পরিচালকের দাবি ‘প্রিন্টিং ভুল’
১০১ টাকার ওষুধ ১৩০০ টাকায় কিনলো কুমেক হাসপাতাল
ফাইল ছবি
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কুমেক) ২৪ কোটি টাকার কেনা-কাটায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ইনজেকশনের দাম অস্বাভাবিক বেশি দেখিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ বিএনপিপন্থি চিকিৎসক সংগঠন ড্যাবের নেতাদের। একইসঙ্গে চিকিৎসা সেবার এই প্রতিষ্ঠানে টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমেও গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাজারে ১০১ টাকা মূল্যের ইনজেকশন ‘থায়োপেনটাল সোডিয়াম’ সরকারি নথিতে দেখানো হয়েছে ১ হাজার ২৯৯ টাকা। শুধু এই একটি আইটেমে লোপাট হয়েছে প্রায় ৪৮ লাখ টাকা। এছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ৯ লাখ এরোভাসটাটিন ২০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট কেনা হয়েছে। যা শেষ করতে সময় লাগবে অন্তত ২০ বছর। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক ডাক্তার মাসুদ পারভেজ সোহাগের স্বাক্ষরিত এক চাহিদাপত্রে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি এক প্রতিবাদ সভায় বিএনপিপন্থি চিকিৎসক সংগঠন ড্যাবের কুমিল্লা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. আরিফ হায়দার দাবি করেন, ‘২৪ কোটি টাকার অনিয়মের মধ্যে আড়াই কোটি টাকার ভাগাভাগি হয়েছে পরিচালক ডাক্তার মাসুদ পারভেজ ও কুমিল্লা জেলা ড্যাবের সভাপতি ডা. এম এম হাসান মাসুদসহ কয়েকজনের মাঝে।’
তবে এসময় সভায় উপস্থিত ডা. এম এম হাসান মাসুদ অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিবাদ জানান। এরপর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হলে গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে ড্যাবের কেন্দ্রীয় মহাসচিব জহিরুল ইসলাম (শাকিল) স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে ড্যাবের কুমিল্লা জেলা, মহানগর ও মেডিকেল কলেজ শাখা কমিটির সব কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। একইসঙ্গে তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সূত্র থেকে জানা যায়, চাহিদাপত্রের ক্রমিক নং-১৬ ও শিডিউল নং-৩৫ অনুযায়ী ক্রয় করা হয়েছে এরোভাসটাটিন ২০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট। কিন্তু প্রয়োজন ছিল ১০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট। উচ্চমাত্রার ওষুধ কেনার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে প্রায় ৯ লাখ ট্যাবলেট। এই পরিমাণ ট্যাবলেট খরচ করতে হাসপাতালের লেগে যাবে অন্তত ২০ বছর।
আরও পড়ুন-
ঐক্য রক্ষা না করলে নতুন ষড়যন্ত্র থামানো যাবে না: ধর্ম উপদেষ্টা
পিবিপ্রবিতে জনবল নিয়োগে অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন
মাদরাসার নামে সাহায্য তোলা তিনজনকে চুল কেটে গণপিটুনি
ড্যাব কুমিল্লা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ডা. আরিফ হায়দার বলেন, ‘কুমিল্লা জেলা সভাপতি এম এম হাসান আমাকে বলেছেন উনি টেন্ডারের সভাপতি হতে চান। টেন্ডার বাণিজ্যের বিষয়ে আমি তেমন কিছু বুঝি না। উনি আমাকে যা বলেছেন, আমি তাই করেছি। আমাকে ব্যবহার করে ৮০ লাখ টাকা উনি কামিয়েছেন, আমি এক টাকাও নিইনি। দিনশেষে এখন চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ আমি, আমিতো মেডিকেলের কেউ না, আমি দায়বদ্ধ হলাম কীভাবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব কিছুর মূলহোতা মেডিকেলের ডিরেক্টর। যার কাছে টাকা পান, উনি তার সঙ্গেই আছেন। ওনার নামে বিস্তর অভিযোগ, উনিতো নিজের ভাগেরটা আগেই সরাইয়া ফেলছে, ঢাকাতেও ওনার নামে বদলিসংক্রান্ত বিষয়ে অনেকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে।’
অভিযোগ অস্বীকার করে কুমিল্লা ড্যাবের সভাপতি এম এম হাসান মাসুদ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে কথাগুলো উঠেছে সেগুলো যে কেউ তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে বলতেই পারে। কিন্তু আমার সততার চাদর হলো দুর্নীতিমুক্ত থাকা। আমি আল্লাহর নাম নিয়ে বলছি, এই ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি জড়িত না। আমি চাই কেন্দ্রীয় ড্যাব থেকে এই বিষয়গুলো তদন্ত করা হোক, আমি চাই সত্য উন্মোচিত হোক।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ শাখার ড্যাব সভাপতি ডা. মিনহাজুর রহমান তারেক বলেন, ড্যাবের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- বিএনপির অঙ্গ সংগঠনে কোনো দুর্নীতির কিছু পেলে তা লিখিত আকারে অভিযোগ দিতে হবে। ড্যাব কুমিল্লা নিয়ে অভিযোগ কেন্দ্রীয় ড্যাবে গেছে। আমরা চাই অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
সার্বিক বিষয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মাসুদ পারভেজ সোহাগ বলেন, থায়োপেনটাল সোডিয়াম ১০১ টাকা ৬০ পয়সা। ক্রয়ের সময় প্রিন্টিং ভুলের কারণে এর দাম ১২৯৯ টাকা লেখা হয়েছে। পরে বিষয়টি আমাদের নজরে এলে ৪ হাজার পিস থায়োপেনটাল সোডিয়ামের দাম সংশোধন করা হয়।
অধিকার ফাউন্ডেশন কুমিল্লার প্রধান নির্বাহী আলী আকবর মাসুম বলেন, ‘প্রিন্টিং মিসটেক’ বলে এমন দায়িত্বশীল জায়গা থেকে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি এভাবে দায় এড়াতে চান, তার মানে তিনি তার দুর্নীতি আড়াল করতে চাচ্ছেন।
এরই মধ্যে রাজধানীর পল্লবী এলাকার বাসিন্দা মো. আলম হোসেন নামে এক ব্যক্তি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর অভিযোগ করেন, ‘থায়োপেনটাল সোডিয়াম’ ক্রয়ে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। যা তদন্ত করে যেন সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়।
এদিকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ওষুধ কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে কয়েকজনের অপসারণ দাবি করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করেন বিক্ষুব্ধরা। এসময় তারা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ ও তার প্রধান সহযোগী দেলোয়ার হোসেনের অপসারণ দাবি করেন। মানববন্ধনে এনসিপির মহানগরের যুগ্ম সমন্বয়কারী মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান, এবি পার্টির মহানগরের আহ্বায়ক গোলাম মো. সাদমানীসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
জাহিদ পাটোয়ারী/এফএ/এমএস