ময়মনসিংহের ফিটফাট বিসিকের ভেতরের অবস্থা ‘সদরঘাট’
ময়মনসিংহ বিসিক শিল্পনগরী। কার্যকর সড়ক-ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও শিল্প কারখানার বাইরে চকচকে পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে ভেতরের অবস্থা ভিন্ন। প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে ফিটফাট থাকলেও বেশিরভাগেরই ভেতরের অবস্থা ব্যতিক্রম। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যপণ্য উৎপাদনের হিড়িক পড়েছে এখানে। কম মজুরিতে কাজ করাতে শিশু শ্রমিকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্লট নিয়ে অন্যত্র ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
তবে ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ব্যবসায় মন্দাভাব চলছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। মন্দাভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা চালাচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
১৯৬৮ সালে ১০ দশমিক ৮১ একর জায়গা নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে শহরের মাসকান্দা বাণিজ্যিক এলাকায় বিসিক শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে আরও ৯ দশমিক ৬২ একর জায়গা নিয়ে সম্প্রসারিত করা হয় বিসিক শিল্পনগরীর পরিধি। বিসিক শিল্পনগরীর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮১ সালে। মোট ১০৫টি প্লট ৯৯ বছরের জন্য ইজারা (বরাদ্দ) দেওয়া হয়। বর্তমানে ৯৩টি শিল্প ইউনিটে ৮৭টি ছোট-বড় শিল্প কারখানা চালু রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। বরাদ্দকৃত প্লটে ওষুধ, কয়েল, কীটনাশক, তেলের মিল, বেকারিসামগ্রী, চানাচুর ও মুড়ি তৈরির কারখানাসহ ছোট বড় শিল্প কারখানা রয়েছে।

সরেজমিনে বেশ কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা যায়, কিছু কারখানার মালিক নিজেরা ব্যবসা করছেন না। কাগজে কলমে মালিকানায় যার নাম রয়েছেন, বাস্তবে তিনি অন্যজনের কাছে বেশি টাকায় কারখানা ভাড়া দিয়েছেন। কারখানার কোনোটাতে লোকজন নেই, আবার কোনোটাতে কাজে ব্যস্ততার মধ্যে দম ফেলার সময়টুকুও নেই শ্রমিকদের। কিছু কারখানায় খাদ্যপণ্য তৈরি হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখা গেছে সরিষার তেল উৎপাদন কারখানায়। মুড়ি কারখানায় তৈরি করা মুড়ি চোখের পলকেই মোটা ও চকচকে-ঝকঝকে সাদা করা হচ্ছে। বস্তায় ভরে এসব মুড়ি গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন বাজারের দোকানে।
সূর্যমুখী মুড়ি কারখানার মালিক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি ও আমার ছোট ভাই মমিন উদ্দিন আহমেদ মিলে এই কারখানাটি চালাচ্ছি। কয়েক বছরের ব্যবধানে বিসিকে মুড়ির কারখানা বেড়েছে। বিসিকের বাইরে অন্তত ১০টা মুড়ির কারখানা রয়েছে। এতে আশানুরূপ মুড়ি বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার কারখানায় ১২ জন শ্রমিক রয়েছে। তাদের প্রত্যেককে প্রতি মাসে ১৩ হাজার টাকা বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছি। ভালো মুনাফা পেতে অন্য মুড়ির মালিকরা হাইড্রোজ ও ইউরিয়া মেশানো পানি মুড়িতে ব্যবহার করছে কি না আমার জানা নেই। তবে আমার কারখানায় এগুলো ব্যবহার করা হয় না। মুড়ির স্বাদ বাড়াতে ও সাদা চকচকে করার উদ্দেশ্যে পানির সঙ্গে লবণ মিশিয়েছি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ঠিক করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিল্প-কারখানা স্থাপন না করে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখলেও বিসিকের কালো তালিকায় এসব প্লট মালিকের কোনো নাম নেই। ফলে অসাধু প্লট মালিকরা বরাদ্দের প্লট নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এতে নতুন উদ্যোক্তারা বিসিকের কোনো প্লট পাচ্ছেন না। এছাড়া সরকারি সব নিয়ম রক্ষা করে খাদ্যপণ্য উৎপাদন করা হয় না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান আসার খবর পেলে তড়িঘড়ি করে কারখানার পরিবেশ ভালো করার চেষ্টা করা হয়।
লাজিজ কারখানার মালিক মাহমুদুল হাসান। কারখানায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে কারখানার ম্যানেজার মো. জামাল বলেন, এই প্লটটি আরেকজনের নামে বরাদ্দ। আমাদের মালিকের কাছে গত ৩ মাস আগে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসে ভাড়া ৫০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে।
ঢাকা মিষ্টি মুখের কর্মচারী মো. সাগর বলেন, ভালো বেচাকেনা হয়। আমাদের কারখানার পরিবেশ অন্যান্য কারখানার চেয়ে ভালো। তবে আরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হবে।
স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত বিসিকে অভিযান চালাচ্ছে। এতে কারখানার মালিককে জরিমানার আওতায় আনা হয়। তবে অনেক কারখানার খাদ্যপণ্য বাজারে জনপ্রিয় হতে পারছে না। কারণ, এগুলোর গুণগত মান তেমন ভালো না। কারখানা চালাতে হলে সরকারি সব নিয়ম মেনে চালাতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটালে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, বেশি বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্যোগে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তাহলে কারখানাগুলোতে ঠিকঠাকভাবে উৎপাদন হবে।

জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি বাংলাদেশ (নাসিব), ময়মনসিংহ জেলা শাখার আহ্বায়ক ও শীরোমা রুটি অ্যান্ড বিস্কুট কোম্পানির মালিক আবু সাঈদ বলেন, ব্যবসার মন্দাভাব শুরু হয় করোনাকালীন সময় থেকে। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ব্যবসায় লাভ করতে না পেরে কিছু ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসায়ীর কাছে কারখানা ভাড়া দিয়েছে। ব্যবসায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এছাড়া সরকারি দপ্তরগুলোর সমন্বয়হীনতা ব্যবসায়ীদের ভোগান্তিতে ফেলেছে। এক দপ্তর থেকে কারখানা চালানোর সব কাগজপত্রের অনুমোদন পাওয়া গেলে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি নিরসন হবে।
তিনি বলেন, তবুও বিসিকে কারখানার সংখ্যা বেশি। অনেকে লোন নিয়ে ব্যবসা করছেন, এতেও আশানুরূপ লাভবান হতে পারছেন না। যারা নিজস্ব টাকায় ব্যবসা করছে তারাই সফলতা বেশি পাচ্ছে। এছাড়া খাদ্যে কোয়ালিটি ধরে রাখলে ব্যবসা ভালো হবেই।
বিসিক জেলা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক বিজয় কুমার দত্ত বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এক বছরে দুইটি শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়েছে। বিসিকের ভেতরে ৮তলা ভবন হবে। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরপরই ঠিকাদার পালিয়ে যায়। ২০২০ সালে শুরু হওয়া ভবনের কাজটির জন্য নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করতে হবে। এজন্য টেন্ডার হবে। এক মাসের মধ্যে কাজ আবারো শুরু হবে। প্লট নিয়ে মালিক অন্যত্র ভাড়া দিতে চাইলে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে দিতে হবে। তবে অনেকেই এমন করছে কি না খোঁজ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, জেলার মুক্তাগাছা পৌর শহরের নতুন বাজারের আগে ৫ একর জমিতে বিসিকের বাউন্ডারি দিতে মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে প্লট আকারে বরাদ্দ দেওয়া হবে। সংশোধিত লেআউট প্লান্ট ও সামনে রাস্তা হলে প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান বলেন, বিসিকে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশসহ খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রমাণ মিললে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এফএ/এমএস