রক্তের বাঁধনে ভালোবাসার গল্প

ফাহিম হাসনাত
পুরান ঢাকার লাল ইটের দেয়ালে ঘেরা ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রই নয়, এটি মানবিকতারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রোথিত রয়েছে এক গভীর সংবেদনশীলতা, যা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হয়। তেমনই একটি অনন্য উদ্যোগ হলো ‘বাঁধন’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন; যারা প্রতিনিয়ত ভালোবাসার বন্ধনে মানবিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঁধনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর শাখা গড়ে ওঠে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঁধন শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে। মো: নয়ন মিয়া এবং তার কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ সহপাঠী বন্ধুর হাত ধরে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ তা ৫০০ জনেরও বেশি সক্রিয় সদস্যের এক বিশাল পরিবার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
প্রতিষ্ঠাকালীন বাঁধনের জন্য কোনো অফিস বরাদ্দ ছিল না। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ মাসিক সভাগুলো ক্যাম্পাসের কাঠালতলার খোলা জায়গায় আয়োজিত হতো। বাঁধনের মূল কাজ হলো স্বেচ্ছায় রক্তদানের প্রচার, সংগঠন ও জরুরি রক্ত সরবরাহ। এটি মূলত তিনটি ধাপে কাজ করে-সচেতনতা বৃদ্ধি, রক্তদাতা সংগ্রহ এবং জরুরি রক্ত সরবরাহ।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষার্থীদের মধ্যে রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করা এবং একটি শক্তিশালী ডাটাবেস তৈরি করা এর অন্যতম প্রধান কাজ। এছাড়া রক্তের প্রয়োজন হলে স্বেচ্ছাসেবকরা দ্রুত রক্তদাতার সঙ্গে রোগীর পরিবারের সংযোগ ঘটান।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঁধন প্রতি বছর ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং ক্যাম্প, রক্তদান কর্মসূচি ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতায় নানান কাজ করে থাকে। বিভিন্ন সময় থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ, হেপাটাইটিস বি ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচারণামূলক সেমিনার আয়োজনের এজেন্ডা গ্রহণ করে থাকে সংগঠনটি।
বিজ্ঞাপন
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই নয়, আশেপাশের সাধারণ মানুষকেও রক্তদান সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে সংগঠনটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এ পর্যন্ত হাজারো ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহ করেছে জবি বাঁধন, যা অসংখ্য জীবন বাঁচাতে সহায়তা করেছে। করোনা চলাকালীনও রক্তদানের ক্ষেত্রে তারা বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। সেসময় মানুষ ঘর থেকে বের হওয়ার ভয়ে হাসপাতালে গিয়ে রক্তদানে আগ্রহ প্রকাশ করছিল না। নানান প্রতিবন্ধকতা থাকলেও, বাঁধন কর্মীরা তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। করোনা মহামারির সময় কর্মীদের সিংহভাগ ঢাকায় না থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১০৮৭ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে সংগঠনটি। এছাড়াও প্রতিবছর থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য নিয়মিত রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহ বাঁধনের অন্যতম বড় উদ্যোগ।
বাঁধনের স্বেচ্ছাসেবীরা কোনো ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়াই শুধু মানবিকতা ও ভালোবাসার টানে এই কাজে যুক্ত হন। তারা বিশ্বাস করেন, ‘এক ব্যাগ রক্ত মানে একটি জীবন।’ তাদের কাজ শুধু রক্তদানে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার এক অনন্য মঞ্চ হিসেবে কাজ করছে। বাঁধনের সদস্যরা শিক্ষাজীবনে স্বেচ্ছাসেবার অভিজ্ঞতা অর্জন করে ভবিষ্যতে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পান।
বাঁধন সম্পর্কে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক তাসলিমুল হাসান নিশাদ বলেন, ‘বাঁধন শুধু একটি রক্তদাতাদের সংগঠন নয়, এটি একটি পরিবার, যেখানে আমরা মানবতার সেবা করতে একতাবদ্ধ হয়েছি। আমাদের লক্ষ্য শুধু রক্ত সংগ্রহ করা নয়, বরং রক্তদানের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করা, যাতে কেউ আর রক্তের অভাবে প্রাণ না হারায়। আমরা বিশ্বাস করি, ‘এক ব্যাগ রক্ত মানে একটি জীবন।’ তাই কেউ যদি রক্তের প্রয়োজন নিয়ে আমাদের কাছে আসে, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে রক্তের ব্যবস্থা করতে।’
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার ব্যাগ রক্ত দান করতে সক্ষম হই। এরপরেও আমাদের কিছু ঘাটতি রয়েছে যেগুলো আমরা কাটিয়ে উঠতে চাই। প্রতিবছর আমাদের সংগঠন থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের ব্লাড গ্রুপিং করে থাকি যা সংখ্যায় প্রায় ২/৩ হাজার। এক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষার জন্য আমাদের অনেক রিএজেন্ট প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রশাসন থেকে প্রতিবছর যা বরাদ্দ থাকে তা পর্যাপ্ত নয়। প্রশাসন থেকে আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি পেলে আমরা আমাদের কাজগুলো আরও সুষ্ঠু-সুনিপুণভাবে করতে পারব।’
যারা রক্তদানে ভয় পান, তাদের উদ্দেশে বাঁধনের বার্তা-‘এই দানে ক্ষতি নয়, বরং উপকারই হয়। এক ফোঁটা রক্ত দিতে গিয়ে কেউ জীবন হারায় না, বরং কেউ নতুন জীবন ফিরে পায়। আজ আপনি কাউকে বাঁচাবেন, কাল কেউ আপনাকে।’
‘বাঁধন’ আজ শুধুই এক রক্তদাতা সংগঠন নয়, বরং এক মানবিক চেতনার নাম, যেখান থেকে ঝরে পড়ে ভালোবাসা, আত্মত্যাগ আর মানবিকতার গল্প।
বিজ্ঞাপন
লেখক: ফিচার ও কলাম লেখক
কেএসকে/জেআইএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন