জুলাইয়ে শহীদ সাংবাদিক পরিবারগুলোর আছে অভিযোগ-আক্ষেপ
গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হন ছয় সাংবাদিক। শুরুতে তাদের পরিবারে দেখা দেয় চরম অনিশ্চয়তা আর আর্থিক সংকট। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি হারিয়ে পরিবারগুলো হঠাৎই অকূলে পড়ে। এখন তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মানুষ করা নিয়ে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হয়েছে। শুরুতে কোনো কোনো রাজনৈতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এসব পরিবারকে কিছু আর্থিক সহায়তা দিলেও এখন আর কেউ তাদের খোঁজখবর নিচ্ছে না। এ নিয়ে পরিবারগুলোর মধ্যে এক ধরনের আক্ষেপও রয়েছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের এককালীন কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছে এ পরিবারগুলো। এতে কিছুটা হলেও কেটেছে অসচ্ছলতা। তবে স্বজনহারা এ পরিবারগুলোর অভিযোগ-আপত্তিও রয়েছে। তারা বলছেন, শহীদ সাংবাদিকদের অফিস বা কর্মস্থল থেকে কোনোরকম সাড়া তারা পাচ্ছেন না। তাদের আক্ষেপ, আর্থিকভাবে না হলেও একটু ফোনকলে কথা বলেও তো সান্ত্বনা দিতে পারে কর্মস্থলগুলো।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জুলাইয়ে শহীদ সাংবাদিকরা হলেন আবু তাহের মো. তুরাব, হাসান মেহেদী, প্রদীপ কুমার ভৌমিক, মো. শাকিল হোসেন (পারভেজ), সোহেল আখঞ্জী ও তাহির জামান প্রিয়।
- আরও পড়ুন
- ‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল’
সাংবাদিক তুরাব হত্যায় পুলিশের সাবেক এডিসি দস্তগীর গ্রেফতার
নতুন ঘর উঠেছে, সংসারে টাকা আসে, শুধু নেই আবু সাঈদ!
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা হলে তারা জাগো নিউজকে জানান, তারা ভেবেছিলেন সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো থেকে বড় সহায়তা আসবে। কিন্তু স্থায়ী কোনো সাহায্য পাননি। যেটুকু আর্থিক সহায়তা এসেছে তা দিয়ে সন্তানদের স্কুলের খরচ জোগাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর চেয়ে বরং পরিবারের বর্তমান কর্মক্ষমদের মধ্যে থেকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে দীর্ঘমেয়াদে উপকার হতো।
সিলেটে কাজ করতেন দৈনিক নয়াদিগন্তের ব্যুরো চিফ শহীদ সাংবাদিক আবু তাহের মো. তুরাব। কথা হয় তার ভাই আবুল হাসান মো. আশরাফ জাবুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভাইয়ের শরীরে ৯৮ রাউন্ড গুলি করা হয়। বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলাও হয়েছে। এখনো আসামিরা ধরা পড়েনি। আমরা ন্যায়বিচার চাই।’
ঢাকা টাইমস পত্রিকায় দুদক বিটে কাজ করতেন শহীদ হাসান মেহেদী। তার স্ত্রী ফারহানা ইসলাম পপি জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুতে একরকম ট্রমায় চলে যাই। কোলে দুধের শিশু, আরেকজনের সাত বছর বয়স। জামায়াতে ইসলামী ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন কিছু সাহায্য করেছে। পরে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন এবং সরকারও সাহায্য পাঠায়।
পপি বলেন, ‘এখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছি। ভবিষ্যতে চাকরি করবো ইনশাআল্লাহ, যেন সন্তানদের মানুষ করতে পারি।’
গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সিরাজগঞ্জে শহীদ হন দৈনিক খবরপত্রের রায়গঞ্জ প্রতিনিধি প্রদীপ কুমার ভৌমিক। তার ছেলে সুজন কুমার ভৌমিক বলেন, ‘আমার বাবা শহীদ হয়েও কোনো সরকারি অনুদান পাননি। বরং তাকে আওয়ামী লীগের দোসর বলা হয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী।’
- আরও পড়ুন
জুলাই অভ্যুত্থানের আরও ১০ শহীদের গেজেট প্রকাশ - পা হারিয়ে থেমে গেছে জুলাই আহত শফিকুলের জীবন
- একটা অটোরিকশায় সচল হতে পারে জুলাই আহত শাহ আলমের জীবন
ভোরের আওয়াজের গাজীপুরের থানা প্রতিনিধি মো. শাকিল হোসেন পারভেজ শহীদ হন উত্তরায়। তার বাবা মো. বেলায়েত বলেন, ‘শাকিল ছিল আমার একমাত্র ছেলে। রাস্তার মাঝখানে গুলি করে বুক ঝাঁঝরা করে ফেলা হয়। এখন শুধু বিচার চাই, আর কিছু না।’
বেলায়েত বলেন, ‘সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রায় ২৫ লাখ টাকার সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু সন্তানের শূন্যতা পূরণ হয় না।’
গণঅভ্যুত্থান চলাকালে দায়িত্ব পালনের সময় হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে শহীদ হন দৈনিক লোকালয়ের স্টাফ রিপোর্টার সোহেল আখঞ্জী। তার স্ত্রী মৌসুমি আক্তার বলেন, “তিন সন্তানের মধ্যে বড়টি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়েটার বয়স মাত্র আড়াই বছর। মাঝে মধ্যেই বলে—‘মা, বাবাকে কল দাও।’ আমি কিছুই বলতে পারি না।”
মৌসুমি আক্তার বলেন, ‘সরকার ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকার সহায়তা পেয়েছি। সেই টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ ও ঘর নির্মাণ করেছি। আমি চাই, সন্তানরা যেন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে।’
শহীদ ফটোসাংবাদিক তাহির জামান প্রিয় কাজ করতেন দ্য রিপোর্ট ডটকমে। তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
- আরও পড়ুন
- শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ছবি-ভিডিও নেওয়ায় সাংবাদিকদের মারধর
- আগামী নির্বাচনে শুধু প্রকৃত মিডিয়া দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবে
- শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম হামলা দেখে সশরীরে আন্দোলনে অংশ নিই
এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হন দি বিজনেস পোস্ট পত্রিকার গ্রাফিক্স ডিজাইনার আতিকুর রহমান। তার মৃত্যুতে পরিবারের সদস্যরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন।
আতিকুরের স্ত্রী মহুয়া বলেন, ‘স্বামী ছিলেন পরিবারের বটবৃক্ষ। তার অফিস থেকে দেড় লাখ টাকা দিলেও পরে আর যোগাযোগ করেনি। বাচ্চারা আজও জানতে চায় বাবার অফিস থেকে ফোন আসে না কেন?’
মহুয়া বলেন, ‘জামায়াত ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন প্রথমে সহায়তা করে। পরে সরকার ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকেও সহযোগিতা পেয়েছি। সন্তানদের জন্য গ্রামে ঘর করেছি। ছেলের বয়স তিন বছর, মেয়েটার বয়স পাঁচ বছর। ওদের নিয়েই এখন আমার ভবিষ্যৎ। নিজে স্বাবলম্বী হয়ে সন্তানদের মানুষ করতে চাই।’
ইএআর/এমকেআর/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম
সর্বশেষ - গণমাধ্যম
- ১ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে সামনে ‘মহাবিপদ’: এ কে আজাদ
- ২ তারেক রহমান আরও আগে ফিরলে সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারতো
- ৩ যদি সত্য কথা শুনতে না চান, আপনি ভুল করবেন: মাহফুজ আনাম
- ৪ কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে দেশকে অস্থিতিশীল দেখানোর অপচেষ্টা চলছে
- ৫ প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা: অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের নিন্দা