বই আলোচনা
আমাকে নেয়নি কোনো নিঃসঙ্গ পায়রা: ঐশ্বরিক প্রেমের প্রলেপ
অনন্য কাওছার
কবি আবু ইউসুফের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমাকে নেয়নি কোনো নিঃসঙ্গ পায়রা’। পুরো কাব্যের কলেবরে ঐশ্বরিক প্রেমের প্রলেপে শুদ্ধস্বর উচ্চারিত হয়েছে। গঠনপ্রকৃতি ও সিদ্ধহস্তের নৈপুণ্যে কাব্যদর্শন হয়ে উঠেছে জীবন্ত বীজের উন্মীলন স্বরূপ। সাবলীল প্রকাশভঙ্গির শৈল্পিক রূপায়নের ফলে অন্তর্লোকের অস্থিরতা প্রতিটি কবিতায় সজীব, উজ্জ্বল। দুর্বোধ্য শব্দচয়ন নেই বলে গ্রন্থানুভূতি পাঠকমহলেও হয়ে উঠবে প্রণয়ের নিরেট দর্পণ। প্রেমের পর ভাঙনের মর্মন্তুদ হাহাকার কয়েকটি পঙক্তিমালায় ধরা পড়েছে। কবির ভাষায়, ‘আমার হৃদয় পুড়ে যাওয়ার গন্ধে তোমার চোখে লেগে আসা ঘুম/ এইমাত্র ভেঙে গেছে।/ তোমরা আবার ঘুমিয়ে পড়ো, তোমাদের বিশ্রাম দরকার।’ অবশ্য দীর্ঘকাল বিরহপ্রবণতায় কবি নিমজ্জিত থাকেননি। ঘুরেফিরে পুনর্গঠনের প্রতীকী সংকেত কাব্যের ভাঁজে অঙ্কিত করেছেন।
তিনি এক নিঃসঙ্গ পায়রার কবি। দক্ষ অনুবাদক হিসেবেও পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। বিশেষত অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে তার কিছু অনূদিত কবিতা পাঠে বিমুগ্ধ হয়েছি। আরবি ভাষা থেকে বিভিন্ন কবির কবিতা তিনি অনুবাদ করেন। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও শৈল্পিক কাজ। শিগগিরই অনুবাদের কবিতাগুলো গ্রন্থিত হবে বলে আশাবাদী। আবু ইউসুফের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ পড়ে যেটুকু উপলব্ধি করেছি; তার আংশিক আলোচনা করবো।
কবিতার গঠনপ্রকৃতি ও কাব্যচিন্তায় তিনি স্বকীয় আঙ্গিক তৈরি করেছেন। শব্দচয়ণে দুর্বোধ্যতা পরিহার করেছেন। ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও অনুভূতি সাবলীলভাবে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন, তবে শৈল্পিকভাবে। প্রযুক্তির যুগে সাহিত্যের চর্চা বা কবিতা পাঠের আগ্রহ কমেছে, এটি কোনোভাবে অস্বীকার করতে পারি না। তরুণ-তরুণীদের প্রবল কৌতূহলের জায়গা দখল করেছে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া। সেখানে কবিতা বা বই পড়ানোর অভিনব কৌশল অবলম্বন যারা করেন, তাদের মধ্যে আবু ইউসুফ অন্যতম।
তিনি কবিতায় সাবলীল ভাষায় গভীরতম উপলব্ধি প্রকাশ করতে জাগ্রতচিত্ত। অবশ্য শৈল্পিকতার সঙ্গেই করেন। জটিলতা যারা পছন্দ করেন; তাদেরও সমালোচনা হজম করেন সানন্দে। তবুও পাঠকের সামনে প্রফুল্লচিত্তে হাজির হন। কখনো কবিতা পাঠের আসর বসানো, কখনো আবার ইলেকট্রনিক ম্যাগাজিন, কখনো প্রিন্টেড দিয়ে পাঠকের অন্তর্লোকে জায়গা করে নিচ্ছেন। বিষয়টি আমার নজর কেড়েছে।
আবু ইউসুফ শাশ্বত প্রেমের কবি ও দক্ষ অনুবাদক। তার কাব্যচিন্তা স্বাতন্ত্র্যিক এবং প্রকাশভঙ্গি শৈল্পিক। সাবলীল, সহজবোধ্য শব্দচয়ন ও নান্দনিক চিত্রকল্পে তিনি কবিতাকে অসামান্য উচ্চতায় সমাসীন করেন প্রতিবার। কবিতার ভাষারীতি ও গঠনশৈলীর চমৎকারিত্বে সফেদ উপলব্ধিও তার সিদ্ধহস্তে হয়ে ওঠে অসামান্য। কাব্যভাষা সাবলীল, অথচ গভীরতায় সবুজ উদ্যানের মতো সুশ্রী। প্রেম ও বিরহকাতরতা তীব্র হলেও তিনি মর্মন্তুদ হাহাকার বিলাপে সুকৌশলী।
গ্রন্থটির অন্যতম একটি কবিতা ‘মৃত ধূলিকণা’। এ কবিতায় আত্মিক ভাবাদর্শ স্বমহিমায় উদিত হয়েছে। তার কাব্যচিন্তায় আত্মিক ও মানবিক বোধের দ্বান্দ্বিক অনুভব ক্রমান্বয়ে অন্তর্গূঢ় চেতনার নৈশপ্রহরী হয়ে উঠেছে। নান্দনিক উপমার প্রলেপে প্রতীকী উচ্চারণ করেছেন এভাবে—‘কাফনের মত ধবধবে চাঁদ/ অস্পষ্ট আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখে/ এ শহরের আত্মা।’ অপরদিকে শাশ্বত প্রেমের আবেশে কবি হয়ে উঠেছেন প্রণয়ের যুবরাজ। কাব্যজুড়ে ঘোমটাপরা দস্যিবালিকার দোলাচল পঙক্তির কলেবরে এনেছে রাজকীয় মহোৎসব। গ্রন্থের কয়েকটি পঙক্তির দিকে আলোকপাত করলে খানিকটা ধারণা পাবেন। ‘তুমি নিঃশব্দে ফুটে ওঠো’ কবিতায় কবি লিখেছেন—
তোমার শাড়িতে ফুল নেই,
অথচ তুমি রাস্তায় হাঁটলেই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
কবিতার প্রকাশভঙ্গী সহজাত। অথচ গভীর উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কোনো কোনো কবিতার মধ্যে দার্শনিক উপলব্ধির প্রকাশ দেখতে পাই। যেমনটা মির্জা গালিবের কবিতায় দেখি।
আরও পড়ুন
পাপ ও পদ্মের পিঞ্জর: কৃষিজীবী জীবনের আখ্যান
অনন্ত সংগ্রাম: ঘাত-প্রতিঘাতের জীবন
তিনি কয়েকটি কবিতায় গভীর ভাবাদর্শের অকৃত্রিম ছাপ রেখেছেন স্বমহিমায়। কবিতাগুলোর মধ্যে অবলীলায় উন্মীলন হয়েছে কাব্যদর্শনের পরিপক্বতা। কয়েকটি পঙক্তি তুলে ধরলাম—
১.
তারপর আমি অনেকদিন ধরে
চুপ থেকেছি,
ঠিক ততটাই, যতটা একজন অন্ধ মানুষ
আলোর ব্যাখ্যা শুনে হেসে নেয়। (অন্ধ আলো)
২.
আমি তাকিয়ে থাকি আর দেখি
কীভাবে তোমার চোখে জ্বলে ওঠে
কোনো অশ্রুত গান,
যার প্রতিটি স্বর এক এক করে খুলে দেয় আমার অন্ধ দরজা। (তোমার শরীরে সন্ধ্যা নামে)
৩.
তুমি এলেই ঘর বদলে যায়,
কান্না বদলে রক্ত হয়, চুমু বদলে আঘাত
... ...
আমার ভিতরে জেগে ওঠে শরীরী কোনো ঈশ্বরী—
যার প্রতিমা গড়া হয় তোমার ঘামে, দাগে, গভীর ক্লান্তিতে
তোমার স্তনের পাশে মাথা রাখলে শুনি ইতিহাসের কান্না (মদিরার মাতাল নৃত্য)
এরপর আর বলার দরকার পড়ে না আবু ইউসুফের কাব্যদর্শনের উৎকর্ষতা কতখানি গভীর। দুর্বোধ্য শব্দচয়ন ছাড়াও যে গভীরতম উপলব্ধি শৈল্পিকভাবে কাব্যে অঙ্কিত হয়, পাঠকও বিমোহিত হন অবলীলায়, এর প্রামাণ্য চিত্র তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। কাব্যের উপজীব্য বিষয়গুলো হচ্ছে—শাশ্বত প্রেমের শুদ্ধস্বর, ভাঙনের অস্থিরতা, অন্তর্লোকের কম্পমান উচ্চারণ, প্রণয়কাতর অভিমান। বিশেষত, আবু ইউসুফের কবিতাগুলোতে প্রেম আছে, তবে দৈহিকের উর্ধ্বে প্লেটোনিক। অপরদিকে বিরহ আছে, তবে বিরহবিলাপের চেয়ে পুনর্গঠনের। কয়েকটি পঙক্তিতে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক অনুকল্পের অনুসন্ধান উপস্থিত। তবুও যেন প্রেমের আবেশে সেইসব আড়ালেই থেকেছে, এটি পর্যবসিত হলে আরেকটু সমৃদ্ধ হতো। গ্রন্থের শিরোনামে বিরহপ্রবণতার সুর বেজে উঠলেও কাব্যের কলেবরে আপাদমস্তক ঐশ্বরিক ও মানবীয় শাশ্বত প্রেমের রূপায়ণ অঙ্কিত হয়েছে। কোথাও বেদনার কোরাস ধ্বনিত হয়েছে, কোথাও আবার নিঃসঙ্গতা, মর্মন্তুদ হাহাকার, উৎকণ্ঠা বিসর্পিল সাপের মতো জড়িয়ে রয়েছে। প্রারম্ভিক কবিতাগুলোর মধ্যে প্রগাঢ় প্রণয়, শেষাংশে ধীরগতিতে বা কচ্ছপের মতো মন্থরে জায়গা করে নিয়েছে বিষাদের ছাপ।
গ্রন্থটিতে মোট ৩৯টি কবিতা রয়েছে। নামকরণও নিঃসন্দেহে অনবদ্য এবং প্রতীকী উচ্চারণ। কাব্যের নামকরণ ও প্রতিটি কবিতার পৃথক নামকরণে কবি মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। পাঠকমহলে কৌতূহল উদ্রেককারী নামকরণ। গ্রন্থের কবিতাগুলোকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করে পৃথকভাবে উপশিরোনামে মুড়েছেন, যেমনটি কবি আহসান হাবীবের ‘রাত্রিশেষ’ কাব্যে প্রথম অবলোকন করি। আহসান হাবীব তাঁর কাব্যের পর্বগুলো আদ্যাক্ষর ‘প’ দিয়ে করলেও আবু ইউসুফের সূচিপত্রের পর্বগুলো ভিন্নধর্মী ও দীর্ঘাকায়। তিনি আদ্যাক্ষরের মিস্ট্রি থেকেও চমৎকৃত উপশিরোনাম বাছাইয়ে সচেষ্ট থেকেছেন। নিশ্চয়ই প্রশংসনীয় কাজ। প্রচ্ছদ শিল্পী উসমান আল আহনাফ। তার প্রচ্ছদ নির্মাণও দৃষ্টিনন্দন।
পাঠকমহলে বিমুগ্ধতা ছড়াবে আবু ইউসুফের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আমাকে নেয়নি কোনো নিঃসঙ্গ পায়রা’। মানুষের মধ্যে গভীরভাবে বইপড়ার প্রবণতা তৈরি হোক। বই পড়ুন, বই পড়ান। বইয়ের আলোচনা করুন।
বই: আমাকে নেয়নি কোনো নিঃসঙ্গ পায়রা
কবি: আবু ইউসুফ
প্রকাশক: ঋতুরঙ্গ প্রকাশন
প্রচ্ছদ: উসমান আল আহনাফ
মূল্য: ২৪০ টাকা
এসইউ