একান্ত নিজের করে গেছেন। এই স্বাতন্ত্র্য না থাকলে সাহিত্যের বিশাল মহাকাশ থেকে কাউকে খুঁজে বের করা কঠিন। আমি সব সময় চেষ্টা করি নিজের কবিতা অথবা গল্পে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ থাকুক। এজন্য যতটা সম্ভব প্রচুর পড়ার চেষ্টা করি। এরপর নিজের লেখার ক্ষেত্রে অন্যের প্রভাবমুক্ত থাকা, লেখার বিষয়কে নিজের দৃষ্টিতে দেখা এবং প্রকাশে স্বাতন্ত্র্য বা নিজস্বতা রাখার চেষ্টা করি।
জাগো নিউজ: আপনি কি মনে করেন, সাহিত্য দিয়ে সমাজে কিছু বদলানো সম্ভব?
আশিক বিন রহিম: আসলে সাহিত্য দিয়ে সমাজ বদলানো যায় না। বদলানো যায় মানুষের ভেতরকার মনুষ্যত্বকে। মানুষকে সত্য এবং সুন্দরের পথে জাগ্রত করা যায়, প্রভাবিত করা যায়। অসুন্দরগুলো মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরে তাদের নিরুৎসাহিত করা যায়। সমাজ যদি সুন্দর থাকে, তাকে বদলানোর কী প্রয়োজন? মানুষের ভেতরের মনুষ্যত্বকে সুন্দরের পথে জাগ্রত রাখতে পারলে সমাজ সব সময় সুন্দর থাকে। কাজটি সাহিত্য এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে সহজে করা সম্ভব।
জাগো নিউজ: লেখক জীবনে আপনার প্রাপ্তি বা অর্জন সম্পর্কে জানতে চাই—
আশিক বিন রহিম: আমি সব সময় কম চাহিদা সম্পন্ন একজন মানুষ। এ জন্য অপ্রাপ্তি কখনো আমাকে স্পর্শ করে না। আর তাই আমার ক্ষুদ্র লেখক জীবনে প্রাপ্তির আনন্দ মিছিলটা অনেক দীর্ঘ। তরুণ বয়সে নিজের পাঁচটি বই প্রকাশিত হওয়া, অসংখ্য পুরস্কার অর্জন, একটি সাহিত্য সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া এবং বিদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগদান—এ সবকিছুই আমার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো সমাজের উৎকৃষ্ট মানুষদের সংস্পর্শ পাওয়া। নিজেকে ভালো রাখতে, অসুন্দরমুক্ত থাকতে এবং জীবনকে উপভোগ করতে ভালো মানুষের সংস্পর্শ খুব জরুরি। যাদের দ্বারা সমাজ কিংবা মানুষের ক্ষতি হয়নি। যাদের কাছে ফুল, পাখি, নদী, পাহাড় নিরাপদ—আমি সেইসব মানুষের সংস্পর্শে থাকতে পারছি।
জাগো নিউজ: বর্তমানে কী নিয়ে লিখছেন?
আশিক বিন রহিম: বর্তমানে ছোটগল্প এবং চাঁদপুর জেলার দুটি বিষয়ে লোকগবেষণা নিয়ে কাজ করছি। এর পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষায় কিছু কবিতা লেখার চেষ্টা করছি। তবে কবিতা এবং গল্পগুলো বই আকারে প্রকাশ করতে অনেক সময় নেবো।
জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে লেখালেখি নিয়ে কী পরিকল্পনা আছে?
আশিক বিন রহিম: একটি উপন্যাস এবং কিছু মঞ্চ নাটক লেখার পরিকল্পনা আছে। যদিও বিষয় অনেকটাই নির্ধারণ করে ফেলেছি। তবে অনেক সময় নিয়ে গভীরভাবে কাজগুলো করতে চাই। যার জন্য নির্ধারিত বিষয় নিয়ে পড়া এবং জানার পাশাপাশি নিজেকেও ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি।
এসইউ/এএসএম