ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

জিয়াউদ্দীন শিহাবের মৃত্যুতে: সৃষ্টিতে বেঁচে থাকার প্রত্যয়

মাহমুদ নোমান | প্রকাশিত: ০৩:৪৩ পিএম, ৩০ জুলাই ২০২৫

আজকাল গল্পের মধ্যে গল্প নেই। গল্প বলে যেসব চালিয়ে দেওয়া হয়; সেসবে প্রাণ থাকে না। আদতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি গল্পকারের ভাবনা, বোধ ও মননে সহজাত ভাবে আসা উচিত। এখানেই গল্পকারের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। সম্প্রতি জিয়াউদ্দীন শিহাব নামের একজন গল্পকারের গল্প পড়ার পর আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। আশ্চর্য হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা জিয়াউদ্দীন শিহাব আমার অনেক সিনিয়র এবং একসময়ের লিটলম্যাগ নিয়েও সহযোগী কর্মযজ্ঞে ছিলেন। এ ছাড়া এতদিন গল্প লিখেছেন অথচ আমার মতো মানুষের জানার বাইরে ছিল! আবার এখানে জিয়াউদ্দীন শিহাবও নিজেকে আড়াল করে দিয়েছেন অজানা কোনো কারণে। এসবের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে তার একমাত্র ও শেষ গল্পগ্রন্থ ‘জিয়াউদ্দীন শিহাবের মৃত্যুতে’। লেখালেখি যে একটা সাধনা, একাকী নিভৃতে জিয়াউদ্দীন শিহাবের নির্মোহ ভাবনা থেকে; এমনকি গল্পগুলোর মেসেজ ও বইয়ের নামকরণ থেকে বুঝতে পারি।

সহজাত সহজ-সরলে নির্ঝঞ্জাট আকুতিভরা টলটলে নদীর মতো অবিচল বয়ে চলে জিয়াউদ্দীন শিহাবের গল্পের ভাষা। শব্দের সাথে শব্দের যেন বন্ধনপ্রীতি আচমকা নিজ থেকে পাঠক নিজেদের নিবেদন করবে। তবে জিয়াউদ্দীন শিহাবের গল্পে যে মোচড় আড়ালে নিয়ে গিয়ে বিবিধ সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়; সেখানে পাঠকের অন্তরাত্মার বুঝ-হালহকিকত মুহূর্তে নিবিষ্ট সত্তায় আন্দোলিত করে।

‘জিয়াউদ্দীন শিহাবের মৃত্যুতে’ গল্পের বইয়ের নাম। মধ্য বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে এরকম জাত কথাশিল্পীর একমাত্র ও শেষ গল্পের বই। ভাবা যায়? কীরকম সাধক হলে গল্পের মধ্যে আত্মনিবেদনের সে মোকামে পৌঁছলে ঘোষণা দিতে পারে নিজের মৃত্যু কিংবা একমাত্র সমাগম যেন; নিজেকে উজাড় করে দিয়ে এই বইয়ে নিজের গল্পের কর্মযজ্ঞ উপস্থাপনের ইতি টেনে দিয়েছেন যেন নিজেই! বইটি পাঠ করলে যে কোনো পাঠক চাইবেন জিয়াউদ্দীন শিহাব আরও লিখুক কিন্তু সৃজনশীল মানুষ যিনি নিজ গল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা; তার ভাবনার সাথে কারো ভাবনা মিলবে না। এমনকি মেলানোও উচিত নয়। আমি মনে করি, সাধনা কারও প্ররোচনায় হয় না। হয়তো আবদার করতে পারি নাদান বালক প্রাণের মতোন।

‘জিয়াউদ্দীন শিহাবের মৃত্যুতে’ বইটি ২০১৮ সালে চৈতন্য থেকে বেরিয়েছে। ফ্ল্যাপে গল্পকারের ছবিও নেই। অর্থাৎ সচেতনভাবে রাখেননি। এবার বুঝতে পারছেন তো? জিয়াউদ্দীন শিহাবকে আবিষ্কার করতে আপনাকে গল্পগুলো পড়তে হবে। এ গল্পকারকে খুঁজেই পড়তে হবে। মুহূর্তে আপনি এ গল্পকারের টোন আর টিউনিং ধরতে পারবেন না। ওই যে বললাম আড়াল, কবিতার মতো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার মধ্যে রস ভরা পরাবাস্তবতার মোহন জালে জড়িয়ে দেওয়া গল্পের প্রাণ। জিয়াউদ্দীন শিহাবের গল্প হচ্ছে সেই জাদুকরী ফাঁদ।

বইটিতে মোট ২০টি গল্প আছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্পের শিরোনাম—‘তিন স্বর্ণশ্বাপদের রাত’, ‘ওরা’, ‘আত্মহত্যার চিরকুট’, ‘ইতিহাস হইতে আত্মরক্ষা’, ‘জিয়াউদ্দীন শিহাবের মৃত্যুতে’, ‘ছায়াদের গল্প’, ‘রোদ বিজ্ঞান’। নিশ্চয়ই গল্পগুলোর নামকরণে কিছুটা আঁচ করতে পারছেন জিয়াউদ্দীন শিহাবের গল্প বলার ঢং ও মেধার উন্মোচিত ফলক। হতাশা, অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা চরম বাস্তবতার মধ্য দিয়ে প্রকাশভঙ্গিতে উদযাপনের সৌন্দর্য-চেতনায় উদ্দীপিত উপলব্ধি জিয়াউদ্দীন শিহাবের গল্প। এ যেন হোমিওপ্যাথির ডোজ। কোন রোগের জন্য কয় ফোঁটা ওষুধ এবং বৈজ্ঞানিক বিষয়াদির প্রাঞ্জল ভাষায় যে গল্পের পরিবেশ পরিস্থিতি গড়ে দেয়, এককথায় অনবদ্য। বইয়ের শুরু দিককার ‘ওরা’ গল্পটি পড়ে অভিভূত। মনে হয়েছে কয়েকদিন আগে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনা। অথচ গল্পের বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে। অর্থাৎ গল্পটি আরও আগে লিখেছেন। লেখকরা আগামীতে কী ঘটবে; সেটারও কথা বলে যেতে পারেন। গল্পটি পড়লে বুঝবেন। বিমান দুর্ঘটনা আর আগুনে ঝলসে যাওয়া এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পরিবেশ পরিস্থিতির জ্বলজ্যান্ত সাক্ষ্য যেন।

‘শহরবাসী আমাকে সাধারণ এক মানুষ হিসাবে জানে কেননা ওদের শক্তিশালী বিমানগুলো সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখতাম না। ছোট একটা চাকরি করি। শহরের গণ্যমান্য রাস্তায় চলাটাকে আমার পক্ষে অনধিকার চর্চা বলে মনে হতো। ওরা সম্ভবত সমস্ত শহর ঘিরে ফেলেছে। এটা কোনো বিষয় হিসাবে দাঁড়াতে পারে না যখন ছোট একটা শিশু আমাকে বুঝিয়েছিল ওদের বিমানগুলো এমন শক্তিশালী যে এতে আমাদের শহরটা মুহূর্তেই জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিণত হতে পারে। আমি কি আরো কিছুটা দৌড়ে গেলাম?’ (ওরা; পৃ-১৩) উদ্ধৃতির শেষে প্রশ্নটা আতঙ্কে ঠেকিয়ে পিপাসার্ত মানুষের বাঁচতে চাওয়ার লড়াই। কিন্তু সমাজ রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিয়ে অল্প কয়েক মানুষ জনসাধারণের জীবন নিয়ে প্রতিনিয়ত তুচ্ছজ্ঞানে খেলে।

এরকম আরও একটি অর্থবহ গল্পের নাম ‘কাকতাড়ুয়া’। এ গল্পের টাচি মোমেন্ট ঘটিয়ে দেওয়ার মধ্যে প্রকৃতির রূপ-রহস্যের বর্ণনার মধ্যে চালিত করা জিয়াউদ্দীন শিহাবের গল্পের অন্যতম আকর্ষণ। জীবনের চাওয়া কিংবা প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার অতুলনীয় আকুতি এ গল্পকে বিশিষ্টতা দান করেছে। আবার জিয়াউদ্দীন শিহাবের গল্পকে একটি বিষয়ে বেঁধে রাখা দায়। একটি গল্পকে অনেক বিষয়ের দিকে নিয়ে যায় মুহূর্তে—
‘এক সময় চারিদিকে ছোপ ছোপ সন্ধ্যা, আমি হাত মুখ ধুয়েছি এবং পড়তে বসেছি। কিন্তু তারপর? তারপর কী করবো আমি? কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসার উত্তর দেয়নি এবং দেশটা কিভাবে রসাতলে যাচ্ছে এই গল্পের সুযোগ নিয়ে কেটে পড়েছে একেবারে সন্ধ্যাবেলাতেই।
আর সকলে যেভাবে বেরিয়ে পড়ে (কেন যে বেরিয়ে পড়ে? কোন গূঢ় গন্তব্য থাকতে হয়তো)। কই আমি তো সে রকম বেরিয়ে পড়ছি না। এই সব সাত সতেরো ভাবনা মাথায় নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। তারপর হাঁটতে থাকলাম আর হাঁটতে থাকলাম যতক্ষণ না পাড়ার মুদির দোকানদার বুড়োটা আমাকে দেখে ফেললো। অন্যদের মত আমিও আশা করতাম পালিয়ে যাওয়া কাকতাড়ুয়াটা আবারো ফিরে আসবে। কিন্তু একদিন সন্ধ্যায় মনে হলো, জানি না কতদিন পর মনে হলো, সে আর ফিরছে না। ভালোমতো ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে অনেক অপেক্ষার পরও সত্যি সত্যি সে ফিরে এলো না। তো, কী আর করা নিজেকে ভূমির সঙ্গে দৃঢ় করে ফেললাম। এভাবে এতদিন অবশ্য আমার বেঁচে থাকবার কথা নয়, তবুও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আমি এখনো পুরোটা মরে যাইনি। এখন আমি জেগেও থাকি না, ঘুমিয়েও পড়ি না। আমার না আছে চলা, এখন না আছে কিছু বলার প্রয়োজন। হাড়ি গোমড়ামুখো হয়ে শুধু রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকি।’ (কাকতাড়ুয়া; পৃ-২৪)

জিয়াউদ্দীন শিহাবের গল্প যেন উত্তরাধুনিক কবিতা। প্রতিটা শব্দের ওজন অনেক এবং বিবিধ অভিধা পেয়ে সচল ও অন্তর্ভেদী। এ বইয়ের নামগল্প ‘জিয়াউদ্দীন শিহাবের মৃত্যুতে’ গল্পকারের সিগনেচার। গল্পটিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন কিংবা সামর্থ্যের সবটুকু জড়ো হয়েছে এ গল্পে। গল্পের মধ্যে আলাদা আলাদা পরিচ্ছদে আলাদা নামকরণে এ গল্পের যে জগৎ তৈরি করেছেন; সেটি পাঠকের মাথায় থেকে যাবে অনেকদিন। গল্প নিয়ে নিরীক্ষার এ পরিকল্পনা রসময় ভাষার বুননে ভিন্নরকম আবহ তৈরি করে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিবীড়ে নিয়ে দেখার যে সামর্থ্য সেটি উল্লেখযোগ্য—
‘আমি সেই লাশকে ছিনিয়ে নিতে চাইলাম যেন, কী যেন একটা ভালোবাসা, বহু পুরনো কোনো স্নেহাস্পদ ঘটনা, অথচ একটা অতৃপ্ত ক্ষুধার প্রতিরোধে, তার থাবায় থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হবে, রক্ত উন্মাদের অন্তর্ধুমে উষ্ণয়। আবারো সেই লাশকে ছিন্ন ভিন্ন করে খুঁজে ফেরা হৃৎপিণ্ড শকুন আর শৃগাল। একসময় টুকরো টুকরো অস্থিমজ্জা সমাধিস্থ করে মিলিয়ে যাওয়া, বেদনার্ত বুকের ব্যথা, তারপর সেখানেই ঘুমিয়ে পড়া শান্ত নিরবধি।
আর আমার ভিতরে নরমাংসভুকের সমস্ত গর্জন নির্বাণ হতেই আমি এসে দাঁড়াই সেই কবরের কাছে। তার অন্তরিত বাসিন্দা—যেন খুব বেশি বেশি করে ভালোবাসা-সময়ের সেই খেলাগুলো—তৃষ্ণার্ত চোখ—অনুশোচনায় লক্ষ লক্ষ কীট—
আর, আর আমাদের জন্ম হয়েছিল সমাধিস্থ হওয়ার পরই।’ (জিয়াউদ্দীন শিহাবের মৃত্যুতে; পৃ-২৭ ও ২৮)

প্রবল কল্পনাশক্তি, তীক্ষ্ণ যুক্তি ও ইঙ্গিতময় বোধে জিয়াউদ্দীন শিহাবের গল্প বাংলা সাহিত্যে গল্প পাঠকদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে এই বিশ্বাস রাখি। উপর্যুক্ত উদ্ধৃতির শেষ কথা ছিল সমাধিস্থ হওয়ার পরেই একজন কীর্তিমানের জন্ম শুরু অর্থাৎ কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। সেটি আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয়। নিজের সৃষ্টিতেই বেঁচে থাকতে চান এ শক্তিধর কথাশিল্পী। আশা করি বইটি সবার ভালো লাগবে। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।

বইয়ের নাম: জিয়াউদ্দীন শিহাবের মৃত্যুতে
লেখকের নাম: জিয়াউদ্দীন শিহাব
প্রকাশনী: চৈতন্য প্রকাশন
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
মূল্য: ২০০ টাকা।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন