ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ক্যাম্পাস

জবির জন্ম থেকেই তীব্র আবাসন সংকট, অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা

ইয়াসির আরাফাত রিপন | প্রকাশিত: ১১:২৫ এএম, ১৮ জুন ২০২৫

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম থেকে তীব্র আবাসন সংকট ও অপ্রতুল পরিবহন সমস্যা চলছে। তিন বছর আগে একটি ছাত্রীহল নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ২০ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রহল হয়নি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ অনুযায়ী, কলেজ বিলুপ্ত করে একই বছরে (২০০৫ সাল) বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। কলেজের সব সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মুসিহ মুহিত অডিট ফার্মকে। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ১২টি হল ছিল বলে অডিটে উল্লেখ করেছিল প্রতিষ্ঠানটি।

এরপর সময় গড়িয়ে যায়। দায়িত্ব পালন করে চলে যান একাধিক উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হলের আশা অধরাই থেকে যায়। তবে ২০২২ সালের ১৬ মার্চ অনাবাসিক তকমা ঘুচিয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নামে একটি ছাত্রীহলের যাত্রা শুরু হয়। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ২০ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রহল হয়নি।

জবির জন্ম থেকেই তীব্র আবাসন সংকট, অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা

আবাসনের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি আবাসন সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে চার দফা দাবি নিয়ে সমাবেশ করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এতে রাজধানী ঢাকা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। পরে সরকারের আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করে ক্যাম্পাসে ফেরেন শিক্ষার্থীরা।

এর আগে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হলের দাবিতে আন্দোলনের জেরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ করা হয়। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক মাসের মধ্যে ১২টি হল ও বেদখল হওয়া অন্যান্য সম্পত্তি উদ্ধারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এক মাস পর পাঁচ সদস্যের দল পাঁচটি হল (আনোয়ার শফিক হল, শাহাবুদ্দিন হল, আজমল হোসেন হল, তিব্বত হল ও হাবিবুর রহমান হল) বিশ্ববিদ্যালয়কে লিজ দেওয়ার সুপারিশ করে। ভূমি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। ২০১০ সালের শুরুতেই জেলা প্রশাসক আইনগত সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে হলগুলো লিজের পরিবর্তে অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নিতে বললেও একাধিক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা ও আইনি জটিলতায় হল উদ্ধার কার্যক্রম থমকে যায়।

জবির জন্ম থেকেই তীব্র আবাসন সংকট, অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা

বর্তমানে ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে নেওয়া লিজের ভিত্তিতে মাত্র তিনটি হল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে। এগুলো হলো ওয়ারীতে অবস্থিত শহীদ নজরুল ইসলাম হল, বংশালে অবস্থিত ড. হাবিবুর রহমান হল এবং সূত্রাপুরে অবস্থিত বাণী ভবন। এসব হলের জায়গায় নির্মিত হয়নি নতুন কোনো স্থাপনা। বহু বছর আগে নির্মিত জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনই এখন পর্যন্ত সেখানে বিদ্যমান।

এর মধ্যে শহীদ নজরুল ইসলাম হলের ভবনে মাত্র ১৪ জন ছাত্র থাকেন। তারা নিজেদের মতো করেই সেখানে থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো দেখভাল সেখানে নেই। বংশালের ড. হাবিবুর রহমান হলে কোনো ছাত্র থাকেন না। এখানে ৪০ জনের মতো কর্মচারী নিজেদের মতো করে থাকেন। সূত্রাপুরের বাণী ভবনে ৩০ থেকে ৩৫ জন কর্মচারী বসবাস করেন। জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন তারা।

অন্য হলগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে নেই। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তিব্বত হল, আব্দুর রহমান হল, শহীদ আনোয়ার শফিক হল, সাইদুর রহমান হল, রউফ মজুমদার হল, শহীদ আজমল হোসেন হল, বজলুর রহমান হল ও শহীদ শাহাবুদ্দিন হল।

জবির জন্ম থেকেই তীব্র আবাসন সংকট, অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, আবাসিক হল না থাকায় শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময়ের বড় অংশই চলে যায় সড়কেই। দূর-দূরান্ত থেকে তাদের ক্যাম্পাসে আসতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। ১০ বছর আগেও যেখানে সাইনবোর্ড ছিল যে ‘এটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সম্পত্তি’ অথচ এখন বেদখলে। এসব সম্পত্তি উদ্ধার করা গেলে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা যায়। সরকার বিভিন্ন সময়ে আশ্বাস দিলেও কাজ হয়নি। এ বিষয়ে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।

পরিবহন ব্যবস্থাও অপ্রতুল

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন সংকট দিন দিন বেড়েই চলছে। ১৯ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য বাস রয়েছে মাত্র ৩৩টি। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ছোট-বড় মিলিয়ে ২০টি পরিবহন রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবহন অকেজো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেগুলো সংস্কার করে পুনরায় পরিবহনযোগ্য করার চেষ্টা করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হল ছাড়া কোনো আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় তীব্র পরিবহন সংকটের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অন্যদিকে বাইরের বাসে চড়তে গিয়ে প্রতিনিয়ত নানান হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় দূরের শিক্ষার্থীদের সময় ও অর্থ দুটোই বাড়ছে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকল হয়ে পড়ে থাকা পরিবহনগুলো দ্রুত সংস্কারের পাশাপাশি হলের সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থা বাড়ানোর কথা বলছেন তারা।

ইয়ারুল ইসলাম কুমিল্লা থেকে প্রতিদিন ক্যাম্পাসের বাসে আসেন। এতে তার অন্তত চার ঘণ্টা সময় সড়কেই চলে যায়। আবার কোনো কারণে বাস মিস হলে সেদিন অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়।

ইয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মনে করি হলের সঙ্গে পরিবহন ব্যবস্থা বাড়ানো হলে বা বিকল পরিবহন সচল হলে সংকট কিছুটা দূর হয়।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রশাসক (পরিবহন) তারেক বিন আতিক বলেন, ‘বর্তমানে ৫৩টি গাড়ি রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আমাদের হল হচ্ছে। এটা হলে গাড়ি সংকট দূর হবে। শিক্ষকদের গাড়িও কম। নষ্ট গাড়িগুলো, তিনটা মাইক্রো টাইপের মেরামত করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ৩৩টা, শিক্ষক-স্টাফদের জন্য ২০টা গাড়ি রয়েছে।’

জবির জন্ম থেকেই তীব্র আবাসন সংকট, অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা

অতীতে হলের দাবিতে সামনের সারি থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া রাইসুল ইসলাম নয়নের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন ব্যবস্থা থাকবে না এটা হতে পারে না। যৌক্তিক দাবির পক্ষে ক্যাম্পাসে হল আন্দোলনের নেতৃত্বে পার্ট হিসেবে ছিলাম। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে চাওয়া হয় না যে ঢাকার মধ্যে হল তৈরি হোক। এর আগে হলের জন্য আন্দোলন- অনশন করেছি, যার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রী হল তৈরি হলো।’

তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের কারণে এর আগে প্রশাসন লিখিত দেয় হলের কাজ শুরু করবে এবং সেকেন্ড ক্যাম্পাসের কাজ শুরু করবে। পরে পরিবহন দ্বিগুণ করা হয়, ক্যান্টিনের উন্নতি হয়। নতুন সরকার আসায় আমাদের মধ্যে আশা জাগলো যে দাবি পূরণ হবে। কিন্তু এবারও উল্টো হলো। আসলে জবি প্রশাসন প্রশাসনিকভাবে দক্ষ না, দাবির পক্ষে সেভাবে উপস্থাপন করা হয় না। আমাদের আবাসন ও ক্যাম্পাসের বাধা সচিবালয় ও রাজনীতি। রাজনৈতিক নেতারা চান না ঢাকায় ক্যাম্পাস হোক। এ কারণে বাধাগ্রস্ত করেছে বিভিন্ন সময়ে। আবার অনিয়ম-দুর্নীতি চরম পর্যায়ে হয়েছে আগে। দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের টেন্ডার নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। এখানে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আমলাদের সদিচ্ছার অভাবে ভালো ক্যাম্পাস পাচ্ছে না জবি।’

জবির জন্ম থেকেই তীব্র আবাসন সংকট, অপ্রতুল পরিবহন ব্যবস্থা

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রশাসন (পরিবহন) তারেক বিন আতিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে হাবিবুর রহমান হল ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যেই চিঠি ইস্যু হবে। বেদখল হলের মধ্যে আরমানিটোলায় ৫০ কাঠার একটা হল রয়েছে। সেটা পুলিশ এখন দখল করে আছে, সেখানে পুলিশের ব্যারাক রয়েছে। সেটা উদ্ধার করে সেখানে মেয়েদের জন্য একটা হল করা গেলে বেটার হবে। ১০ বছর আগেও সেখানে লেখা ছিল যে, এটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সম্পত্তি। এখন সেটা পুলিশের ব্যারাক। এটা নিয়ে যদি আইজিপি ও শিক্ষার্থীরা মুভ করে তবে এটা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। আমাদের কাছে কিছু আছে, সেগুলো ব্যবহারের সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়েছি। ভবন করারও উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি কিছুটা সমাধান হবে। তবে অনেক সম্পদ আছে যেখানে মালিকানা নিয়ে সমস্যা আছে, অনেকে ভবন বানিয়ে রেখেছেন। সেগুলো নিয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে নিয়েও আমরা কাজ করছি।’

উপাচার্য বলেন, ‘আহসানউল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমাদের হলের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমাদের অস্থায়ী হল তৈরির প্রস্তাব ২১ মে সাবমিট হয়েছে। এগুলো যখন আসবে তখন পরিবহনের চাপটা ধীরে ধীরে কমে আসবে। এখনই যদি আবার পরিবহনে বিনিয়োগ করতে যাই তাহলে হলের বিনিয়োগ কমে যাবে। আশা করি সামগ্রিক বিষয়টা একটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারবো।’

বেদখল সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়ে অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, বেদখলের বিষয়টা অন্যরকম। তারা আইনগতভাবে দখল করেছে, কাগজপত্র তৈরি করেছে। এটা আমাদের সময় না, আরও আগেই হয়েছে। উদ্যোগ নিতে হলেও উদ্যোগের পথ থাকতে হবে। এটা আইনকানুনের ব্যাপার। কারণ অনেকেই হাইকোর্টের মাধ্যমে একটা জায়গা নিয়ে গেছে দেখলাম। আমরা আব্দুর রহমান হল নিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার একবারে শেষ পর্যায়ে গিয়েছিলাম। দেখলাম আরেকটা মামলা করেছে, সেখানে মালিকানাও দিয়ে দিয়েছে। আমরা চেষ্টা করে শেষ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি। বাকিগুলোর ব্যাপারেও চেষ্টা করছি।’

পরিবহন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন যত দূরে যায় আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন ততদূর যায় না। এর অন্যতম কারণ এখানে আবাসন ব্যবস্থা নেই, দূর থেকে শিক্ষার্থীরা আসেন। তাদের সুবিধার্থে আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা দূর থেকে আনা-নেওয়ার কাজ করে। আমাদের নানান সংকট আছে, সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে আবাসন ব্যবস্থা সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটা হলে পরিবহন সমস্যা আস্তে আস্তে কমে যাবে।’

ইএআর/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম