জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
ইমদাদুল হক মিলনের সাহিত্যের মল্লার
মাসউদ আহমাদ
বাংলাদেশের সাহিত্যরুচির প্রেক্ষিতে ইমদাদুল হক মিলন এক বিস্ময়কর লেখক। বিস্ময়কর, কেননা এখানে একসময় গল্প ও উপন্যাসের পাঠকের মানসজগত ও প্রিয়তার জায়গাটি প্রবলভাবে দখল করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন লেখক। পাঠকের পাঠতৃষ্ণা পূরণে তাঁরা একচেটিয়া ভূমিকা রেখেছেন বছরের পর বছর। মুত্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে গদ্যরচনা বা ভালো গদ্যশিল্পী বলতে যা বোঝায়, তার বেশ সংকট ছিল। তখন শওকত ওসমান, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত গদ্যশিল্পী। কিন্তু একইসঙ্গে কয়েকজন লেখক পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় ধারার সেই প্রবল প্রতাপ সরিয়ে ক্রমশ জায়গা করে নিতে নিতে পাঠককে বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে এনেছেন। এঁদের অন্যতম ইমদাদুল হক মিলন।
তখনো জনপ্রিয় ধারার সাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব ঘটলেও বিস্তার ঘটেনি। ইমদাদুল হক মিলন ততদিনে এতটাই জনপ্রিয় লেখক হিসেবে নাম করে গেছেন, হুমায়ূন আহমেদ অন্য সাধারণ পাঠকের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে বই কিনে মিলনের অটোগ্রাফ নিয়েছেন।
একটি লেখায় এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘মিলনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৮৩ সনের বাংলা একাডেমি বইমেলায়। তখন আমি সদ্য দেশে ফিরেছি। দীর্ঘ প্রবাসজীবন যাপনের কারণে দেশের সবকিছুই অন্যরকম লাগছে। বইমেলার উড়ন্ত ধূলাবালি, মানুষের ভিড়, চটপটির দোকান থেকে ভেসে আসা বাসি ডালের গন্ধ অসহনীয় মনে হচ্ছে। এমন সময় একটি বিশেষ দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। আমি দেখলাম এক তরুণ যুবা পুরুষকে ঘিরে ভিড় জমে আছে। সবাই তার আটোগ্রাফ নিচ্ছে।
উনি কে? নাটক-সিনেমার কোনো অভিনেতা? একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, উনি ইমদাদুল হক মিলন। নভেলিস্ট। আমি ইমদাদুল হক মিলনের নাম আগে কখনো শুনিনি এবং একজন নভেলিস্টের অটোগ্রাফ নেবার জন্যে ভিড় হতে পারে এই অভিজ্ঞতাও আমার নেই। আমি তাঁর একটা বই কিনলাম। (এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না, খুব সম্ভবত ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’)।
বই হাতে এগিয়ে গেলাম লেখকের দিকে। যদি অটোগ্রাফ পাওয়া যায়। মিলন আমার হাত থেকে বই নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, নাম? আমি বিনীতভাবে আমার নাম বললাম। মিলন খসখস করে অতি দ্রুত লিখল’।
পাঠক কেন বাংলাদেশের নতুন লেখকদের লেখা প্রাণভরে গ্রহণ করলেন? খেলাধুলা ও বিটিভির বাইরে আত্মার বিনোদন বলতে তো সাহিত্যই। এটা এমন এক নিরপরাধ সময়ের রেখাচিত্র, যখন পৃথিবীতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম বা ইন্টারনেটের দৌরাত্ম্য জেঁকে বসেনি। ক্লাসিক সাহিত্য পাঠককে দীপিত করে, বিদেশি সাহিত্য মন ও চিন্তাজগতকে প্রসারিত করে, কিন্তু শান্তি ও আনন্দ দেয় সমকালীন স্বদেশী লেখকের লেখা।
ইমদাদুল হক মিলন তাঁর প্রেমের গল্প ও উপন্যাসে একের পর এক লিখে চললেন আমাদের জীবনেরই প্রতিদিনের গল্প, না বলা উপাখ্যান ও চাপা পড়া হৃদয়ের টাটকা কাহিনি। নতুন ভাবনা ও গল্পের উন্মোচন করতে থাকলেন তিনি, পাঠক তুমুলভাবে তাঁর লেখা গ্রহণ করলেন। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ উপন্যাস লিখে তিনি আরেকটু এগিয়ে গেলেন। ১৯৭৭-এ ‘ভালোবাসার গল্প’ দিয়ে শুরু করে ক্রমশ অজ¯্র লেখা। তারপর মাইলস্টোন সেই উপন্যাস ‘ভালোবাসার সুখ-দুঃখ’।
আমাদের গল্প উপন্যাসে বেশিরভাগ নায়িকা বা মূল চরিত্র ফর্সা ও সুন্দর হয়। নায়িকারা সবাই হয় রূপবতী আর মায়াবতী। মিলন গল্প লিখলেন, নায়িকার গায়ের রং কালো, সবাই তাকে ডাকে ব্লাকি বলে। ‘কমলা সুন্দরী’ তাঁর আরও একটি ঝকঝকে সুন্দর প্রেমের উপন্যাস। ইমদাদুল হক মিলনের প্রতিদ্বন্দ্বী তখন কেউ নন, তিনি নিজেই।
পাঠককে মিলন মাত করে দিলেন। উপন্যাসে অক্ষরে অক্ষরে তৈরি করলেন এক আশ্চর্য সম্মোহন। একটা সহজ ভাষাভঙ্গি, কিন্তু আকর্ষণীয়। এক পৃষ্ঠা পড়লে যেন পরের পৃষ্ঠা পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। ছোট ছোট বাক্য, সহজ-সরল শব্দ, মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, তা তিনি সাহিত্যে নিয়ে এলেন।
বিভিন্ন সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকার ও ব্যক্তিগত লেখায় ইমদাদুল হক মিলন জানিয়েছেন, বন্ধুদের মধ্যে প্রতিভা জিনিসটা তাঁর একদমই ছিল না এবং তিনি অনেকটা জোর করে লেখক হয়েছেন।
গত কুড়ি বছরে তাঁর এই কথা নানা জায়গায় পড়েছি। কথাটা আমার ঠিক মনোঃপূত হয়নি, কিন্তু মাথায় থেকে গিয়েছিল। আমার বক্তিগত ধারণা, নিজের প্রতিভা ও সাহিত্যযাত্রা নিয়ে এই স্বগত উক্তি আসলে মিলনের সাহিত্যিক বিনয়। এমন বিনয়, যার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না।
কবি রফিক আজাদকে মিলন বাবা ডাকতেন। মিলনের প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ বাংলা একাডেমির মাসিক উত্তরাধিকার-এ ধারাবাহিকভাবে ছেপেছিলেন তিনি, সেই কৃতজ্ঞায়? একদমই নয়। মিলনকে তিনি একরকম আবিষ্কারই করেছিলেন।
‘মিলনকে নিয়ে দুচার কথা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমি ইমদাদুল হক মিলনের একটি গল্প পড়েছিলাম কোনও একটি কাগজে। পড়ে ওর গদ্যশৈলী, লেখার ধরন, বিষয়বস্তু আমাকে আকৃষ্ট করে। একদিন মিলনের সঙ্গে কথা বললাম। দেখলাম বেশ ডাকাবুকো, ইয়াং, ছটফটে তরুণ। দেখে মনে হয় না যে লেখালেখি করে। তাকে বললাম ‘উত্তরাধিকার’-এ লিখতে। পরে লিখতে গিয়ে মিলন আমাকে জানালো, লেখাটা একটু বড় হয়ে যাচ্ছে। আমি তাকে আশ্বাস দিলাম বড় হোক কোনও অসুবিধা নেই। ধারাবাহিকভাবে ছাপবো। ঐটি মিলনের প্রথম উপন্যাস। যাবজ্জীবন। আরও পরে সে দু’হাতে গল্প-উপন্যাস লিখেছে। মিলন সর্বাংশে, সর্বাঙ্গে নাগরিক হয়েও বাংলাদেশের গ্রামকে খুব ভালো জানে। এটা ওর একটি বড় প্লাস পয়েন্ট। ওর যে গ্রাম, বিক্রমপুরের একটি গ্রাম। যে গ্রামে ও বড় হয়েছে। সেই গ্রামেরও গ্রামীণ চরিত্রগুলো কী অসাধারণ বর্ণনা ওর লেখালেখিতে আসে। তাছাড়া নাগরিক তরুণ-তরুণীদের মনোভঙ্গি, তাদের রুচি, জীবনযাপন পদ্ধতি- এগুলো মিলন খুব ভালো লেখে। কথাশিল্পের জন্য যে ব্যাপক অভিজ্ঞতা একজন লেখকের দরকার অল্প বয়সেই মিলন তা অর্জন করেছে।’
রফিক আজাদ কী অসামান্য অবলোকন দিয়ে মিলনকে অনুভব ও আবিষ্কার করেছেন, এই উদ্ধৃতি থেকে তা জলের মতো পরিষ্কার বোঝা যায়। তাই এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়, একজীবনের সাহিত্যিক প্রস্তুতি ছাড়া এমন দূরগামী লেখক অভিযাত্রা সম্ভব নয়।
যে কোনো মৌলিক শিল্পীর শিল্পকর্মে লেগে থাকে তাঁর আত্মার ঘ্রাণ। ব্যতিক্রম ছাড়া খুব কমক্ষেত্রে শিল্পী নিজেকে পুরোপুরি ভেঙে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ইমদাদুল হক মিলন এমন একজন কথাশিল্পী, যিনি তাঁর লেখকজীবনের শুরু থেকেই সচেতনভাবে দু ধরনের সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। এটা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর সাহিত্যিক গুরু সমরেশ বসুর কাছে থেকে। সমরেশ একই সঙ্গে লিখছেন গঙ্গা, বিবর, শিকলছেঁড়া হাতের খোঁজের মতো উপন্যাস; আবার তিনিই লিখছেন ‘বিকেলে ভোরের ফুল’। মিলনের প্রথম গল্পের বই ‘ভালোবাসার গল্প’, পরের বছরেই তিনি লিখছেন ‘নিরন্নের কাল’। এই ভঙ্গিটি তিনি সমান্তরালে অব্যাহত রেখেছেন।
শুরু থেকেই মিলন প্রেমের গল্প উপন্যাস মোহগ্রস্তের মতো লিখে বিপুল পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। জীবনের তাগিদে, জনপ্রিয়তা আর বাণিজ্যিক কারণে সেসব লেখা তিনি প্রচুর লিখেছেন। এমন অসম্ভব জনপ্রিয়তা তাঁর আগে আর কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। তবে এ জন্য তাঁকে হতে হয়েছে নিন্দিত ও সমালোচিত এবং বিপুল দুর্নামের ভাগিদার।
এর বিপরীতে নিয়মিতভাবে মিলন শিল্পসম্মত ও সিরিয়াস ধারার গল্প ও উপন্যাস লিখে গেছেন। সেসব লেখা সংখ্যায় কম, কিন্তু শিল্পের বিচারে অসামান্য। অতুলনীয়। বিখ্যাত মানুষকে নিয়ে নানা ধরনের জনশ্রুতি, মিথ ও ভুল বোঝার গল্প চালু থাকে। মিলনও পাঠকের ভুল বোঝার খাতায় চিহ্নিত হয়েছেন। মিলন তাঁর সাহিত্যযাত্রায় প্রেমের গল্প উপন্যাস, হালকা জনপ্রিয় ধারার লেখা এত লিখেছেন, তাঁর সেরা গল্প ও উপন্যাসগুলো অনেক সমালোচক ও গভীরমনস্ক পাঠকের মনোযোগ পায়নি। সে কারণে অনেক পাঠক অন্যায্যভাবে, ভুলভাবে এবং হৃদয়হীন বিবেচনায় তাঁর প্রায় সব গল্প উপন্যাসকেই বাজারি ও নিম্নমানের লেখা হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
সচেতন পাঠকমাত্রই তির্যকভাবে অনুভব ও আবিষ্কারে সক্ষম হবেন, গল্প উপন্যাসে যে ধরনের শিল্পচিন্তা, বিভা ও তার রূপায়ন থাকলে গুরুত্বপূর্ণ ও অসামান্য কথাশিল্পী হিসেবে বিবেচিত হন, ইমদাদুল হক মিলনের অজস্র গল্প উপন্যাসে সেই শিল্পস্বর নিহিত আছে। বিশদ আলোচনায় না গিয়ে আমরা এখানে তাঁর কয়েকটি গল্প ও উপন্যাসের তালিকা দেব, যার নির্যাস উপলব্ধি করে পাঠকই সিন্ধান্ত নিতে পারবেন। গল্প: ‘গাহে অচিন পাখি’, ‘জোয়ারের দিন’, ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’, ‘রাজার চিঠি’, ‘নিরন্নের কাল’, ‘ছোঁচা কদম’, ‘দেশভাগের গল্প’, ‘কিরমান ডাকাতের প্রথম ও দ্বিতীয় জীবন’, ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’, ‘সাড়ে তিনহাত ভূমি’ প্রভৃতি। উপন্যাস: ‘কালো ঘোড়া’, ‘পরাধীনতা’, ‘টোপ’, ‘যাবজ্জীবন’, ‘কালাকাল’, ‘ভ‚মিকা’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘কালাকাল’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘নূরজাহান’ প্রভৃতি।
পাঠক হিসেবে একটি খেদের কথা জানিয়ে লেখাটি শেষ করি। লেখক হওয়ার জন্য ইমদাদুল হক মিলনের যে জার্নি ও প্যাশন, সেটা অসাধারণ। এখনকার কোনো তরুণ লেখক সেই অভীপ্সা ও জার্নি পেরিয়ে লেখক হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেন কিনা, ভাবতে হয়।
জীবনের নানা বাঁকে বিচিত্র টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। সে কারণে অসংখ্য লেখা তিনি লিখেছেন। তাঁর জন্য একটি গ্রেট চান্স ছিল; একসময় পয়সার জন্য যা লিখেছেন, লিখেছেনই; হারিয়ে যাওয়া সেসব লেখা নতুন করে গ্রন্থিত না করা। কিন্তু তিনি আবার তা করেছেন। সচেতনভাবেই তিনি তাঁর কলমের প্রকাশকে পুরনো পথেই চালিত করেছেন। অথচ পারতেন, বাছাই করা লেখাগুলোই সামনে নিয়ে আসতে। কেননা শেষ পর্যন্ত শিল্পীর নেপথ্যের গল্প ও দীর্ঘশ্বাস মানুষ মনে রাখে না। মনে রাখে কেবল সেই গল্প বা উপন্যাসটি, সময়ের ঘা ও সাহিত্যিক দাবি উৎরে যেটি টিকে যায়।
এইচআর/জেআইএম