উষ্ণ ও মিঠা পানিতেই থাকে মস্তিষ্ক খেকো অ্যামিবা
বিশ্বের বহু দেশে এই মস্তিষ্ক খেঁকো অ্যামিবা পাওয়া যায়, তবে সংক্রমণ অত্যন্ত বিরল। ছবি/জাগো নিউজ
মস্তিষ্ক খেঁকো অ্যামিবা - নাম শুনলেই মনে হয় এটি যেন সায়েন্স ফিকশনের কোনো চরিত্র, কিন্তু বাস্তবে পানিতে থাকা এই ক্ষুদ্র জীবাণুটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে সক্ষম। খুব বিরল হলেও একবার আক্রান্ত হলে রোগটি প্রাণঘাতী হতে পারে।
নিগলেরিয়া ফওলেরি বা ব্রেইন ইটিং অ্যামিবা এক ধরনের এককোষী পরজীবী বা অ্যামিবা। বাংলায় এটি 'মস্তিষ্ক খেকো অ্যামিবা’ নামেই পরিচিত। এই অ্যামিবা মানবদেহে প্রবেশ করলে প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোএনসেফালাইটিস (পিএএম) নামক একটি অত্যন্ত বিরল রোগ সৃষ্টি করে। বিরল হলেও অধিকাংশ সময় এটি একটি মারাত্মক ধরনের সংক্রমণ।
এ জীবাণু মস্তিষ্ক ও তার আবরণীকে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই সংক্রমণের ইতিহাস, সংক্রমণ, চিকিৎসা ও সাবধানতার নানা বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার।
ইতিহাস
নিগলেরিয়া ফওলেরি বিশ্বজুড়ে উষ্ণ মিঠা পানি ও মাটিতে পাওয়া যায়। প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোয়েন্সফালাইটিস (পিএএম)-এর প্রথম স্বীকৃত কেসগুলো ১৯৬০ এর দশকে অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপোর্ট করা হয়েছিল। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন উষ্ণ অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে এর সংক্রমণের কেস দেখা গেছে।
নিগলেরিয়া ফওলেরি বিশ্বজুড়ে উষ্ণ মিঠা পানি ও মাটিতে পাওয়া যায়। ছবি/এআই
বিশ্বে বর্তমান পরিস্থিতি
যদিও বিশ্বের বহু দেশে এই অ্যামিবা পাওয়া যায়, তবে সংক্রমণ অত্যন্ত বিরল। প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ১০টিরও কম কেস রিপোর্ট হয়। তবে পাকিস্তানে, বিশেষ করে করাচিতে, সুপেয় পানির দুর্বল অবকাঠামো এবং অপর্যাপ্ত ক্লোরিনেশনের কারণে গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কেস রিপোর্ট হয়েছে।
সাধারণত উষ্ণ আবহাওয়া ও গ্রীষ্মকালে এর সংক্রমণের হার বাড়ে। কারণ অ্যামিবা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রায় ভালো জন্মায়।
এবছর সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে, বিশেষত কেরালাতে মস্তিষ্ক খেকো অ্যামিবা সংক্রমণের ঘটনা বেড়েছে। যেখানে এ পর্যন্ত ৮০ জন আক্রান্ত এবং ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া এবং চেক প্রজাতন্ত্রে এই সংক্রমণের ঝুঁকি সবসময় বেশি।
যেভাবে ছড়ায়
এই অ্যামিবা সাধারণত উষ্ণ মিঠা পানিতে বাস করে। হ্রদ, নদী, পুকুর, খাল, গরম পানির ঝর্ণা, শিল্প-কারখানার গরম পানির নির্গমন পথ, অপর্যাপ্ত ক্লোরিনেশনযুক্ত সুইমিং পুল, ওয়াটার পার্ক এবং মাটিতে এরা বংশ বিস্তার করার জন্য উপযোগী।
লক্ষণগুলো শুরু হওয়ার পর বেশিরভাগ রোগী ১ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে মারা যান। ছবি/প্রতীকী
মস্তিষ্ক খেকো অ্যামিবা নিয়ে বেশি ভয়ের কারণ হলো এটি মস্তিষ্কে মারাত্মক প্রদাহ ঘটায় এবং এর মৃত্যুহার প্রায় ৯৭-৯৯ শতাংশ। প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোয়েন্সফালাইটিস (পিএএম) এর লক্ষণগুলো শুরু হওয়ার পর বেশিরভাগ রোগী ১ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে মারা যান। খুব দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং একাধিক ওষুধের সম্মিলিত চিকিৎসা শুরু না করলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় থাকে না।
সংক্রমণ পদ্ধতি
এই অ্যামিবা শুধুমাত্র নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যখন দূষিত উষ্ণ পানি সাঁতার বা ডাইভিং-এর সময় নাকে ঢুকে যায়, তখন অ্যামিবা নাকের মাধ্যমে মস্তিষ্কে চলে যায় এবং সেখানে সংক্রমণ ঘটায়।
তবে এই অ্যামিবা পানির সঙ্গে পান করার মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায় না। পাকস্থলীর অ্যাসিড একে ধ্বংস করে দেয়। এমনকি এটি মানুষ থেকে মানুষেও ছড়ায় না। অর্থাৎ এটি ছোঁয়াচে না।
ঝুঁকির কারণসমূহ
প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোয়েন্সফালাইটিস (পিএএম) সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে যেসব কারণে -
১. উষ্ণ মিঠা পানি: হ্রদ, নদী বা পুকুরে ডাইভিং, সাঁতার কাটা বা অন্য কোনো জলক্রীড়া, যেখানে পানি নাকে ঢুকতে পারে। এই ধরনের কার্যক্রম বিপদ ডেকে আনতে পারে।
২. সময়: গ্রীষ্মের তীব্র মাসগুলো, যখন পানির তাপমাত্রা বেশি থাকে, সেটি অ্যামিবার বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল। তাই এ সময়ে পানিতে নামা নিরাপদ নয়।
অ্যামিবা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রায় ভালো জন্মায়। ছবি/এআই
৩. বয়স: শিশু ও তরুণ-তরুণীরা, বিশেষত ১৪ বছরের নিচে, যারা উষ্ণ পানিতে বেশি সময় ধরে সাঁতার কাটেন, তাদের মধ্যে কারো রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে তাদের ঝুঁকি বেশি।
৪. নাক ধোয়ার অভ্যাস: সাইনাস বা নাক পরিষ্কারের জন্য ফোটানো বা পাতিত পানি ব্যবহার করতে হবে সমসময়। সরাসরি কলের পানি ব্যবহার করা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
রোগের লক্ষণ
লক্ষণগুলো সাধারণত অ্যামিবার সংক্রমণ হওয়ার ১ থেকে ৯ দিনের মধ্যে (গড়ে ৫ দিন) শুরু হয় এবং তা দ্রুত খারাপ হতে থাকে।
- ১. প্রাথমিক লক্ষণ (১-৭ দিনের মধ্যে)
>> তীব্র জ্বর
>> মারাত্মক মাথাব্যথা
>> বমি বমি ভাব বা বমি
>> ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া
- ২. পরবর্তী লক্ষণ
>> হ্যালুসিনেশন, অর্থাৎ যার অস্তিত্ব নেই তা দেখা বা শোনা।
>> বিভ্রান্তি
>> মনোযোগের অভাব
>> ভারসাম্য হারানো
>> খিঁচুনি
>> কোমা
পিএএম-এর লক্ষণগুলো ব্যাকটেরিয়াজনিত মেনিনজাইটিসের মতো হওয়ায়, রোগ নির্ণয় চ্যালেঞ্জিং হয় এবং কখনো কখনো দেরিও হতে পারে।
চিকিৎসা
প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিনগোয়েন্সফালাইটিস (পিএএম)-এর সঠিক চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়, রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা তত বাড়ে।
>> চিকিৎসায় সাধারণত একাধিক অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো অ্যাম্ফোটেরিসিন বি, যা শিরায় ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়।
>> মিল্টেফোসিন একটি অ্যান্টি-প্যারাসাইটিক ওষুধ, যা বর্তমানে পিএএম-এর চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সাফল্যের খবর পাওয়া গেছে।
>> এছাড়াও মস্তিষ্কের প্রদাহ ও চাপ কমাতে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ এবং অন্যান্য সহায়ক যত্নও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিরোধ
খুব কার্যকর চিকিৎসা না থাকায় প্রতিরোধই এই রোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। তাই এই পরামর্শগুলো মেনে চলুন-
- ১. ঝুঁকিপূর্ণ পানি এড়িয়ে চলুন
বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে উষ্ণ মিঠা পানির হ্রদ, পুকুর বা নদী যেখানে পানি স্থির থাকে বা কম গভীর, সেখানে সাঁতার কাটা বা ডাইভিং করা এড়িয়ে চলুন।
- ২. নাকের ক্লিপ ব্যাবহার করুন
উষ্ণ মিঠা পানিতে সাঁতার কাটার সময় নাকের ক্লিপ ব্যবহার করুন বা নাক চেপে ধরুন যাতে পানি কোনোভাবেই নাকে প্রবেশ না করে।
- ৩. নাক ধোয়ার সতর্কতা
সাইনাস বা নাক পরিষ্কার করার জন্য নেটি পট বা অন্য কোনো ডিভাইস ব্যবহার করলে অবশ্যই ফুটানো ও ঠান্ডা করা পানি বা জীবাণুমুক্ত স্যালাইন দ্রবণ ব্যবহার করুন। সরাসরি কলের পানি ব্যবহার করা উচিত নয়।
- ৪. পুকুরের তলদেশ এড়িয়ে চলুন
উষ্ণ পানির উৎস বা পুকুরে সাঁতারের সময় তলদেশের মাটি বা পলি নাড়াচাড়া করা এড়িয়ে চলুন। কারণ অ্যামিবা মাটিতে বেশি থাকতে পারে।
- ৫. পুল রক্ষণাবেক্ষণ
ব্যক্তিগত বা পাবলিক সুইমিং পুলের ক্লোরিনের মাত্রা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করুন।
বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি কতটা?
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিগলেরিয়া ফওলেরির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়তে পারে। দেশে পিএএম-এর প্রথম স্বীকৃত কেসটি রিপোর্ট করা হয়েছিল একটি ১৫ বছর বয়সী কিশোরের। তার অপরিষ্কার নদীর পানিতে গোসল এবং নাক ধোয়ার অভ্যাস ছিল।
বাংলাদেশ একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ, যেখানে বছরের একটি বড় অংশজুড়ে উচ্চ তাপমাত্রা বজায় থাকে। এই উষ্ণ পরিবেশ অ্যামিবার বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল। তাছাড়া বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে উভয় অঞ্চলেই অনেক মানুষ পুকুর, নদী বা অপরিশোধিত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে গোসল বা নাক ধোয়ার মতো কাজ করে থাকেন।
আবার অনেক জায়গায় সুপেয় পানির সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা বা ক্লোরিনেশনের অভাব থাকলে অ্যামিবার উপস্থিতি বাড়তে পারে। যদিও এটি একটি বিরল রোগ কিন্তু পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণগুলো বাংলাদেশে বিদ্যমান।
জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, বিশেষ করে গোসল বা নাক ধোয়ার জন্য নিরাপদ পানি ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি করা এবং উষ্ণ মিঠা পানিতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা — বাংলাদেশের জন্য এই ঝুঁকি কমাতে অত্যন্ত জরুরি।
এএমপি/জিকেএস