বাবা দিবস
বাবার প্রতি অসমাপ্ত ভালোবাসা

মাইফুল জামান ঝুমু
বিখ্যাত লেখক জাস্টিন রিকলেফস বলেন, ‘সন্তানের জীবনে একজন বাবার শক্তি তুলনাহীন।’ পিতৃত্বের গুরুত্ব নিয়ে তার এ মহান চিন্তাধারা বর্তমান সময়ের জন্যও অনেকটা প্রাসঙ্গিক। একজন বাবার ভূমিকা সন্তানের জীবনে অপরিসীম। এটি কেবল আর্থিক কিংবা শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বই নয়; বরং সিক্ত ভালোবাসা ও আবেগময় মানসিক সমর্থনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। ‘বাবা’_ একজন ছেলের প্রথম নায়ক, একজন মেয়ের প্রথম ভালোবাসা। স্নেহ, ভালোবাসা, শাসন আর কাঁধ ভরা এক দায়িত্বের সমষ্টি হলো বাবা।
বাবা হলো বুক দিয়ে আগলে রাখা এক ভরসার জায়গা। বিপদে আপদে বটবৃক্ষের মতো এক আশ্রয়স্থল। তাই তো বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু খারাপ বাবা একটাও নেই।’ একজন মানুষ যত খারাপই হোক না কেন, বাবা হিসেবে সে হয়ে ওঠে এক আদর্শবান ব্যক্তিত্ব। সন্তানকে আগলে রাখার ক্ষেত্রে প্রত্যেক বাবার জীবনে রয়েছে একেকটি সংগ্রামের গল্প। আবার প্রত্যেক বাবাকে নিয়ে তাদের সন্তানের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আবেগমাখা গল্প।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
আমার জীবনেও আমার বাবাকে নিয়ে রয়েছে এক অসমাপ্ত গল্প। এটাকে অসমাপ্ত গল্প বলছি এই কারণে, যে মানুষটা আমাদের আগলে রাখার জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন তাকে একটিবারের মতোও ‘ভালোবাসি’ শব্দটি বলতে পারিনি। যে মানুষটা সারাদিন ডুবে থাকত পত্রিকার পাতায়। আজ তার মেয়ের অর্ধশত লেখা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়, অথচ বাবা সেটা দেখে যেতে পারেননি। হয়তো অন্য লেখকদের বাবার মতো আমার বাবাও এতদিনে তার মেয়ের প্রকাশিত লেখাগুলো সংগ্রহ করতেন। সবার কাছে বুক ফুলিয়ে বলতেন, ‘এটা আমার মেয়ের লেখা’। কিন্তু বাবার থেকে এমন বুলি শোনার আগেই পৃথিবীর মোহ ত্যাগ করেন। আর বিচ্ছেদের বেদনাভরা শৈশব এখনো আমার স্মৃতিতেই পড়ে থাকে।
আমার জীবনে আমার বাবা ছিলেন এক অন্যরকম পথপ্রদর্শক। ছোটবেলা থেকে বাবাকে অসুস্থ অবস্থাতেই দেখে আসছি। তাই বাবার সঙ্গে ঘুরতে কিংবা বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি তেমন মনে নেই। তবে বাসায় বসে বাবার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো ছিল অসাধারণ। অসুস্থতার কারণে বাবা তেমন বাইরে যেতে পারতেন না বলে আমার আর ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব ছিল বাবার। পৌষের শীতে বাড়ির উঠানে মাদুর বিছিয়ে নতুন বইয়ে মোড়ক লাগানো, স্কুলের পড়া, পরীক্ষা শেষে বাড়িতে এসে প্রশ্নপত্র দেখানো- সবই হতো বাবার কাছেই। বাবা আমাদের একাডেমিক পড়ার পাশাপাশি অনেক সমসাময়িক বিষয় নিয়েও আলোচনা করতেন।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
পড়াশোনার প্রতি আমাদের চেয়ে বাবার বেশি আগ্রহ দেখে ভালোই লাগত। বাবা সারাদিন বাসায় থাকতেন বলে আমাদের পুরো সময় বাবার সঙ্গেই কাটত। বাবাকে অজুর পানি এনে দেওয়া, টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখা ইত্যাদি ছিল আমাদের কাজ। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়তেন, তখন বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে ওঠত। রাতের বেলায় ঘুমের মাঝে যখন দেখতাম বাবার শরীর খারাপ লাগছে, তখন ঘুম ভেঙে দোয়ার বই নিয়ে সুরা পড়ে বাবার গায়ে ফুঁ দিতাম। বাবা হাসপাতালে গেলে সারাদিন আতঙ্কের মাঝে কাটাতাম। এই বুঝি বাবার কোনো খারাপ খবর চলে আসে।
তবে খুব শিগগির যে এ আতঙ্কের অবসান ঘটবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। তখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়তাম, বাবার হার্টের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় আবারও হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। হাসপাতালে যাওয়ার পর রাতে আমি বাবাকে দেখতে যাই। তারপর হাসপাতাল থেকে বাবার থেকে বিদায় নেওয়ার পর বাবা কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু এ ঘুম ভেঙে যে বাবার সকাল হয়নি, হয়েছে পরকাল। আর বাবার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো পড়ে থাকলো স্মৃতির পাতায়।
বিজ্ঞাপন
আমার বাবা শুধু একজন বাবাই নন, বরং একজন যোদ্ধা। একজন শিক্ষক, একজন পথপ্রদর্শক। ছোটবেলা থেকে বাবাকে ভালো পোশাক পড়তে খুব কমই দেখেছি। সন্তানকে হাসিমুখে রাখতে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমার বাবা ছিলেন আমার আদর্শ, আমার অসমাপ্ত ভালোবাসা। বাবার জীবনের সমাপ্ত হলেও বাবার প্রতি আমার ভালোবাসা কোনোদিন যেন সমাপ্ত না হয়। বাবা দিবসে এ আমার প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কালচার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কেএসকে/জেআইএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন