বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস
শিশুর ঘামে ঘুরছে কারখানার মেশিন

ধীরে ধীরে ছবিটির দিকে তাকালে চোখ আটকে যায়। গাঢ় নীল একটি জিন্স, পরনে একটি পুরোনো টি-শার্ট। হাতে নেই কলম, গায়ে নেই স্কুলড্রেস, কাঁধে নেই ব্যাগ। বিনিময়ে তার হাতে ধরা একটি ড্রিল প্রেস মেশিন। দুই হাতে শক্ত করে ধরে সে ফুটো করছে লোহার রডে। ছবিটি যেন নীরবে বলে ওঠে ‘আমি জীবনের হোমওয়ার্ক করছি!’
এই হৃদয়বিদারক ছবিটি ২০২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর ইউনিসেফ বাংলাদেশ তাদের অফিসিয়াল পেজে প্রকাশ করে। ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘পারিবারিক আয়ে সহায়তা করার জন্য শিশু শ্রম কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়, বরং এটি একটি অপরাধ।’ এই বাক্যগুলো শুধুই কিছু শব্দ নয়, এগুলো আমাদের সমাজের এক নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
আজ ১২ জুন, শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে বিশ্ব দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উদ্যোগে ২০০২ সাল থেকে দিনটি পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। তবে এটি কোনো উৎসবের দিন নয়। বরং একটি কঠিন প্রশ্ন তোলার দিন, কেন এখনো একটি শিশু স্কুলে না গিয়ে খাবারের হোটেলে কাজ করছে? কেন সে বইয়ের পাতায় হাত না বুলিয়ে গ্যাসের চুলার পাশে রুটি সেঁকে? কেন সে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা না করে কারখানায় লোহার রড ছুঁয়ে দেখে?
বাংলাদেশে এমন হাজার হাজার শিশুর গল্প আছে, যাদের জন্ম যেন কেবল টিকে থাকার লড়াইয়ের জন্য। কারো বাবা দিনমজুর, কারো মা গৃহকর্মী, আবার কারো বাবা-মা কেউই নেই। এই শিশুরা কিশোর হবার আগেই বড়দের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়। অথচ তাদের হাতে থাকা উচিত ছিল বই, খাতা, কলম। থাকা উচিত ছিল স্বপ্ন।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
তাহলে কি শিশুশ্রম শুধুই দারিদ্র্যের ফল? একদমই না। এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো জটিল কারণ। অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব, শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা, সমাজের নীরবতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে নিয়োগকারীদের নিষ্ঠুরতা। শিশুশ্রমকে অনেকেই ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেন এই বলে ‘ও কাজ না করলে তার পরিবার চলবে না।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটি শিশু দিনে কত টাকা আয় করছে আর তার বিনিময়ে কত কিছু হারাচ্ছে?
একজন শিশু হয়তো দিনে ১০০ থেকে ২০০ টাকা আয় করছে। কিন্তু সে হারাচ্ছে তার শৈশব, খেলাধুলা, স্বপ্ন, আর সবচেয়ে বড় কথা শিক্ষার অধিকার। এই ক্ষতিটা শুধু তার একার নয়, গোটা জাতির। আমরা হারাচ্ছি একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ, একটি সুন্দর আগামী।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে শ্রমে নিয়োগ করা সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু বাস্তবে এই আইন যেন কেবল পোস্টার বা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। ইটভাটা, কারখানা, চায়ের দোকান, হোটেল-কিচেন, কিংবা ওয়ার্কশপ প্রায় সবখানেই কমবেশি শিশু শ্রমিকের দেখা মেলে। এই শিশুরা পড়ালেখা ভুলে, ছোট্ট হাতে গড়ে তুলছে সমাজের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ হচ্ছে ক্লান্ত, ক্ষয়ে যাওয়া, স্বপ্নহীন।
সমাধান চাইলে পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। প্রথমেই পরিবারকে বোঝাতে হবে শিশুদের কাজে নয়, পাঠাতে হবে স্কুলে। সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এসব পরিবারকে সহায়তা করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে হতে হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, আরও সহনশীল। পাশাপাশি, সমাজের প্রতিটি নাগরিককে সচেতন হতে হবে শিশুদের অধিকার নিয়ে এবং অবশ্যই, যারা শিশুশ্রমকে উৎসাহিত করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
ছবির সেই ছেলেটি যদি কাজ ফেলে নিয়মিত পড়াশোনা করতো, তাহলে তার টেবিলে থাকত খাতা, হাতে থাকত কলম, চোখে থাকত আরও বড় হওয়ার স্বপ্ন। হয়তো সে ভাবত, একদিন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক কিংবা সমাজের আলোকিত মানুষ হবে। কিন্তু ছবিটি আমাদের সামনে তুলে ধরে এক নামহীন শিশুশ্রমিককে। যার শরীর বেয়ে ঝরে পড়ছে ঘাম, যার নরম হাত পরিশ্রমে শক্ত হয়ে উঠছে, যার চোখজোড়া কেবল ক্লান্তি বহন করছে।
বিজ্ঞাপন
এই চোখগুলো যেন আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এই ১২ জুন হোক প্রশ্ন তোলার, প্রতিবাদ গড়ার, শিশুর হাতে কলম তুলে দেওয়ার দিন।
আরও পড়ুন
তথ্যসূত্র: ইউনিসেফ বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, বাংলাদেশ শ্রম আইন- ২০০৬।
বিজ্ঞাপন
কেএসকে/এমএস
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন