ঝরনাকলম বৃত্তান্ত

কলমটা বাবার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে লোকটি বললেন, ‘কলমে কখনও ব্লেড মারবেন না। তা’লি আর কলম ঠিক থাকপে না।’
বাবা তখন লোকটির এগিয়ে দেওয়া কয়েক টুকরো সাদা কাগজের ওপরে কলমটার দাগ পরীক্ষা করে নিচ্ছেন। তার আগে সারাইকার পরীক্ষা করেছেন। দেখলে বোঝা যায় কলমটা দামি। পাইলট কোম্পানির। দেখতেও বেশ। ক্লিপ লাগলে আকৃতিতে বড়ো, খুলে মুখে আটকালে তখন কলমটা ছোটো। সে ক্লিপে কিছু লতাপাতা মতন আঁকা। কলমের গায়ের রঙ সাদা, নিবটা বেশ বের হয়ে আছে। নিবের পিছন পর্যন্ত আটকানো, একেবারে শেষ মাথায় একটি ছিদ্র, সেখান থেকে নিবে কালি আসে।
বাবা কলমটা পরীক্ষা করে নিতে না-নিতেই দেখি লোকটি বাবাকে এইমাত্র বলা কথাটা আর রাখলেন কই? তার হাতে অন্য একটি কলম, হিরো কিংবা উইং সান। সেটির একটুখানি বের হয়ে থাকা নিবটা খুব চোখের একেবারে সামনে ধরে কীসব পরীক্ষা করে নির্বিকার ধীর হাতে ওই নিবের ভিতরে ব্লেড চালাচ্ছেন। নিবের মাথা থেকে ভাঙা ব্লেডখানা ভরলেন, বের করলেন। নিবে বামহাতের তর্জনীর কেমন যেন চাপও দিলেন। তারপর কাগজে দাগ দিয়ে পরীক্ষা করলেন কেমন দাগ পড়ে। ব্যস্, শিখে গেলাম। তার মানে এইভাবে ব্লেড চালালে কলমের দাগ ভালো হয়, কলমে একটু মোটা দাগ পড়ে! নিবের ভিতর গাদ্ জমলে তা পরিষ্কার হয়?
ঝরনাকলম বা ফাউন্টেন পেন নিয়ে বিলাসিতা বলি আর আদিখ্যেতা বলি অথবা প্রয়োজনীয়তা- এসবের দিন প্রায় তখন শেষের দিকে। শহরে তখন একজন কি দুজন মানুষ ঝরনাকলম সারাইয়ের কাজ করেন। তাদের ভিতরে আবার একজন একটু বেশি ওস্তাদ, তাদের কাছে সবাই যায়। অথচ একদিন এই কলম সারাইয়ের মানুষদের ওপর অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের ছিল কত নির্ভরতা, শিক্ষার্থীকুলের কত প্রায় অকেজো কলমকে তাঁরা মানুষ করেছেন, দুটো কলমের মালমশলা জোড়া লাগিয়ে পরিণত করেছেন একটি কলমে । লাল কালিতে ছাত্রের খাতায় টিক দিতে দিতে নিবকে প্রায় ভোঁতা বানিয়ে ফেলা শিক্ষকের কম দামি কলমটাতে লাগিয়ে দিয়েছেন নতুন নিব। আর নগরে-মহানগরে প্রতিষ্ঠিত কি সাহিত্যযশঃপ্রার্থী লেখকের কলমকে সচল রেখেছেন নিষ্ঠ তৎপরতায়।
বুদ্ধদেব বসুর কনিষ্ঠা কন্যা দময়ন্তী বসু সিং বাবার মৃত্যুর পরে তাঁর কলমগুলোকে নিয়ে লিখেছেন, এগুলো এখন অবসরপ্রাপ্ত। সেগুলো সবই শেফার্স। জানাচ্ছেন, পুরনো কলকাতার এক কলম মেরামতকারি করতেন এগুলোর সার্ভিসিঙের কাজ। ঝরনাকলমের সেই স্বর্ণযুগ নিয়ে সাহিত্যিকরা প্রায় প্রত্যেকেই আত্মজীবনী কী স্মৃতিকথায় লিখেছেন দুই-এক ছত্র। এমনকি সেখানে কলমের এই ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার সাহেবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথাও বাদ যায়নি।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যতিরিশে এক ছাত্রকে কিছুদিন পড়িয়ে পেয়েছিলেন একশ টাকা, তাই দিয়ে কিনেছিলেন জীবনের প্রথম শেফার্স। তখন একটি গল্প লিখে পান দশ কি পনের টাকা, মাসে ছাপা হয় তিনটি। সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা তখন বেশ দূরে। পরে প্রতি বছর কিনতেন একটি নতুন শেফার্স। প্রথম কালি ভরে প্রথমেই লিখতেন নিজের নাম, তারাশঙ্কর।
কলম-পেষা মজুর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখতেন কম দামি কলমে সুলেখা কালিতে। সে কালির বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথও নাকি সুলেখার কালির বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছিলেন। যুদ্ধের বাজারে একটি ভালো কলমের অভাবে ভুগেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তরুণলেখক রশীদ করীম তাঁর এক আত্মীয় মারফত মুজতবার জন্যে একটি দামি শেফার্সের ব্যবস্থা করেন। সাহিত্যিক জীবনের প্রথম দিকে যখন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছেন সমরেশ বসু, লিখতেন কেনা নিবে, বড়িকালিতে চুবিয়ে চুবিয়ে। কাগজও তাঁর কাছে দুর্মূল্য, হাতের অক্ষর সেই থেকে গেছে ছোটো হয়ে। কিছুদিন বাদে উত্তরঙ্গ, বিটি রোডের ধারে লিখে নাম করতেই সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্ত ওরফে ডি. কে. এই লেখককে সোনার কলম পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করেছিলেন।। কিছুদিন বাদেই সমরেশ বসুর হাতে ভালো ঝরনাকলম।
সাহিত্য যাদের কাছে জীবিকা, কলম তাঁদের কাছে অতি মূল্যবান সন্দেহ নেই। আজকের কম্পিউটার কি বলপেনের জায়গা দখলের আগে ঝরনাকলম তাই সেই সমাজে অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেছিল। ষাটের দশকে, সৈয়দ শামসুল হক তখনও টাইপরাইটারে অভ্যস্ত নন অথবা মুনীর চৌধুরী মারফত তা তার হাতে আসেনি একটি সেই সময় একজন নারী সাহিত্যিক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কী কলম দিয়ে লেখেন? শুনে, শামসুর রাহমান বলেছিলেন, শামসুল হক, জানিয়ে দিন আপনি কোন পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজেন! এই বছরখানেক আগেও, ঘাড়ে ল্যাপটপসহ সৈয়দ শামসুল হকের পকেটে দেখেছি এক সেট দামি পার্কার। একটি ফাউন্টেন পেন, একটি বলপয়েন্ট, আর একটি লিড পেনসিল। কিন্তু ফাউন্টেন পেন ব্যবহার কমে যাওয়া নিয়ে, বলপয়েন্টের জায়গা দখল নিয়ে তিনি বলপয়েন্টকে সম্বোধন করেছেন, সেদিনের ছোকরা। আজ কম্পিউটারের বোতাম সে ছোকরাকে প্রায় হঠায়।
হাসান আজিজুল হক শেফার্সের ঝরনাকলম পছন্দ করেন। সরু নিবের শেফার্সে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে লিখেছেন ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। লন্ডন গেলে কিনেছেন শেফার্সের রিফিল। এখনও ঝরনাকলমেই লেখেন, পরিমার্জন করেন বলপয়েন্টে; কিন্তু আপসোসের সঙ্গে কলম সারাইকার আর ভালো কালির অভাবের কথা বলেন।
কায়েস আহমেদের পাঞ্জাবির বুকপকেটে দেখেছি হিরো ফাউন্টেন পেন। লিখতেন কালো রঙের ইয়ুথ কালিতে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ক্লাসে রোলকল করতেন একটি মোটা লাল রঙের ফাউন্টেন পেনে। দেখতে এক সময়ে ট্রেনে ক্যানভাসারের হাতের বেলা কলমের মতো। (বেলা কলম বিক্রেতা তার কলমের গুণাগুণ বলতে বলতে সেটিকে ছুঁড়ে মারতেন ব্রডগেজ লাইনের বগির কামরায় ঢোকার দরজার উপরে যেখানে ৬০ বসিবেন লেখা, সেখানটায়। কলমটা অক্ষত ফিরে আসত।) সর্বাঙ্গ লাল, ক্লিপটা পাটল রঙের। এটা নাকি পুরনো ঢাকার এক কলমের কারিকর তৈরি করে দিয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে কলম প্রসঙ্গে জানিয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যমুনার তীরে এক ডাকঘরে একজনের কাছ থেকে একটি কলম চেয়ে ঠিকানা লিখতেই, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন লোকটি নেই। সেই কলমটি বহুকাল তাঁর পকেটে ছিল। পুরনো ঢাকার সেই কারিকর নিব বদলে দিতেন। কালিরও নাকি খোঁজ দিতেন সেই কলমের ডাক্তার। কোনও এক দোকানের বড়ি পানিতে চুবালে অসাধারণ মিশমিশে কালো কালি হত। সেই কালিতেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে ছাত্র হিসেবে তাকে দেখেছি একানব্বইয়ের একেবারে শুরুতে আমাদের নাম রোল ঠিকানা লিখতে, একটি ছোটো চিরকুটও, প্রয়োজনে।
ক্লাসে রোলকলের প্রয়োজনবোধ করতেন না হায়াৎ মামুদ। তাঁর কাঁধের ব্যাগের ভিতরে ছোট্ট পেনব্যাগে থাকত অনেকগুলো ভালো বলপয়েন্ট আর তখন সদ্য বাজারে আসা জেল পেন। টিউটোরিয়াল দেখতেন সেখান থেকে লাল অথবা সবুজ কালির কলমটা বের করে। লিখতেন কালো কালির গুলোয়।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে তাঁর পকেটেও দেখেছি একটি নীল রঙের পার্কার ফাউন্টেন পেন। শিক্ষকদের ভিতরে তাঁর কাছে ছাড়া এরপর আর দেখিনি ঝরনাকলম। খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের এই কলমবিলাস এখন প্রায় অকল্পনীয়। এর কয়েকটি ঘটনা বইয়ে পড়া, কিছু দেখা। এই বিলাসের সঙ্গে ঝরনাকলম সারাইকার বা ডাক্তার মহাশয়ও যুক্ত ছিলেন। তিনি এর ভিতরে থেকেও বাইরে। আমার কাছে, এক অর্থে সারাইকার তো সেই কৈশোরে দেখা লোকটি। তার নিষেধ না-শুনে পরে নিজের দুই-একটি কলমের সর্বনাশও করেছি। ব্লেড মারলে শুরুতে ভালো দাগ পড়ে ঠিকই, পরে কলম গোল্লায় যায়। সে-কথা কলমগুলোর অকাল প্রয়াণে বাসি হয়ে ফলেছে। তবে, সেই সারাইকারেরা বিলুপ্তির পর যে দু-একজন থাকলেন অথবা অন্য কাজের সঙ্গে এটাওকেও যুক্ত করে নিলেন, তাঁরা আর আগের সেইসব সারাইঅলার মতো দক্ষ ছিলেন না। দক্ষতা কাজের ওপর নির্ভরশীল, হাতে কালেভাদ্রে ঝরনাকলম এলে কাজে দক্ষতা আসবে কোত্থেকে? আর, আজ বোধ হয় কাউকে পাওয়াই যাবে না।
একদিন জাহিদ হায়দারের পকেটে দেখলাম একটি ফাউন্টেন পেন। মোটা, কালো, প্যাঁচ দিয়ে আটকায় ও খোলে। বের করে কাগজে নাম লিখলেন। ভিতরে প্যালিক্যান ব্ল্যাক কালি, জাহিদ ভাইয়ের রাবীন্দ্রিক হস্তাক্ষর, কিছু-একটা লিখতেই আমি বিস্মিত। কলমটায় লেখা হয় দারুণ! জাহিদ হায়দার আমার চোখ দেখলেন, ‘চাই নাকি একটা? সেনেটর। জার্মানির। টোমাস মান লিখতেন এই কলমে। দাউদ পাঠিয়েছে।’ আমি কিছু জানানোর আগেই তিনি বললেন, ‘দাউদকে বলব, এক গল্পলেখক কাহিনি এগিয়ে নিতে পারছেন না একটি সেনেটরের অভাবে, তাড়াতাড়ি আর একটি পাঠাও।’
কিছুদিন বাদে জাহিদ হায়দার বাসায় যেতে বললেন। তারপর কালি ভরে, লিখে পরীক্ষা করে, দিলেন নতুন একটি সেনেটর। লেখে অসাধারণ। কিন্তু তখন তো আমি বলপয়েন্টও প্রায় ছেড়েছি। কম্পিউটারে বোতাম টিপে লেখার কাজ চালাই। এ সময়ে এই কলম? একটি ভালো কলম পরিচর্যা চায়। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকালীন আমার একটি পেটমোটা দেখতে সুন্দর নীলাভ শেফার্স ছিল। সেটি কিছুদিন ফেলে রাখলেই গোসা করত। ভিতরে কালি জমে যেত। তখন ধুতেটুতে বেশ কষ্টই! কিন্তু নতুন কলম এই সেনেটর, জাহিদ হায়দারের উপহার। মাঝে-মধ্যে লিখব এই শপথে নেয়া, নিজে নিজে ঠিক করি ঠিকঠাক যত্নও নেব।
প্যালিক্যান কালি ভরে দুই-একদিন ব্যবহারও করেছি। পর পর কয়েকদিন অব্যবহৃত থাকলে তারপর ধুয়েও রেখেছি সে-কলম। কিন্তু সবসময় তো সে খেয়ালও থাকে না। ফলে, কালি জমে যেত কলমের ভিতরে। এক সময় হয়তো নিবে গাদও পড়ে গিয়েছিল। কালিটা কলমের পছন্দ না-হলে এটা হয়, অথবা ভিতরে কালির স্তর পড়ে গেলেও। তা-ই হলো এই সেনেটর কলমটির ক্ষেত্রে।
এখন উপায়? কী বনেদি চেহারার কলম! সাবেকি কায়দার। নিজে ঈষদুষ্ণ পানিতে ধুই। কাজ হয় না। কয়েকদিন নিউ মার্কেট এলাকায় ঘুরি। কয়েকটি ফাউন্টেন পেন বিক্রেতার দোকানে দেখাই। তারা নিউ মার্কেট-গাউসিয়া ব্রিজের নীচে একজনের কাছে যেতে বলেন। সেখানে দেখাই। মনে মনে ভরসা পাই, হয়তো এই লোক ভালো করে দেবেন কলমটাকে। যোগ্য ডাক্তার কলমের। তখন সেই কৈশোরের কলম সারাইকারের মুখ মনে পড়ে। যদি তাকে পাওয়া যেত নিশ্চিত ভালো করে দিতেন এই কলম।
এই লোকটিও চেষ্টা করলেন। খুলে, নিবের ভিতরের দিকে ধুয়ে লোহার একটি সরু কাঠিমতন ভরে দিয়ে ঘোরালেন, ধুলেন। তারপর আরও কীসব করে দিয়ে দিলেন। সঙ্গে দিলেন কালি-সংক্রান্ত উপদেশ। সব মানলাম। কিন্তু কাজ হলো না। কিছুদিন পরে যেই সেই। আবার তার কাছে যাই। এবার লোকটি পুরান ঢাকায় একজনের কাছে, এক জায়গায় যেতে বলেন। গিয়েছিলাম সেখানে। তাকে পাওয়া যায়নি। এই কাজ এখন আর করেন না। পাশের একজন বলল, এখন একবিংশ শতক, বুঝলেন না, এখন ফাউন্টেন পেন কেউ ব্যবহার করে?
সত্যি, সেই ২০০১ সালকে সেই মুহূর্তে বড়ো দুঃসময় মনে হলো। মনে হল ভুল সময়ে ভুল জিনিসের খোঁজে এসেছি। সেদিন সেই কলমটা সযত্নে পকেটে ভরে নিয়ে এসেছি। আর মনে মনে খুঁজছি সত্যিকার ঝরনাকলম সারাইকার একজন মানুষ। কলমের উপযুক্ত ডাক্তার-বদ্যি! কিন্তু ততদিনে তারা প্রায় বিলুপ্ত। আজ তো নেই-ই। ঝরনাকলমের ব্যবহার না-থাকলে, তা সারাইয়ের পেশা থাকে? তবু, এখন ফাউন্টেন পেন হাতে নিলে মনে হয়, এর নিবে ব্লেড মারতে নেই। আর, ব্লেড যারা মারবে তারাও আর এ পেশায় নেই!
দুই.
স্কুল পড়ুয়া কয়েকটি কিশোর লোকটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। এর ভিতরে লোকটির মাথা। লোকটি বসেছেন একটি ছোটো টুলে, কিশোররা উচ্চতায় প্রায় তার বসে থাকা মাথার সমান। অর্থাৎ, লোকটি বেশ লম্বাই। ছোট্ট সে টুলে বসে, কোলের ওপর একটা ছোটো কাঠের তক্তা রেখে একমনে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কাজের ফাঁকে একবার একবার মাথা তুললে মনে হয় যেন, অনেকগুলো ছাঁটা চুলের কিশোরের মাথার ভিতর থেকে একটি বয়েসি একটু লম্বা চুলের মাথা কিছুক্ষণ বাদে বাদে ভেসে উঠছে!
লোকটি ঘড়ির চেইন আর কলমে নাম লেখেন। আর নেইম প্লেটেও। স্কুলের ইউনিফর্মের (জামার) বাঁ পাশের পকেটের ওপর লাগানো যায় সেই নেইম প্লেট। অবশ্য নেইম প্লেটগুলো তার কাছে বানানোই থাকে, শুধু একটি কাগজে নাম লিখে সেটি তার দিকে বাড়িয়ে দিলে কিছুক্ষণের ভিতরে সেই নামটি ওখানে লেখা হয়ে যায়। এমনকি ঘড়ির চেইনে কিংবা কলমের ওপরেও। তবে নেইম প্লেটে নাম লেখানোর যন্ত্র বা অস্ত্র আর ঘড়ি বা কলমে লেখার অস্ত্রে কিছু তফাৎ আছে। খুব কাছ থেকে ওই যন্ত্রগুলো না দেখলে বোঝা যায় না। এটা এক ধরনের বাটালি। মাথার দিকে খুব সরু, সেটা দিয়ে কলমের গায়ে নাম খোদাই করেন তিনি। হয়তো একটু ভোঁতাও, অন্তত যেটি দিয়ে ঘড়ির চেইনে নাম লেখেন সেটির তুলনায়। আর, নেইম প্লেটে যেটি দিয়ে লেখেন সেটির মাথা অপেক্ষাকৃত চওড়া। দেখতে সরু কলমের মতো। প্রায় বলপেন সদৃশ। এর পিছনে হাতুড়ি দিয়ে ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে চলে এই নাম খোদাইয়ের কাজ। হাতুড়িরও আকৃতিতে তফাৎ আছে। চেইন বা কলমে খোদাইয়ের জন্যে এক ধরনের হাতুড়ি, নেইম প্লেটে লেখার সময় অন্য ধরনের। একটু বড়ো সে হাতুড়ি। কিন্তু কী আর বড়ো? তবলা আর বাঁয়ার গায়ে হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করে নেন যে তবলচি, তার হাতে থাকে যে হাতুড়ি, তার চেয়ে এই হাতুড়ি ছোটোই।
স্কুলের ছেলেরা ঘিরে ধরে আছে লোকটিকে। চোখ বড়ো করে অপার বিস্ময়ে তারা দেখছে, তাদের কারও শখের ফাউনটেন পেনের গায়ে লোকটি লিখে দিচ্ছেন নামটি। হাতে তো কারোই ঘড়ি নেই, ঘড়ি এসএসসি পাসের আগে হাতে দেয়ার তেমন সুযোগও নেই। ট্রেজারি, জেলখানা আর ফায়ার ব্রিগেডের ঘড়িই বেশির ভাগ সময় জানান দেয় সময়। বাড়িতে দেয়ালঘড়ি দেখার প্রয়োজন পড়ে না এ জন্যে। আর স্কুলে প্রতিটি পিরিয়ড তো জানিয়ে দিচ্ছে সময় এখন কত। আর স্কুলের কাছে থেকে চলা ট্রেন তো আছেই।
এই লোকটি এসেছেন স্কুল শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে। স্কুল শুরু হবে সাড়ে দশটায়। তার আগে এসেম্বলি অর্থাৎ সমাবেশ। পিটি স্যার বাঁশি বাজালেই প্রায় সবাই এক কাতারে দাঁড়াবে সে সমাবেশে। এই সময়টুকুতেই দেখে নেওয়া যে একজন মানুষ কী নিপুণভঙ্গিতে একেকটি কলমে লিখছেন কারও কারও নাম। ওপরের ক্লাসের বেশির ভাগের পকেটে তখন বল পয়েন্ট। মুখে মুখে তার নামÑ শিস কলাম। দেখতে সরু রেডলিফ, ইকোনোর বিপ্লব তখন ঘটেনি। ফলে, লোকটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ইস্কুলের মাঝখানের ক্লাসের ছেলেরাই। রেডলিফের মতো বল পেনে তো আর নাম লেখানো যায় না, তাদের এখন আর তেমন কলম হারিয়ে ফেলার বয়েসও নেই, নেই সে সাধও। নিজের একটি ভালো কলম হয়তো তাদের কাছে আছে, তা এখন আর কোনও প্রাপ্তিও নয়। কত কত পৃষ্ঠা অঙ্ক করতে হয় তাদের প্রতিদিন, সেখানে ওই ফাউনটেন পেন সত্যি অচল। আর হাতের লেখাটেখার বিষয়ও সে সব ক্লাসে নেই। ফাউন্টেন পেনে নাম লেখানো বিষয়টি ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের কাছে সত্যি কোনও আগ্রহের বিষয়ও নয়। তবে, তাদের কারও হাতে যদি ঘড়ি থাকে, তাহলে তার কোনওটির চেইনেও তারা সেখানে দাঁড়িয়ে নাম লেখায়নি। তাদের জানা পরিচয়ের গণ্ডি ইতিমধ্যে বেশ বেড়েছে, যদি সে ইচ্ছে তাদের কখনও হয়, তাহলে চলে যাবে কোর্টের সামনে। আর নেইম প্লেট? ধুস্, সেই বয়েস তাদের আছে? স্কুলের ইউনিফর্মই তারা আর আজকাল পরে আসতে চায় না, তা নিয়ে হেডস্যার কখনও কখনও এসেম্বলিতে তাদের পিঠে বেত ভাঙেন। স্কুলের ছোটোক্লাসের ছেলেরা পরম বিস্ময়ে তাই দেখে, মাস্তান হিসেবে প্রবল খ্যাতিমান ওমুক বড়োভাই, যিনি সেদিন হাফশার্টের হাতা গুটিয়ে হাতের মাসেল্ দেখাচ্ছিলেন ক্লাস নাইনের কয়েকজনকে, আড়াআড়ি রাস্তায় ছোটো একটা দৌড় দিয়ে অত বড়ো একটা খালের মতন পগার ডিঙিয়ে একলাফে গিয়ে পড়েন স্কুলের বড়ো মাঠে, সেই বড়োভাইয়ের পিঠে হালকাপাতলা হেডস্যার বেতখানা প্রায় ভেঙেই ফেলছেন, আর সে মাথাটা কেমন নিচু করে এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ওই তাদের পকেটে শোভা পাবে নেইম প্লেট, তা কী করে হয়?
লোকটাও হয়তো তা জানেন না। ক্ষণে ক্ষণে মাথা তুলে চারধার দেখেন। দেখেন মূলত প্রত্যেকের জামার পকেট। দেখেন সেখানে কার কী কলম। যার পকেটে সোনালি ক্যাপ উঁকি মারছে, সেখানে উইং সান; আর পকেটে সাদা স্টিলের ক্যাপ- সেটা সরু মাথার হয় তো তাহলে ওটা ইয়ুথ, আর যেটার মাথা সরু নয়, ভিতরে একটু ঢোকানো, সেটি হিরো। এই হল কলমের ব্রান্ড। একজন দুজনের কলম হয়তো অন্য। তাও পাইলটের বাইরে অন্য কিছু নয়। পাইলটের ভিতরে ভি-পাইলট তখন বনেদি। ফাইভ-সিক্স-সেভেন কি এইটের ছাত্রের হাতে কি পকেটে তা হয়তো কালেভদ্রে শোভা পেত, যদি অভিভাবকরা সেটি স্কুলে আনার অনুমোদন দিত অথবা সে আনত লুকিয়ে। সে কলম কেউ বের করে দিলে লোকটি তাতে হয়তো নাম লিখতেও চাইত না। অথবা সেটি কখনওই নাম লেখার জন্যে বের করে দিত না সে।
নেইম প্লেট, কলম আর ঘড়িতে নাম লেখার সেই লোকটির কাছে ক্লাস বসার এই আগ দিয়ে নেইম প্লেটে নাম তেমন কেউ লেখায়নি। কিন্তু কলমে নাম সেদিন কেউ কেউ লিখিয়েছিল। এক ক্লাস ওপরের একজন পকেট থেকে বের করে দিল তার ইয়ুথ কলমটি। লোকটি জানতে চাইল টাইপ কেমন হবে। তার কিছু নমুনাও আছে তার কাছে। একটা প্লাস্টিক প্লেটে লেখা অনেকগুলো নাম, বাংলায় ও ইংরেজিতে। আছে জাতীয় সংগীতের একটি পঙক্তি। ‘আমার দেশের নাম বাংলাদেশ’ কি ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ এমন কোনও বাক্য। এর থেকে কোনও একটি ছাঁচ তিনি দেখিয়ে দিলেন। সেইমতো, দেখলাম ছোট্টো খুব ছোট্ট একটা স্ক্রু ড্রাইভারের অথবা সরু পেন্সিলের মতো যন্ত্রটি কলমের গায়ে ঠুকে ঠুকে কিছুক্ষণের ভিতর লিখে ফেললেন এক ক্লাস ওপরের সেই ছাত্রটির নাম। সোজা সোজা টানা হরফ, ইংরেজিতে ছাপানো অক্ষর যেমন হয়। লেখা শেষ হতেই পাশের বাক্সটি থেকে এক টুকরো কাপড় বের করে কলমটা মুছে ওই লেখার ওপর বুলিয়ে দিলেন চকের গুঁড়ো। তারপর আবার ভালো করে মুছলেন, লেখাগুলো বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল, একেবারে স্পষ্ট। তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। এ যেন এক ধরনের ভেল্কি। খাতায়ই আমাদের হাতের লেখা তেমন সুন্দর হয় না, আর এখানে, ওই ছোট্ট যন্ত্রটা দিয়ে কলমের গায়ে দেখো এই মানুষটা কী অসাধারণ সুন্দর করে লিখে ফেললেন একটি নাম! এই কাজের পারিশ্রমিক মাত্র দু-টাকা। যদিও তখন দু-টাকা কোনওভাবেই মাত্র নয়। দু-টাকা সব সময় পকেটেও থাকে না।
ছোটো এক ঠোঙা ঘুগনি আট আনা, পঞ্চাশ পয়সা। সকালে খেলে অনেকক্ষণ পেটে থাকত। কেউ কেউ, খুব যারা খেতে পারে তারা দু-ঠোঙা খেতে পারত, এর বেশি নয়, খেতও না। সেখানে কলমে নাম লেখানোর জন্যে দু-টাকা! কী দরকার। অথবা এই কলমটা পুরনো হয়ে গেছে এটায় নাম লেখানোর দরকারই বা কী? অথবা এই কলমটা একজনকে তার ছোটো কাকা জাপান থেকে পাঠিয়েছে, সেটায় নাম লেখানো ঠিক হবে কি না নিজের কাছে সেই প্রশ্নটি কোনওভাবে তল পাচ্ছে না। এর ফলে লোকটা হয়তো আশপাশে কারও কারও মুখে তাকানোর সুযোগ পায়। একজন একটু আগে চার কি পাঁচ টাকায় একটি নেইম প্লেট লিখিয়ে নিয়েছে। স্কাউটের খাকি ড্রেসের ওপর পরবে। কালো নেইম প্লেট, মানাবে ভালো! বাংলায় লিখলে পাঁচ টাকা, ইংরেজি তো চার টাকা অথবা নামটা কতগুলো অক্ষরে সেসব আলাদা আলাদা হিসেবে।
নিজের পকেটের সবুজাভ উইং সান কলমটা বাড়িয়ে দিই। কলমের গায়ে বাংলা হয়তো ভালো ফোটে না। লোকটা শুধু ইংরেজি অক্ষরের নমুনা দেখাল। আমার বন্ধু একটা ছাঁচ পছন্দ করে দিতেই তারপর নামটা কাগজে লিখে তার হাতে দিতেই শুরু হয়ে গেল লেখা। কিছুক্ষণের ভিতরে ওই কলমটির গায়ে আমার নাম। একেবারে প্যাঁচানো ধরন, ব্রিটিশ ইংরেজি স্মল লেটার যেমন হয়, সেভাবে। এখনও মনে আছে, নামের ‘পি’ ইংরেজি বর্ণটি প্রায় ছাতার মতন ডান দিকে হেলে ফুলে আছে। ‘টি’ অক্ষরটা সত্যিই একটি গাছ। লেখা শেষ। ওই কাপড় দিয়ে কলমটা মোছা চলল, দুই ঘষা, তারপর থেকে লেখার গায়ে তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চকের গুঁড়ো ডললেন। নিজের নামটি খুব পরিষ্কার। হাতে দিয়ে বললেন মাঝে মাঝে একটু চকের গুঁড়ো দিয়ে নামের জায়গাটা ডলে দিতে, তাহলে নামটা স্পষ্ট থাকবে। তখন লক্ষ করেছি, আজও মনে আছে, সব নামই লেখা হত কলমের ডান দিকে। অর্থাৎ ঝরনাকলমের সামনের দিক থেকে ডান দিকে, আর প্রতিটি নামই লেখা হয় কলমের সামনের দিক থেকে পিছন দিকে।
কিন্তু আমার কলমে লোকটা নাম লিখেছে কি লেখেনি, সেটা বিষয় নয়, যারা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, এমনকি আমি ও আমার ক্লাসের কয়েকজন, প্রত্যেকেই দাঁড়িয়ে আছি তার লেখার জাদুকরী গুণটি দেখার জন্যে। এবং এক একটি নাম তো আলাদা, তাতে একই অক্ষর কয়েকটি থাকলেও বেশির ভাগই তো আলাদা আলাদা, ভিন্ন ভিন্ন, তাই সেই প্রতিটি অক্ষর কী অসাধারণ ক্ষমতায় একই রকম ভাবে লিখছেন তিনি।
এই সময় স্কুলে ফার্স্ট ওয়ার্নিং বেল পড়ল। এখনই এসেম্বলির জন্যে পিটি স্যার বাঁশি বাজাবেন। লোকটি তা জানে। যে কলমটির কাজে হাত দিলেন, হয়তো সেই ছাত্রটি আর তার একআধজন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি হাতের কাজ শেষ করলেন। কলম দিলেন। টাকা পকেটে নিলেন। দপ্তরির কাছ থেকে চেয়ে যে টুলটা এনেছিলেন সেটি যথাস্থানে রাখেন। এরই মধ্যে নিজের বাক্স আর ছোট্ট ব্যাগটি গোছানো হয়ে গেছে।
স্কুলের এই দিকে রেললাইন। রেললাইন বেয়ে শহরের দিকে হেঁটে যাবেন। বেশ লম্বা, সকালে স্নান করে পরিপাটি করে চুল আঁচড়েছেন। গায়ে ফুল হাতার সাদা শার্ট, ফুলপ্যান্ট পরনে, পায়ে চামড়ার চটি। তার দিকে তাকিয়ে দেখছি। আমাদের শহরে লোকটিকে আগে-পাছে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তখন স্কুলের দিকে ঢুকতে ঢুকতে এক বড়ো ভাই বলল, এহোন কোর্টের দিক যাইয়ে বসপে। সেহানে ঘড়িও আছে, কলমও আছে।
লোকটির সেই চলে যাওয়া মনে আছে। কলমে নাম লিখে কি কলম হারানো বা চুরি ঠেকানো যায়? কিন্তু একবার যে নিজের নামটি লিখিয়েছিলাম, তা মনে আছে। মনে আছে সেই লেখার ছাঁচও। মনে থাকবে। এখন তো চাইলেও এই মানুষদের পাওয়া যাবে না। ফাউন্টেন পেন বা ঝরনাকলমের জায়গা কত আগেই নিয়েছে বলপয়েন্ট। এখন বলপয়েন্টের প্রয়োজনও যেন পরীক্ষার উত্তর লিখতে, বাকি কাজ কম্পিউটারের বোতাম টিপে। আর ঘড়ির চেইনে আজকাল কে নাম লেখে? মোবাইল কি মুঠোফোনের কল্যাণে সেও কমেছে। প্লাস্টিকের নেইম প্লেট দেখাই যায় না, স্ক্রিন প্রিন্ট সেখানে জায়গা নিয়েছে।
ফলে, কলমে কি ঘড়ি বা চেইনে যে নাম লেখা হত, তেমন একটি-দুটি নমুনা পাওয়া গেলে সেটাই দর্শনীয়, লোকটিকে তো আর পাওয়া যাবে না।
এইচআর/আরআইপি