ভিডিও EN
  1. Home/
  2. অর্থনীতি

সুতা আমদানি বন্ধে নতুন বিপদে পোশাক রপ্তানিকারকরা

সাইফুল হক মিঠু | প্রকাশিত: ০৭:১০ পিএম, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, কলকারখানায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানান জটিলতায় এক অন্ধকার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের শীর্ষ রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক। এমন দুর্যোগের সময়ে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করায় সুবিধা হয়েছে দেশের বস্ত্রকল মালিকদের। এতে তাদের গুদামে থাকা কয়েক হাজার কোটি টাকার সুতা সহজেই বিক্রি হয়ে যাবে। তবে নতুন করে বিপদে পড়ছেন তৈরি এবং নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকরা। এখন তাদের তুলনামূলক বেশি খরচে দেশীয় সুতা উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সুতা কিনতে হবে। নয়তো ভারত, চীন, তুরস্ক ও উজবেকিস্তান থেকে সমুদ্র পথে সুতা আমদানি করতে হবে। সমুদ্র পথে আমদানিতে আবার সময় লাগে বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় সুতা ও ভারত থেকে আমদানি করা সুতার মধ্যে প্রতি কেজিতে দামের পার্থক্য ২০ থেকে ৫০ সেন্ট। এতে পোশাক রপ্তানিকারকরা দেশে উৎপাদিত সুতার চেয়ে ভারত থেকে আমদানি করা সুতার ওপর বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছেন।

সুতা আমদানি বন্ধে নতুন বিপদে পোশাক রপ্তানিকারকরা

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমরা যেটুকু সুতা উৎপাদন করছি তা বিক্রি করতে পারছি না। এলসি ও বিনা এলসিতে ভারত থেকে সুতা আসছে। অন্যদিকে, ভারত যে দামে সুতা বিক্রি করছে তা ডাম্পিং। ফলে আমাদের উৎপাদিত সুতা গুদামে অবিক্রীত পড়ে আছে। বর্তমানে আমাদের সদস্যদের গুদামে আট থেকে দশ হাজার কোটি টাকার সুতা অবিক্রীত পড়ে আছে।’

স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তকে ‘অপরিপক্ব’ ও ‘ভুল’ বলে দাবি করেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, এর ফলে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে পিছিয়ে পড়বেন।

আরও পড়ুন

গত রোববার (১৩ এপ্রিল) ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে সুতাসহ বেশ কিছু পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস উইং। বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে আমদানির সুবিধা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর।

দীর্ঘদিন ধরে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। সংগঠনটির অভিযোগ, দেশীয় পোশাক রপ্তানিকারকরা তাদের সুতা না নেওয়ায় তারা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ভারত উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামে বাংলাদেশে সুতা পাঠানোর কারণে দেশের বস্ত্রকলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এছাড়া স্থলবন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় সুতা আনা হচ্ছে।

সুতা আমদানি বন্ধে নতুন বিপদে পোশাক রপ্তানিকারকরা

এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি এনবিআরকে নির্দেশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেয়ে এনবিআর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও এমন এক সময় এ সিদ্ধান্ত এলো, যখন ভারত তার বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন করে শুল্ক আরোপ এবং দেশের কলকারখানায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে পোশাকখাতের উদ্যোক্তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন।

করোনা মহামারির পর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দেশের স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির অনুমতি দেয়।

বিটিএমএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ১২ লাখ ১৫ হাজার টন সুতা আমদানি করেছে, যা ২০২৩ সালের চেয়ে ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের আমদানি হওয়া সুতার ৯৫ শতাংশ এসেছে ভারত থেকে। গত বছর যে পরিমাণ সুতা আমদানি হয়েছে, তা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

আরও পড়ুন

জানতে চাইলে বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উৎপাদিত সুতা কলকাতায় গুদামজাত করা হয়। এরপর সেখান থেকে সুতা বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এসব সুতা তুলনামূলক কম দামে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এ কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা দেশীয় সুতা ব্যবহার করছে না। বস্ত্র শিল্পকারখানাগুলো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটি একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত। সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। ছোট কারখানাগুলো বেশি বিপদে পড়বে।’

তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। এতদিন রপ্তানি আদেশ পেলে ১০ থেকে ২০ টন সুতা দুদিনের মধ্যে ভারত থেকে আমদানি করা যেতো। এখন উৎপাদনের সময় বেড়ে যাবে।’

সুতা আমদানি বন্ধে নতুন বিপদে পোশাক রপ্তানিকারকরা

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিটিএমএ অভিযোগ করেছে এক ট্রাকের এলসি করে আমরা তিন ট্রাক সুতা আনি। এটা কখনো সম্ভব নয়। আমাদের কাস্টমস বা ভারতে কাস্টমস কি এতই ইনইফিশিয়েন্ট, যে এটা হচ্ছে? এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের সময় দেওয়ার দরকার ছিল।’

তিনি বলেন, পোশাকশিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ৩০ কাউন্ট সুতার প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ এখন ৩ দশমিক ৪০ মার্কিন ডলার। একই সুতা ভারত থেকে আমদানি করলে ২ ডলার ৯০ সেন্ট দাম পড়ে। যে কারণে স্থানীয় মিল থেকে সুতা কেনায় আগ্রহী হন না তারা।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহায়ক কমিটির সদস্য অনন্ত ক্লথিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এনামুল হক বলেন, ‘গ্যাসের দাম বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা কীভাবে সামলাবো জানি না। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বিপদে আছেন। তার মধ্যে এ সিদ্ধান্তে উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘একদিকে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ, অন্যদিকে দেশের শিল্পকারখানায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের মধ্যে সুতা আমদানির সিদ্ধান্ত অর্থনীতিকে ক্ষতির মুখে ফেলবে। এতে লাভের লাভ কিছুই হবে না। পোশাক রপ্তানিকারকদের ওপর যখন খরচের বোঝা বাড়ছে তখন এ সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন হয়নি। রপ্তানিকারকদের আরও সময় দেওয়া যেতো।’

দেশীয় শিল্পও সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন জানিয়ে মাহফুজ কবীর বলেন, দেশীয় সুতার মিলগুলো যাতে কম খরচে সুতা উৎপাদন করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। উন্নত যন্ত্রপাতি ও শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুললে সুতার দাম কমে যাবে। তখন রপ্তানিকারকরা দেশীয় সুতা ব্যবহার করবেন।

এসএম/এমএমএআর/জেআইএম