আজ অটিস্টিক শিশুকে নিয়ে গর্ব করার দিন

সানজানা রহমান যুথী
অটিজম যেন এক আতঙ্কের নাম। কারো সন্তান যদি অটিস্টিক হয়, তখন পরিবারে এক অদৃশ্য চাপ নেমে আসে। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এমনকি কখনো কখনো বাবা-মাও একে অভিশাপ বলে মনে করেন। অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং সামাজিক চাপ এই তিনটি কারণে এখনো বাংলাদেশে অটিজমকে ‘দূরারোগ্য’ কিংবা ‘অস্বাভাবিক’ বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ অটিজম একটি মস্তিষ্কের বিকাশজনিত বিশেষ অবস্থা, যা মানসিক রোগ বা ‘পাগলামি’ নয়। আজ ১৮ জুন অটিজম প্রাইড ডে, অর্থাৎ অটিস্টিক শিশুকে নিয়ে গর্ব করার দিন।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
অটিজম আসলে কী?
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হলো এমন একটি স্নায়ুবিক বিকাশগত অবস্থা, যার ফলে শিশুর সামাজিক যোগাযোগ, আচরণ, আগ্রহ ও শেখার ধরণে পার্থক্য দেখা যায়। সাধারণত এটি শিশুর জীবনের প্রথম তিন বছরের মধ্যেই ধরা পড়ে। তবে এর লক্ষণ ও তীব্রতা একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে।
অটিস্টিক শিশুদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য
>> তারা বারবার একই কাজ করতে ভালোবাসে (যেমন-চাকা ঘুরানো, হাত নাড়ানো)।
>> অন্যের ডাকে সাড়া না দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
>> নির্দিষ্ট কিছু খাবার ছাড়া অন্য কিছু খেতে চায় না।
>> সামাজিক মেলামেশায় আগ্রহ কম থাকে; একা থাকতে পছন্দ করে।
>> চোখে চোখ রেখে কথা বলতে চায় না।
>> কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলে ফেলে।
>> এক শব্দ বা বাক্য বারবার বলতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
অটিজম কোনো সংক্রামক বা ভয়ানক রোগ নয়। বরং এটিকে যত দ্রুত বোঝা ও গ্রহণ করা যায়, তত দ্রুত একজন অটিস্টিক শিশুর জীবন গঠনে সহায়তা করা সম্ভব। কিন্তু এ কথাটি আমাদের সমাজ এখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি।
সমাজের চোখে অটিজম
অটিজম-সম্পর্কিত সচেতনতার অভাব আজো সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রকট। বিদ্যালয়ে অনেক সময় অটিস্টিক শিশুদের জন্য সুযোগ তৈরি করা হয় না। সহপাঠীরা তাদের উপহাস করে, শিক্ষকরা ধৈর্য হারান, এবং ফলস্বরূপ, পরিবারগুলো শিশুদের ঘরে আটকে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এর ফলে শিশু যেমন বঞ্চিত হয় মানসিক বিকাশ ও শিক্ষা থেকে, তেমনি সমাজও হারায় এক সম্ভাবনাময় নাগরিককে।
বিজ্ঞাপন
অনেক সময় দেখা যায়, অটিস্টিক শিশুদের পিতামাতা লজ্জিত হন তাদের সন্তানের আচরণ নিয়ে। সমাজের চাপ, কটাক্ষ, এবং স্বাভাবিক শিশু না হওয়ার অপবাদ পেয়ে তারা সন্তানকে আড়ালে রাখেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শিশুটি কী দোষ করেছে? অটিজম তো কারো ইচ্ছায় হয় না, বরং এটি এক বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা।
নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য
অটিজম নিয়ে সামাজিক মনোভাব পরিবর্তন করতে হলে প্রতিটি মানুষের ভেতরেই সচেতনতার বীজ রোপণ করতে হবে। এই কাজটি শুধু রাষ্ট্র বা এনজিও’র একার নয় এটি আমাদের সবার।
শিক্ষকদের সহানুভূতিশীল হতে হবে: একটি শিশুর আচরণ অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হলেই তাকে শাস্তি বা অবজ্ঞা না করে বুঝতে হবে সে কি বিশেষ যত্ন চায়। শিক্ষক যদি অটিজম বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন, তাহলে সেই শিশু স্কুলজীবনেই আলোর মুখ দেখবে।
বিজ্ঞাপন
অভিভাবকদের ধৈর্য ধরতে হবে: অটিজম কোনো অভিশাপ নয়। এটি একটি আলাদা ভাবনার জগৎ। সন্তানের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, থেরাপি, ভালোবাসা আর ধৈর্য এই চারটি অস্ত্র দিয়েই অটিজম শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব।
সাধারণ নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে: অটিস্টিক শিশুরা কোনো ‘বিপদ’ নয়, বরং তাদের মাঝেও প্রতিভা থাকে। কেউ অসাধারণ আঁকতে পারে, কেউ সঙ্গীতপ্রতিভা নিয়ে জন্মায়, কেউ অঙ্কে দক্ষ। তাদের শুধু প্রয়োজন একটু সহানুভূতি, একটু বুঝে ওঠার চেষ্টা।
সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব: অটিজম নিয়ে ইতিবাচক গল্প বলা, সচেতনতা তৈরির অনুষ্ঠান প্রচার করা, এবং অটিস্টিক ব্যক্তিদের সাফল্য তুলে ধরার মাধ্যমে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব।
বিজ্ঞাপন
অটিজম আমাদের সমাজের অংশ যা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বরং এটিকে বুঝে নিয়ে, গ্রহণ করে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আমরা সমাজকে আরও মানবিক করে তুলতে পারি। একটি শিশু, অটিস্টিক হোক বা না হোক সে আগে একজন মানুষ। তার প্রতি আমাদের সহানুভূতি, সম্মান ও দায়িত্ববোধই সমাজকে সত্যিকার অর্থে উন্নত করতে পারে।
অটিজম কোনো অভিশাপ নয়, অটিস্টিক শিশুরাও আমাদের মত মানুষ। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই তারাও সম্মানের সঙ্গে সুস্থভাবে বাঁচতে পারবে। তবেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশে, বৃদ্ধি পাবে অটিজম সচেতনতা।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
কেএসকে/এমএস
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন