ফাত্তাহ তানভীর রানার গল্প: জল সংকট

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৫০ পিএম, ০৮ জানুয়ারি ২০২৩

ফসলের মাঠ থেকে কিছুতেই পানি সরছে না। নদীর পানি অনেক কমেছে, মৎস্যজীবীরা সানন্দে মাছ ধরছে। আর বিলের পানি আগের মতোই আছে। কৃষকদের চিন্তার অন্ত নেই। এরকম কৃত্রিম জল সংকট হয়নি তা নয়। এবারেরটা প্রকট হয়েছে; বন্যার পানি একবার নেমে গেলেও আবার কিছুদিন পর বন্যা হয়। কৃষক আবাদি জমি চাষ করবে করবে করেও চাষ করতে পারছে না। আগে চাষাবাদ করতে পারলে ফলন আগে আসবে ঘরে, তখন তা বিক্রি করে কৃষক লাভবান হবে। দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় এমনিতেই কৃষক ও সাধারণ মানুষের হাতের অবস্থা খারাপ। দ্রুত চাষবাস করতে পারলে তা বিক্রি করে হাত সড়ত। কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়? দীর্ঘসময় কর্মহীন থাকলে আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল ঠিকমতো না হলে সাধারণ মানুষ ধার-কর্জ, দাদনে জর্জরিত হয়ে যায়।

রাজু মাস্টারকে দেখে সবাই জমায়েত হলো। রাজু তাকে ঘিরে ধরার কারণ জিজ্ঞেস করতেই মাঝবয়সী কৃষক মকবুল বলল, ‘মাস্টার তুমি জানো না গেটের দরজা বন্ধ!’
রাজু বিষয়টি সম্পর্কে অপারগতা প্রকাশ করে বলল, ‘কয়েক বছর যাবৎ সমস্যাটি চলছে। দুই বছর আগে চেয়ারম্যান সাহেবকে বলেছিলাম, তখন চেয়ারম্যান সাহেব কী বলেছিলেন? তিনি কী করেছিলেন মনে নেই? তা ছাড়া গ্রামের মেম্বার তো বিষয়টি জানে।’
যুবক বয়সের স্বল্প শিক্ষিত কৃষক শাকিল বলল, ‘তাই বলে কি আমরা বসে থাকবো? আমরা দরকার হলে কৃষি অফিস, মৎস্য অফিস, ইউএনও অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ডে আবার যাব।’
রাজু জিজ্ঞেস করল, ‘কে যাবে তোমাদের সাথে?’
যুবকটি বলল, ‘আমরা সবাই যাব। সবাই যেতে রাজি আছে। আপনিও যাবেন আমাদের সাথে।’
‘কী মেম্বার, যাবে না আমাদের সাথে?’ জানতে চাইলো রাজু।
সবাই চুপ রইলো। মুরুব্বি কৃষক কালু বলল, ‘কেউ গেলে যাবে, কেউ না গেলে নাই। আমরা যাবোই। বছর বছর এই অত্যাচার সহ্য হয় না।’
‘ঠিক আছে যাব একসাথে, ডেট কর।’ জানালো রাজু।

কয়েকদিন পর রাজু ও তার বন্ধু সুমন সবাইকে নিয়ে চা খেতে বসলো। এসময় শাকিল বলল, ‘আচ্ছা মুরুব্বীগণ, আমরা গেলবার পানি উন্নয়ন বোর্ডে গিয়েছিলাম। তারা বলেছিল, গেটের পানি ছাড়ানোর জন্য এতদূর এসেছেন কেন? এটা তো স্থানীয় মানুষরা বসেই সমাধান করতে পারেন। আপনারা যেভাবে চাইবেন, আমাদের অফিস সেভাবেই নির্দেশনা দেবে। গেট তো আপনাদের সুবিধার জন্যই। উপজেলায় কৃষি ও মৎস্য অফিস আছে না? তবে এসেই যখন পড়েছেন, তখন তদন্ত করতে অফিসার পাঠাবো। তারা কতদিন পরে লোক পাঠিয়েছিলেন মনে আছে সবার?’
সবাই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। ‘তারা তদন্তে এসে দেখলো স্লুইস গেট ছাড়া হয়েছে! তারা এসে বলল তাদের অফিসে জনবল সংকট তাই আসতে দেরি হলো। তবুও আমরা সরকারি অফিসগুলোতে যাবো।’ শেষ করল শাকিল। সবাই তার সাথে সহমত পোষণ করলো।

সত্তরের দশকের শুরুতে নদীর তীর বেয়ে বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধ নির্মাণ করায় মূলত এখানে তিনটি থেকে চারটি গ্রামের সাধারণ মানুষ বন্যার পানি থেকে রক্ষা পায়। স্লুইস গেটের পানি নির্গমনের ওপর নির্ভরশীল চার গ্রামের সাধারণ মানুষ। কৃষি জমির উপরে নির্ভরশীল সাধারণ মানুষ স্লুইস গেট খুলে দিলে বন্যার পানি চলে গেলে চাষাবাদ করে। সবকিছু ঠিকমতোই চলছিল। গত পাঁচ-সাত বছর যাবৎ এক শ্রেণির লোভী মৎস্য ব্যবসায়ী স্লুইস গেটের মুখ পরিকল্পিতভাবে বন্ধ রেখে লাভবান হচ্ছে। তারা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরেও বন্ধ স্লুইস গেট খুলছে না। এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছে গ্রামের সাধারণ কৃষককূল। আর জমিতে পানি থাকার কারণে পানির ভেতরে মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। একদিকে কৃষকরা পানিবন্দি হওয়ার কারণে চাষ করতে পারছে না। অন্যদিকে পানি থাকার কারণে তা আশীর্বাদ হচ্ছে মুষ্টিমেয় মানুষের। এ ছাড়া মুক্ত পানিতে ছাড়া মাছ অনেক সময় কৃষকের ফসলও খেয়ে ফেলে। বহুবার সাধারণ মানুষ প্রতিকার চেয়ে চেয়ে এখন প্রতিকার চাইতেও ভুলে গেছে! কম সংখ্যক উপকারভোগী মানুষের পেছনে রয়েছে পরোক্ষ রাজনৈতিক মদদ।

গ্রামে গ্রীষ্মকালে যখন পানির সংকট হতো; তখন মানুষ খোঁজ করতো তারা টাইপ টিউবওয়েল। আর গ্রামের দু’একজন ধনী মানুষ তাদের বাড়িতে ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে নিত। অধিকাংশ সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করতো কবে পানির স্তর উঠে আসবে। তখন মাঠে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত মেশিনের পানিও ফেল করতো। মাটি খুঁড়ে মেশিন গর্তে বসিয়ে দিলেও মেশিনে পানি উঠতো কম। গ্রীষ্মকালীন জল সংকট ভাবিয়ে তোলার মতোই ছিল। জল সংকটের কারণে ধান চাষে ফলন কম হতো। এ ছাড়া অন্য ফসলও প্রভাবিত হতো। সংকটের কারণে কৃষকের তেলখরচসহ অতিরিক্ত খরচ হতো। জলহ্রাস মানুষের ভাবনার কারণ ছিল। জলের কৃত্রিম আধিক্য মানুষকে ভাবাবে, কেউ কি ভেবেছিল? জলের আধিক্য এখন জল সংকটে পরিণত হয়েছে।

মৎস্য অফিসার ডেস্কে নেই। ইউএনওর সাথে মিটিং চলছে, আসতে দেরি হবে। সেখানকার ক্লার্ক বললেন, ‘সুতি জালের ব্যবহার করলে পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ ধরলে আমাদের এখতিয়ার থাকে। মানুষকে পানিবন্দি করে কেউ মাছ চাষ করলে আমাদের কিছু করার থাকে না। আপনারা পানি উন্নয়ন বোর্ড বা কৃষি অফিসে কথা বলে দেখতে পারেন।’ গ্রামের সাধারণ মানুষ আর কী করবে? তারা তো আর সরকারি অফিসে গিয়ে কারও মুখে মুখে তর্ক করতে পারে না।

কৃষি অফিসার ডেস্কে ছিলেন। তিনি বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন। কৃষি অফিসার নিজেও একজন কৃষকের ছেলে, তিনি নিজের অপারগতা প্রকাশ করলেন। পরে তিনি ইউএনওর সাথে কথা বলার অনুরোধ করে সবাইকে বিদায় করে দিলেন। বেচারা গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো লিখিত চিঠি নিয়ে ইউএনওর দপ্তরে গিয়ে শুনলো ইউএনও সাহেব মাত্র কয়েক মিনিট আগে চেয়ার ছেড়ে উঠেছেন। একজন ভিআইপি এলাকায় ঢুকেছেন। ইউএনও তার প্রটোকলে রয়েছেন। ডিসি মহোদয়ও সাথে রয়েছেন। গ্রামের পা-ফাটা গরিব মানুষগুলোর শুধু ভোগান্তি। ফলাফলহীন শূন্য হাতে তারা গ্রামে ফিরে এলো।

সবার চাপাচাপিতে একদিন রাতে চার গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি আর তরুণসহ রাজু মাস্টার ও তার বন্ধু সুমন মিটিংয়ে বসলো। বিগত দিনের কাজগুলো আলোচনা করে ভবিষ্যৎ কী হবে তা নির্ধারণই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। কেউ একজন বলে বসলো, এমপি সাহেবের বাড়িতে তার একজন পরিচিত লোক আছে; সেখানে বললে কেমন হয়? অনেকেই এমপির কাছে যাবার পক্ষে মত দিলেন। অবশ্য কেউ কেউ বলল, ‘কী এমন ব্যাপার, সকলের চেয়ে কি কয়েকজন বেশি শক্তিধারী? আমরা জোর করে গেটের মুখ খুলে দেব।’ এতেও কম বয়স্ক কেউ কেউ সায় দিলো। কালু মিয়া বলল, ‘গেট যারা চালায় তারা তো খুব খারাপ লোক। সেখানে গেলে মারামারি হতে পারে।’ মিটিংয়ের আলোচনা শুনে রাজু আর তার বন্ধু সুমন অপারগতা পোষণ করে মিটিং ছেড়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘আমরা চাকরি করি। এসব ঝামেলায় নেই বাপু। তবে তোমাদের প্রতি মৌন সমর্থন রইলো।’ তাদের মিটিং ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে খুব সমালোচনা হলো। গ্রামবাসীর বিপদে গ্রামের শিক্ষিত ছেলেরাই পাশে থাকলো না। সেদিন আরও আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সবাই মিটিং শেষ করে চলে গেল। মিটিং শেষ করলেও সবাই মনে মনে অতুষ্টিতে ভুগতে লাগলো।

কয়েকদিন পর শাকিল সবাইকে বুঝিয়ে আবার এক করলো। কিছু মাথা-মুরুব্বি মিটিংয়ে আসলেন। শাকিলসহ তার বন্ধুরা স্লুইস গেটটি জোর করে খুলে দেবার পক্ষে। বিরোধী পক্ষ যতই বাধা দিক, আর যতই শক্তিশালী হোক না কেন। উপস্থিত অনেকেই মন্তব্য করেন, ‘কতদিন আর মুখ বুজে থাকবো? একদিন তো মাথা তুলে দাঁড়াতেই হবে। বিগত পাঁচ-সাত বছর আমরা অনেক ক্ষতির শিকার হয়েছি। এভাবে চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে কখনোই সমাধান হবে না। আর কত, আর কত? কী বলো মিয়ারা?’ সবাই উত্তেজিত হয়ে গেল। উপস্থিত গ্রামবাসী বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করতে লাগলো। শাকিল লক্ষ্য করলো মিটিং ক্রমশ বড় হচ্ছে! সে তো সবাইকে বলেনি। শুধু যারা গ্রামে সিদ্ধান্ত দেন, তাদের বলা হয়েছে। এত মানুষ আসছে কেন? একপর্যায়ে কেউই আর শাকিলকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেরা নিজেদের মতো আলোচনা করতে লাগলো।

‘আমরা মার খেলে একসাথেই খাবো, পুলিশ ধরলে একসাথেই থানায় যাবো। ওরা মাত্র দশ-বারো জন; আমরা শত শত মানুষ। ওদের সাথে নেতাদের ভালো খাতির আছে। আর আমাদের ভোটেই তো নেতা নির্বাচিত হন। জনপ্রতিনিধিরা অব্শ্যই আমাদের সাথে থাকবেন। আমরা কোনো অন্যায় করছি না, শুধু নিজেদের অধিকার আদায় করব মাত্র। কি মিয়ারা, আছি আমরা একসাথে?’ সমস্বরে সবাই বলল, ‘আমরা সকলেই আছি।’

কিছু সময় পর ভোরের আলো ফুটবে। সারারাত কথা বলতে বলতে কীভাবে পেরিয়ে গেছে কেউই খেয়াল করেনি। রাতে না ঘুমালেও কারো ক্লান্তি নেই। সবাই মিলে স্লুইস গেট অভিমুখে রওনা হলো। শাকিল আর তার বন্ধুরাও শামিল হলো। তিন-চার গ্রামের মানুষ আগে কোনো বিষয় নিয়ে একাট্টা হয়নি। স্লুইস গেট পুরোপুরি খুলে দিলে পানি একদিনেই নেমে যাবে। চাষবাসের জমি জেগে উঠবে, জমিতে কৃষক বীজ বপন করবে। বীজ থেকে ফসল হবে, ফসল বিক্রি করলে কৃষকের অভাব ঘুচবে। সবাই যাচ্ছে স্লুইস গেট অভিমুখে, সাথে যাচ্ছে তাদের স্বপ্ন।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।