ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

সব উদ্যোগে পানি ঢালছে রেজিস্ট্রেশনহীন গোপন বাল্যবিয়ে

আয়শা সিদ্দিকা আকাশী | মাদারীপুর | প্রকাশিত: ০১:২৫ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০২৫

মাদারীপুর সদর উপজেলার রাস্তি ইউনিয়নের পূর্ব রাস্তি এলাকার লিটন চৌকিদার ও খোদেজা বেগমের মেয়ে লামিয়া (১৫)। স্থানীয় রাজ্জাক হাওলাদার একাডেমিতে নবম শ্রেণিতে পড়ে লামিয়া। বাবা স’মিলে শ্রমিকের কাজ করেন। অভাবের সংসার। স্কুলে কয়েক মাসের বেতন দিতে না পারায়, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। স্থানীয় একটি পার্লারে কাজ করছে সে। এখন তার পরিবার আছে বিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায়।

একই এলাকার ভ্যানচালক সেলিম হোসেন ও লিপি বেগমের তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় সংসারে অভাব লেগেই থাকে। তাই বড় মেয়ে লিজা ও নিপাকে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে ঋতুমনিও (১০) ঠিকমতো স্কুলে যায় না। ছেলে দুটি ছোট। তবে তাদের পড়াশুনা করাবেন বলে জানান সেলিম।

শহরের মধ্যে হওয়ার পরও এখানকার অনেক শিশু শিকার হচ্ছে বাল্যবিয়ের। অনেকেই আবার প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ঝরে পড়ে। এসব পরিবারের অভিভাবকরা ১৮ বছরের আগেই তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। তবে বিয়ের ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের ঝামেলাও করতে হয় না খুব একটা। মৌলভী ডেকে আত্মীয়-স্বজন মিলে বিয়ে দিয়ে থাকেন তারা। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে দিতে বয়স বাড়িয়ে জন্ম নিবন্ধন করা হয়। আর এসব কর্মযজ্ঞের ফল বহন করতে হয় বাল্যবিয়ের শিকার সেই কিশোরীকে। অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও পড়তে হয় তাদের।

মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেওয়া মাজেদা বেগম বলেন, ভালো ছেলে পেয়েছি, তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। তবে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হয়নি। মুরব্বিরা মিলে ইসলামের শরিয়ত অনুযায়ী বিয়ে হয়েছে।

মাদারীপুর শহরের ৭নং ওয়ার্ডের কাজী নুরুল হক বলেন, ইদানিং বাল্যবিয়ে বেড়েছে। অসচেতনতার জন্যই বাল্যবিয়ে হচ্ছে। মাদারীপুরে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি। তাই অভিভাবকরা প্রবাসী পাত্র পেলে যত দ্রুত সম্ভব মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেন। আর মাদারীপুরে কিছু কাজী আছেন, তারা তথ্য গোপন করে ও ভুল তথ্য দিয়ে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে থাকেন। ওইসব কাজীরা একটু টাকা বেশি পেলেই অনেক ধরনের কৌশলে বিয়ে দিয়ে থাকেন। অনেক সময় খাতায় রেজিস্ট্রার করলেও ভুল তথ্য দিয়ে থাকেন।

যদিও মাদারীপুর জেলা তথ্য অফিসের ভারপ্রাপ্ত তথ্য অফিসার মো. বেনজীর আহমেদ বলছেন, বাল্যবিয়ে নিরোধের জন্য মাদারীপুরে জেলা প্রশাসন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, মহিলা সংস্থা থেকে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে নিয়ে নিয়মিত মিটিং করা হয়। আমাদের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত সভা, সেমিনার, উঠোন বৈঠক, লিফলেট বিতরণ, সচেতনমূলক ভিডিও প্রচার করা হয়। তাছাড়া কোথাও কোনো বাল্য বিয়ের খবর পেলে প্রশাসন থেকে তা বন্ধ করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানাও করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন-
বৈষম্য ও সহিংসতার বেড়াজালে কন্যাশিশু, নিরাপদ শৈশব এখনো অধরা
বয়স বাড়িয়ে বাল্যবিয়ে, কনের মা ও কাজীকে জরিমানা
কোর্ট ম্যারেজের নামে ‘উকিল ম্যারেজ’ বন্ধ চান ইউএনও

২০২৩ সালের ১ অক্টোবর মাদারীপুর সদর উপজেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের যৌথ আয়োজনে মাদারীপুর সদর উপজেলাকে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এখানে এখনো বাল্যবিয়ে হচ্ছে হরহামেশা। শুধু তাই নয়, এসব এলাকায় বাল্য বিয়ে কিংবা ঝরে পড়ার পাশাপাশি অনেক মেয়ে শিশুকে স্কুলেই পাঠানো হচ্ছে না।

রিকসাচালক নুর ইসলাম মাতুব্বর ও হাসনা বেগমের তিন মেয়ে। নুর ইসলাম আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। মা হাসনা বেগম বাবুর্চির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। একসঙ্গে সংসার চালানো ও মেয়েদের পড়াশুনা করানো কষ্টকর হওয়ায় তিন মেয়ের কেউ স্কুলে যায়নি। দুই মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ে সাথী আক্তারেরও বিয়ের পর দুই মেয়ে হয়েছে। আরেক মেয়ে তানিয়া আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন, তারও দুই ছেলে আছে। ছোট মেয়ে শান্ত (১১) স্কুলে যায় না।

কলাতলা এলাকার সাগর শেখ রিকসা চালান, তার স্ত্রী রোজিনা বেগম গৃহকর্মী। তাদের দুই মেয়ে। খাদিজা (১১) ও সুমাইয়া (৭) কেউ স্কুলে যায় না।

ইমরান হাওলাদার কয়েকমাস আগে মারা গেছেন। তার স্ত্রী নাজু বেগম গৃহকর্মীর কাজ করেন। বড় মেয়ে মিম (৭) স্কুলে যায় না। মা গৃহকর্মীর কাজ করে, তাই দেড় বছরের ছোট বোনকে দেখাশোনা করতে হয় তাকেই।

পূর্ব রাস্তি এলাকার রাজ্জাক একাডেমির প্রধান শিক্ষক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, এই এলাকাটিতে স্বল্প আয়ের মানুষ বেশি বসবাস করেন। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই অশিক্ষিত। ছোট-খাটো কাজ করে থাকেন। তাই তাদের চিন্তাধারাও ভিন্ন। তারা অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিতে চান। তাই অনেক মেয়েই পড়াশুনা থেকে ঝড়ে পড়ে। তবে আমরা মেয়েদের স্কুলে আসার ব্যাপারে প্রতি দুইমাস পর পর অভিভাবক ডেকে মিটিং করি। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। তাছাড়া যারা স্কুলে নিয়মিত আসে না, হাজিরা খাতা দেখে তাদের খুঁজে বের করে প্রতি বৃহস্পতিবার তাদের অভিভাবকদের ফোন দিই স্কুলে পাঠানোর জন্য।

বেশ কয়েক বছর ধরে এ এলাকার বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজ করেছেন স্থানীয় সালিমা বেগম। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় আমি বাল্যবিয়ের ব্যাপারে প্রশাসনকে জানিয়ে বিয়ে বন্ধ করেছি। তবে বর্তমানে বাল্যবিয়ের ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি কাজ তেমন একটা হচ্ছে না। তাই এই এলাকায় বাল্যবিয়েও বন্ধ হচ্ছে না।

একই এলাকার বাসিন্দা ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য কিরণ আক্তার বলেন, আমি সবসময় বাল্যবিয়ের ব্যাপারে সোচ্চার থাকি। যখনই কোনো বাল্যবিয়ে হয়েছে, সেটা বন্ধ করেছি। তাই বেশিরভাগ বিয়েই আমাকে না জানিয়ে চুপি চুপি দিয়ে থাকেন। তাছাড়া এখানকার অনেক পরিবার আছে তারা তাদের মেয়ে সন্তানদের পড়াশুনার ব্যাপারে উদাসীন। একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে দেয়।

তিনি বলেন, অনেক পরিবারের মেয়েরা স্কুলের বেতন দিতে পারে না, ফরম পূরণের টাকাও দিতে পারেন না। আমি তা জানতে পারলে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করেছি। সেগুলো সমাধানের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তবুও আমাদের এই এলাকা থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধ হচ্ছে না। এগুলো পরিবর্তনের জন্য এখানে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি।

স্থানীয় জাগো উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ফারজানা আক্তার মুন্নি বলেন, আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করলেও এই পূর্বরাস্তি এলাকার মানুষ এখনও অনেক পেছনে পড়ে আছে। তারা মেয়েদের ঠিকমতো স্কুলে না দিয়ে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়। মাদারীপুর জেলার মূল শহরের এত কাছাকাছি একটি এলাকার মানুষের এই চিত্র কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাছাড়া বাল্যবিয়ের শিকার হওয়ায় ওইসব মেয়েদের নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে।

মাদারীপুর মহিলা উন্নয়ন সংস্থার (এমএমইউএস) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন লাকী বলেন, পূর্ব রাস্তির মেয়েরা এখনও অবহেলিত। এখানে প্রায় সময় বাল্যবিয়ে হয়ে থাকে। এজন্য আমাদের সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে। যাতে করে এখানকার মেয়েরাও সুন্দরভাবে বড় হতে পারে। তাই আমাদের এনজিওর পক্ষ থেকে খুব তাড়াতাড়ি উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সার্বিক বিষয়ে মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, আমরা যখনই কোনো বাল্যবিয়ের খবর পাই, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিই। অনেক সময় গোপনে বিয়ে দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে জানতে পারা যায় না। তাছাড়া পূর্ব রাস্তির এই এলাকাটির এমন অবস্থার কথা আমার জানা নেই। খোঁজ-খবর নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সভা, সেমিনার, উঠোন বৈঠকসহ সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এফএ/এমএস