ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

‘মইরা গেলে হাড্ডিতো আছে, তাই দিতো আমাগো’

নাজমুল হুদা | রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) | প্রকাশিত: ০৭:৪৪ পিএম, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জনতার দেওয়া আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজী টায়ারস কারখানা। ৩২ ঘণ্টা ধরে জ্বলা আগুনে শুধু দুটি কারখানা পোড়েনি, শোকের সাগরে ডুবেছে ১৮২টি পরিবার। অগ্নিকাণ্ডের পরদিন থেকেই নিখোঁজদের স্বজনরা কারখানার সামনে জড়ো হন। এক বুক আশা নিয়ে খুঁজে ফেরেন স্বজনদের। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও নিখোঁদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবিত পাওয়ার আশাও ক্ষীণ হয়ে আসে।

স্বজনদের দাবি, নিখোঁজদের মরদেহ না পেলেও পোড়া হাড়ের অংশ হলেও যেন তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যাতে তারা তাদের ধর্মীয় রীতিতে সমাহিত করতে পারেন। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজদের কোনো হদিস মেলেনি আজও।

এদিকে নিখোঁজদের মৃত্যুর সরকারি স্বীকৃতি না পাওয়ায় অনেক পরিবার ঋণ মওকুফ ও বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সারা দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক তীব্র অস্থিরতা। তার ভয়াবহ রেশ এসে লাগে রূপগঞ্জ শিল্পাঞ্চলেও। ক্ষমতার অপব্যবহার ও যবর দখলের জবাব দিতে উত্তেজিত জনতা এক হয়। উপজেলার খাদন এলাকায় অবস্থিত গাজী টায়ারস কারখানায় তারা অগ্নিসংযোগ করে। লুটপাট চলে ৮ অগাস্ট পর্যন্ত।

গত ২৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেফতারের পর নারায়ণগঞ্জের আদালত ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ২৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় সর্বশ্রেণির মানুষ, উৎসুক জনতা কারখানাটিতে গণহারে লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে আগুন লাগার সময়ও লুট করতে কারখানার ভেতরে যাওয়া ৪-৫ শতাধিক মানুষ আটকা পড়ে। এসময় দোতলা ও তিনতলার জানালা দিয়ে অনেকেই নিচে লাফিয়ে পড়ে। কিন্তু অন্যরা বের হতে পারেনি। এ ঘটনায় অন্তত ১৮২ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করেছে পরিবারের সদস্যরা।

দ্বিতীয় দফায় গত বছরে ২৫ আগস্টের অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পর্যায়ক্রমে ডেমরা, কাঁচপুর, আদমজী, ইপিজেড ও কাঞ্চন ফায়ার স্টেশন থেকে একে একে যোগ দেয় ১২টি ইউনিট। ততক্ষণে ভয়াবহ আগুন ছয়তলা ভবনটি গ্রাস করে। অবশেষে দমকল বাহিনী প্রায় ৩২ ঘণ্টার প্রাণপণ প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে আগুন নেভার পর ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি ফায়ার সার্ভিস। বুয়েট থেকে পরিদর্শক দল এসেও ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে।

ভেতরে কোনো মরদেহ আছে কি না তা জানতে ড্রোন পাঠানো হলেও সেখানে মরদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে কারখানার বাইরে অপেক্ষমান স্বজনদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৮২ জন নিখোঁজের একটি তালিকা প্রস্তুত করে প্রশাসন।

আগুন নেভানোর পর ভবনটির বেজমেন্টে প্রাথমিক একটি উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু সেখানে হতাহত কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে আর কোনো উদ্ধার অভিযান এ ভবনটিতে চালানো হয়নি।

গত বছরের ২৭ অগাস্ট তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে ১২ সেপ্টেম্বর কমিটি জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যদি ৫ আগস্টের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতো, তাহলে প্রায় তিন সপ্তাহ পরে ভয়াবহ এ ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ছয় তলা ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় তামা ও রাসায়নিক লুট করতে গেলে একদল অনুপ্রবেশকারী নিচতলার গেট বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে চলে যায়। ভবনে দাহ্য পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় ১৮২ জন নিখোঁজ হয়।

আগুনের ঘটনার পাঁচদিন পর গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর কারখানাটির সামনে গণশুনানির আয়োজন করে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। ওই সময় নিখোঁজ ৮০টি পরিবারের সদস্যরা তাতে অংশ নেন। গণশুনানি শেষে নিখোঁজের স্বজনরা বাধা উপেক্ষা করে ভবনে ঢোকেন এবং ভবনটি থেকে ১৫ খণ্ড হাড় উদ্ধার করেন। পরে তা পুলিশের কাছে জমা রাখা হয়। হাড়গুলোর ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য তখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে পাঠানোর হয়েছিল। তবে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ থেকে এ হাড়গুলোর বিষয়ে আর কোনো আপডেট জানানো হয়নি। নিখোঁজদেরও আর কোনো হদিসও মেলেনি।

বরপা পূর্বপাড়া এলাকার নিখোঁজদের একজন শাহ আলম। রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন তিনি। শারমিন নামের দেড় বছরের একটি শিশু সন্তান রয়েছে তার। এক বছরেও শাহ আলমের কোনো খোঁজ না পেয়ে দিশাহারা স্ত্রী সপ্না। দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তার।

বরপা সুতালারা এলাকার সেকুল মোল্লা বলেন, তার দুই ছেলে রতন মোল্লা ও মানিক মোল্লা। তারা দুজনেই একটি পোশাক কারখানাতে কাজ করতো। নিষেধ করলেও এলাকার লোকজনের সঙ্গে তারা ওই কারখানা এলাকায় যায়। রাত দশটা বাজে তাদের সঙ্গে ফোনে কথা হলে তারা কারখানার কাছে সিনেমা হলের সামনে আছে বলে জানায়। সাত মিনিট পর তাদের ফোন দিয়ে আর পাইনি। তারপর কত খুঁজলাম, কত জায়গায় গেলাম, ছেলেদের আর খোঁজ পাইলাম না।

তিনি বলেন, ‘নিখোঁজদের মৃত্যুর সরকারি স্বীকৃতি না পাওয়ায় অনেক পরিবার ঋণ মওকুফ ও বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হইতাছে। সরকার আমাগো লাশ দেক না হয় মৃত্যুর স্বীকৃতি দিক। এক বছরে আমরা কিছুই পাইলাম না।’

নিখোঁজ সোহেল মুন্সীর মা বেলাতুন বেগম বলেন, ‘মইরা গেলে হাড্ডিটা তো আছে। তাই দিতো আমাগো। কিন্তু একটা বছর হইয়া গেলো, কিছুই তো করলো না সরকার।’

বরপা সুতালারা এলাকার নিখোঁজ মনির হোসেনের মা শাহনাজ বেগম বলেন, মনির গুলিস্তানে একটি নেটের অফিসে কাজ করত। বিকেলে কাজ সেরে বাড়ি আসার পথে অগ্নিকাণ্ড দেখে সেখানে নেমে কারখানার ভেতরে গেছে। রাতে সে ফোন দিয়ে জানায় মা আমি আর বাঁচবো না। এটাই তার শেষ কথা। দীর্ঘ একটা বছর পেরিয়ে গেলেও আমার বাবার কোনো খোঁজ পাইনাই।

তিনি বলেন, গত এক বছরে বেশ কয়েকবার প্রশাসনের লোকজন তথ্য যাচাই-বাছাই করলেও আমার ছেলের কোন খোঁজ নাই। আমার একটা মাত্র সন্তান। সরকারের কাছে আমার দাবি মরদেহ না পেলেও অন্তত হাড্ডিগুলো আমাদের দেওয়া হোক। ধর্মীয় রীতিতে আমার ছেলের কবরটা যেন দিতে পারি।

এ বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, গাজী টায়ারসে যখন আগুন লেগেছিল সেখানে বিভিন্ন কেমিক্যাল ছিল। কেমিক্যালের কারণে আগুনের তীব্রতা প্রকট আকার ধারণ করে এবং অতি উচ্চ তাপমাত্রা তৈরি হয়। সেখানে মেটাল পর্যন্ত পানির মতো গলে গিয়েছিল। যে পরিবারগুলো দাবি করছিলেন যে তাদের স্বজনরা সেখানে গিয়েছিলেন। আমাদের তৎকালীন জেলা প্রশাসক একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছিলেন। সে কমিটি একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। স্বজনদের দাবির প্রেক্ষিতে এখান থেকে কিছু স্যাম্পল কালেক্ট করে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়েছে। যেহেতু স্বজনদের দাবি অনুযায়ী ১৮৪ জনের ডিএনএ আলাদা আলাদাভাবে সনাক্ত করতে হচ্ছে। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হলেই রিয়েল ঘটনাটি জানা যাবে।

জেলার সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্রশাসনের করা তালিকা ধরে পুলিশ নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ করছে। এ বিষয়ে পুলিশের একটি টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তারা সরেজমিনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত করছে। তবে এরইমধ্যে আমরা ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টটি হাতে পেয়েছি। আশা করছি শিগগিরই নিখোঁজদের শনাক্তের বিষয়টি প্রকাশ করা হবে।

এফএ/জেআইএম