জুলাই শহীদের সন্তান
‘বাবা উঠো, মজা আইন্না দাও’ কবরের কাছে গিয়ে বলে ছোট্ট সাজিদুল
২০২৪ সালের ২০ জুলাই। প্রতিদিনের মতই সকালে কাজে বের হয়েছিলেন ঠেলাগাড়ি শ্রমিক মিজানুর রহমান। তবে কাজ শেষ করে আর বাজার নিয়ে বাসায় ফিরতে পারেননি তিনি। ঢাকায় জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে মানিকনগর বিশ্বরোড এলাকায় শহীদ হন বরগুনার ছেলে মিজানুর রহমান।
উপার্জনক্ষম স্বামীর মৃত্যুতে সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক অনুদান পেলেও দুই অবুঝ ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তার স্ত্রী জাকিয়া আক্তার শিরিন। স্থায়ী মাথাগোঁজার ঠাঁই আর একটি চাকরি চান তিনি।
মিজানুর বরগুনা সদর উপজেলার ৮ নম্বর ইউনিয়নের কালিরতবক গ্রামের জাকির হোসেন দুলালের বড় ছেলে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় ১০ বছর আগে জীবিকার তাগিদে বরগুনা ছেড়ে কাজের উদ্দেশ্যে বাবার সঙ্গে ঢাকায় যান মিজানুর রহমান। গত বছরের ২০ জুলাই কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে মানিকনগর বিশ্বরোড এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে ময়নাতদন্ত ছাড়াই বরগুনা সদর উপজেলার ৮ নম্বর ইউনিয়নের কালিরতবক গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
“আমার ছেলে বেঁচে থাকতে নিজে কষ্ট করে আমার নাতিদেরকে ভালো রাখতো। ও সন্তানদের ঢাকায় পড়ালেখা করাতো। এখন আমার ছেলে নাই। আমার আবুঝ নাতিরা আমার কাছে খাবার চায়, খেলনা চায়; আমি কিনে দিতে পারি না। তখন ছোট বাচ্চাটা কবরের কাছে গিয়ে বলে, ‘বাবা, উঠো। আমারে মজা আইন্না দাও’।”
শহীদ মিজানুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ৯ বছর বয়সী মেয়ে সামিয়া আক্তার পিংকি আর ৫ বছর বয়সী ছেলে সাজিদুল ইসলাম এখনো ভুলতে পারেনি বাবার স্মৃতি। মাঝেমধ্যে ছবি দেখিয়ে নাতিদেরকে সান্ত্বনা দেন মিজানুরের বাবা-মা। ছেলে হারানোর স্মৃতি মনে পড়লেই কবরের কাছে ছুটে গিয়ে এখনো কান্নায় বুক ভাসান মা শাহিনুর বেগম।

মিজানুরের গ্রামের বাড়িতে তার নিজের কোনো ঘর না থাকায় দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে দেবরের বাড়িতেই থাকেন কিয়া আক্তার শিরিন। অনুদানের টাকায় কেনা রিকশা চালিয়ে সংসার চালান মিজানুরের বাবা দুলাল।
- আরও পড়ুন:
অনুদান-ভাতা তিন ভাগে বণ্টন হবে জুলাই শহীদ পরিবারের মধ্যে
একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছি, আপনি কী বুঝবেন
আমার ছেলেকে তারা যেভাবে পুড়িয়ে মেরেছে, আমিও সেই শাস্তি চাই
গুলি খেয়ে কাতরাচ্ছিল তাইম, উপভোগ করছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা
ঝুলে থাকা পোড়া জুতা দেখে ছেলের লাশ চিনতে পারেন শাহিনা
নাতি-নাতনিদের চাহিদামতো সব দিতে পারেন না বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন মিজানুরের মা শাহিনুর বেগম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, “আমার ছেলে বেঁচে থাকতে নিজে কষ্ট করে আমার নাতিদেরকে ভালো রাখতো। ও সন্তানদের ঢাকায় পড়ালেখা করাতো। এখন আমার ছেলে নাই। আমার আবুঝ নাতিরা আমার কাছে খাবার চায়, খেলনা চায়; আমি কিনে দিতে পারি না। তখন ছোট বাচ্চাটা কবরের কাছে গিয়ে বলে, ‘বাবা, উঠো। আমারে মজা আইন্না দাও’।”

স্বামী হারানো বেদনা নিয়ে ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত গড়তে চিন্তিত মিজানুরের স্ত্রী জাকিয়া আক্তার শিরিন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারের দেওয়া সহযোগিতা দিয়ে তো আর সারাজীবন চলা যাবে না। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি যে কয়দিন বেঁচে আছে, হয়তো সে কয়দিন আমি সন্তানদের নিয়ে এই বাড়িতে থাকতে পারবো। এরপর আমার কী হবে! সরকারিভাবে যে কয়টা টাকা পাচ্ছি তা ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ায় খরচ হয়ে যায়। ভবিষ্যতের জন্য কিছুই রাখার সুযোগ নেই।’
‘সরকারের দেওয়া সহযোগিতা দিয়ে তো আর সারাজীবন চলা যাবে না। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি যে কয়দিন বেঁচে আছে, হয়তো সে কয়দিন সন্তানদের নিয়ে এই বাড়িতে থাকতে পারবো। এরপর আমার কী হবে! সরকারিভাবে যে কয়টা টাকা পাচ্ছি তা ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ায় খরচ হয়ে যায়। ভবিষ্যতের জন্য কিছুই রাখার সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, আমাকে একটি চাকরি বা এমন একটা কিছু করে দিক যেটা দিয়ে আমি আমার সন্তানদের লেখাপড়াসহ মানুষ করতে পারি।’
- আরও পড়ুন:
চিকিৎসকরা বলেছিলেন লাশ না নিয়ে গেলে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে
জুলাই গণহত্যাকারীদের কেউই ছাড় পাবে না: চিফ প্রসিকিউটর
গণঅভ্যুত্থানে শহীদ-আহতদের নিয়ে প্রবন্ধ পাঠানোর নির্দেশ মাউশির
জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে ‘ঐতিহাসিক দলিল’ ঘোষণার নির্দেশ
একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছি, আপনি কী বুঝবেন
কথা হয় শহীদ মিজানুর রহমানের বাবা জাকির হোসেন দুলালের সঙ্গে। পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তিনিও। জাকির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর ২০ জুলাই আমার ছেলে মারা গেছে। বর্তমান সরকার আমাদের পাশে আছে এবং ভালোই সহযোগিতা করছে। প্রতি মাসেই আমাদের খোঁজ খবর নেয় তারা। ১০ লাখ টাকার একটা সঞ্চয়পত্র দিয়েছে, যা দিয়ে মাসে ৯ হাজার ৩৭০ টাকা পাই। কিন্তু ওই টাকা দিয়ে শুধু মিজানুরের দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ হয়। আমি সবল থাকায় বাকিসব খরচ এখন রিকশা চালিয়ে দিতে পারছি বা কাজ করেও দেই। তবে ভবিষ্যতে আমি না থাকলে তখন কী হবে?’
তিনি বলেন, ‘আমার নিজেরও কোনো ঘর নেই। আগে ঢাকায় থাকতাম। মিজানুর মারা যাওয়ার পর ওর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বরগুনায় মেজো ছেলের বাড়িতে আছি। আমি চাই, সরকার আমাদের জন্য একটু স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিক।’
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এরইমধ্যে ১০ লাখ টাকা করে জুলাই আন্দোলনে শহীদ বরগুনার ১০ পরিবারকে সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি আরও ২০ লাখ টাকা এ মাসেই হস্তান্তর করা হবে। জেলা পরিষদ থেকে নগদ দুই লাখ টাকাও দিয়েছি। যখন তাদের যেটা দরকার আমরা আমাদের সাধ্যমতো তাদের দিয়ে যাচ্ছি।’
এসআর/জেআইএম