অলোক আচার্যের তিনটি অনুগল্প

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৩০ পিএম, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

মেরুদণ্ড

আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার সামনে নতুন জামাইয়ের জন্য তৈরি করা হরেক রকমের খাবার। শ্বশুরবাড়ি বলে কথা! জামাই আদর তো হতেই হবে! বিয়ে করেছি মাস দুয়েক হলো। বিয়ের পর চাকরির কারণে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হয়নি।

এরই মধ্যে আমার কাছে অভিযোগের পাহাড় হাজির করে স্ত্রী। রান্নাবান্না সম্ভব নয় তার। বাড়িতে কোনোদিন রান্না করেনি। শ্বশুর-শাশুড়ির যত্ন-আত্তি করাও সম্ভব নয়। আরও নানা আবদার-অভিযোগ। দিনের পর দিন শুনতে শুনতে কান ভারী হয়ে আসে। আমি ভাবি ক’টা মাস গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

তাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলাম বেড়াতে। যদি মনটা একটু ভালো হয়। শাশুড়ি যদি মেয়েকে সংসার করার বিষয়টা ভালোভাবে বোঝান। কিন্তু কিসের কী? আমার শাশুড়ি উল্টো বলে চলেছেন, ‘আমার মেয়েকে কোনোদিন রান্নাঘরে যেতেই দিইনি। মেয়েটা তোমাদের ওখানে হাঁড়ি ঠেলতে গেছে নাকি বাবা? তোমার মা-বাবার তো গায়ে শক্তি যথেষ্ট আছে। তারা তো নিজেরটা নিজেই করতে পারে। ওকে সব সময় বিরক্ত করা সাজে না। তুমি তো এসব বলতেও পারো তোমার মা-বাবাকে। এখন সংসার করতে গেলে তোমার মেরুদণ্ডটা একটু শক্ত করতে হবে যে! এত নরম মেরুদণ্ড নিয়ে সংসারে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। তোমার শ্বশুরকে দেখে শেখো। বিয়ের প্রথম মাসেই আমাকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে।’

আমি কিছু বলি না। নতুন জামাই। শুধু খাওয়া বন্ধ রেখে উঠে পড়ি। শাশুড়ি খাওয়া বন্ধ রেখে উঠে যাওয়া দেখে জানতে চান, ‘কী হলো বাবা, খাবে না?’ আমি সলজ্জভাবে বলি, ‘আগে মেরুদণ্ড সোজা করি, তারপর খাবো?’ শাশুড়ি বেশ খুশি হন, তা তার মুখের ভাবখানা দেখলেই বোঝা যায়।

কিছুক্ষণ পর যখন তার মেয়েকে না নিয়েই আমি ব্যাগ গুছিয়ে চলে আসতে উদ্যত হই; তখন জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী ব্যাপার বাবা, তুমি একা যাচ্ছো যে! আমার মেয়েকে নেবে না?’ আমি শুধু বলি, ‘যেদিন আমার মেরুদণ্ড সোজা হবে; সেদিন নিতে আসবো।’

****

সংসার

রাহেলা বেগম বাইরের ঘরে সমানে চ্যাঁচাচ্ছেন। আফসার আলী নিশ্চিত যে, কথাগুলো অনায়াসে পাশের ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে। এতে আফসার সাহেবের এখন আর কিছু যায়-আসে না! বিয়ের পর থেকেই তিনি রাহেলার এমন আচরণ দেখে আসছেন। তিনি বিচলিত না হয়ে টেবিলে রাখা আজকের দৈনিকে মনোযোগ দিলেন। প্রথম পৃষ্ঠায় একপাশে বাজারের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবেদন লেখা হয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো তার স্ত্রী রাহেলা বেগমের এ ধরনের খবর কোনোদিনও চোখে পড়েনি। আজও পড়বে না।

ছোটখাটো একটা সরকারি চাকরি করে তিনি সংসার টেনে যাচ্ছেন। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোনোভাবে দিন কেটে যায়। বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে চললেও তার আয় সেভাবে বাড়ে না। তিনি চাকরির পর টুকটাক এটা-সেটা করেও কিছু উপার্জন করেন। তাতেও সংসারের টানাপোড়েন যায় না। কারণ খরচ তো বেড়েই যায়। এর মধ্যে কিছু সঞ্চয়ও করতে হয়। ছেলে-মেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ তো গড়তে হবে। সেই চিন্তায় দিন-রাত ব্যস্ত থাকেন। তার স্ত্রীর এসব দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তার ধারণা আফসার আলী লোকটা বড় ধরনের কিপটে। হাত দিয়ে জল গলে না! প্রায়ই তিনি স্বামীকে প্রশ্ন করেন, ‘এত টাকা উপার্জন করে তুমি কী করো?’ এ প্রশ্নের উত্তর তিনি তার স্বামীর কাছ থেকে কোনোদিনও পাননি। খাবার টেবিলে তিনি স্বামীকে বললেন, ‘এত টাকা উপার্জন করে কী করো বলো তো? পাশের বাড়ির ফরিদ সাহেবও তো তোমার সাথেই চাকরি করেন। অথচ দ্যাখো তিনি তিন তলা একটা বাড়িও করে ফেলেছেন। আর আমরা থাকছি টিনের ঘরে।’

ফরিদ সাহেব আফসার আলীর সাথেই চাকরি করেন। ঘুস ছাড়া একটা কাজও করেন না। এ কথা তার স্ত্রী বোঝেন না। ঘুস বিষয়টা তার স্ত্রীর কাছে ব্যাপার না। তিনিও মাঝেমধ্যে হিসাবটা মেলাতে পারেন না। এ জীবনে সত্যিই কি তিনি কিছু করতে পেরেছেন তার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য? এর বছরখানেকের মধ্যে আফসার সাহেব সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মারা যাওয়ার পর রাহেলা বেগম তার স্বামীর চাকরির টাকা ছাড়াও দশ লাখ টাকার একটি বীমার টাকা পান। দুই সন্তানের নামে ব্যাংকে আরও কয়েক লাখ টাকা ছিল, যার নমিনি তিনি। অথচ রাহেলা বেগম কোনোদিন বুঝতেও পারেননি। তিনি তার স্বামীকে বোঝার চেষ্টাও করেননি।

****

কঙ্কাল

রাত তিনটা। দুজন কবরস্থানের পাশে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তাদের কারো বাড়িই এ গ্রামে নয়। তারা সুযোগের অপেক্ষা করছে। ওরা দুজনই চোর। কঙ্কাল চোর। আজ রাতেই মজিদের কঙ্কালটা চুরি করতে হবে।

যে দুজন বসে আছে, তারা হলো সালেক ও ফরিদ। তারা যে মানুষটির কঙ্কাল চুরি করতে এসেছে, তার নাম মজিদ। সালেক, ফরিদ আর মজিদ ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওরা তিনজন একসাথেই কঙ্কাল চুরি করেছে এতদিন। হঠাৎ মজিদটা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলো। ওর যে হার্টের অবস্থা যা-তা, সেটা জানতো না। জেনেই বা কী হবে! করেছে তো কঙ্কাল চুরি। কঙ্কালের হার্টের অবস্থা ঠিকঠাক বলে দিতে পারতো।

আশেপাশের গ্রামের যত কঙ্কাল চুরি হয়েছে, এ তিনজনই সেটা করেছে। আজ মজিদের কঙ্কাল চুরি করার জন্য ওর বাকি দুই বন্ধু বসে আছে। মজিদের কঙ্কাল বেচেও বেশ টাকা পাওয়া যাবে। রাত আরেকটু গভীর হলে ওরা মজিদের কবরের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।