ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

অবহেলিত প্রকল্পের নাম তিস্তা সেচ, শুরুতে দেওয়া হয়নি অর্থ

মফিজুল সাদিক | প্রকাশিত: ০৬:২৮ পিএম, ০২ আগস্ট ২০২৫

নীলফামারী, দিনাজপুর ও রংপুরের তিস্তা সেচ এলাকাজুড়ে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ২০২১ সালে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সম্ভাব্যতা যাচাই বা ফিজিবিলিটি স্টাডি না করেই ‘তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক ওই প্রকল্প নেওয়া হয়। এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা গেছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শুরুর দিকে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় যথাযথ গুরুত্ব না পাওয়ায় অর্থ বরাদ্দে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে প্রকল্পে। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) পাঠিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় ১ দশমিক ০৪ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের পানি সরবরাহের মাধ্যমে বর্তমান সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ৩০ লক্ষাধিক জনসাধারণের আর্থিক নিরাপত্তা দিচ্ছে এ প্রকল্প এলাকা।

আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণে দেখা গেছে, রাজস্ব খাতে নিয়োজিত স্বল্প সংখ্যক জনবলকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ পরিচালনা, নিবিড় মনিটরিং ও সুপারভিশন প্রক্রিয়াকে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ খাত সিল্ট ট্র্যাপ খনন না করে সেচখালগুলো পুনর্বাসন ও শক্তিশালীকরণের কাজগুলো করা হচ্ছে, যা পদ্ধতিগতভাবে যুক্তিযুক্ত নয়। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীদের কাছ থেকে প্রকল্পের আওতাধীন ভূমি উদ্ধার এবং ভূমি অধিগ্রহণ হলো বর্তমানে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রকল্পে বিশেষায়িত জনবলের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। নির্মাণ কাজের গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ ও নিশ্চিতকরণে নিবিড় মনিটরিং, সুপারভিশন, পর্যাপ্ত সংখ্যক ল্যাব টেস্ট সম্পাদন করা অপরিহার্য ছিল।

চলমান কাজে পরিবেশ দূষণ দেখা গেছে। বৃক্ষরোপণ কাজ পুরোপুরিভাবে পরিবেশবান্ধব ও বৈচিত্র্যময় হয়নি। এছাড়া বুড়িতিস্তা জলাধার পুনরায় খনন নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ আছে। প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নের স্বার্থে এসব সমস্যা যথাসম্ভব দ্রুত সমাধান করা দরকার। প্রকল্পটির সৃষ্ট অবকাঠামোগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় তথা টেকসইকরণে জনসচেতনতা, অংশীদারত্ব, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় বাজেট, জনবল ও লজিস্টিকস ইত্যাদির প্রয়োজন হবে।

এ ব্যাপারে আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের রিপোর্টে উঠে এসেছে ফিজিবিলিটি স্টাডি না করেই প্রকল্প নেওয়া হয়। যে কারণে কর্মপরিকল্পনা ও ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করার পর প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা গেছে। ২০২১ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শুরুর দিকে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় যথাযথ গুরুত্ব না পাওয়ায় অর্থ বরাদ্দে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমরা প্রকল্প এলাকা দ্রুত সময়ে ভিজিট করে সব কিছু দেখবো। এর পরই পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশ করবো।’

প্রকল্প গ্রহণ

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি; ফসলের নিবিড়তা ২৩১ শতাংশ থেকে ২৬৮ শতাংশে উন্নীতকরণ; কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০২০-২১ অর্থবছরে ‘তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি গ্রহণ করে। পাউবোর মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায়ে মোট ১ হাজার ৪৫২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়। ২০২১ সালের ৪ মে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। মেয়াদ ধরা হয় ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।

কোন কাজে কত অগ্রগতি

পাউবো জানায়, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত মোট আর্থিক অগ্রগতি ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ ও বাস্তব অগ্রগতি ৫২ দশমিক ১০ শতাংশ। মূল খাতগুলোর মধ্যে সেচখালের ডাইক পুনর্বাসন ও শক্তিশালীকরণ, স্লোপ প্রোটেকশন ও মেরামত কাজে বাস্তব অগ্রগতি ৫১ দশমিক ৫৭ শতাংশ; সাইফুন, এস্কেপ ও রেগুলেটর নির্মাণ এবং মেরামত কাজে ১৫ দশমিক ০৩ শতাংশ; বাইপাস সেচখাল, রেগুলেটর মেরামত, ভূগর্ভস্থ সেচ পাইপ স্থাপন ও ক্যানেল ক্রসিং স্লাব নির্মাণ কাজে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ; সেতু নির্মাণ কাজে ৯২ দশমিক ৮৪ শতাংশ; কালভার্ট নির্মাণে ৭৪ দশমিক ৯২ শতাংশ; রাস্তা নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ৯০ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং বনায়ন কাজে ৯১ দশমিক ০৩ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।

করোনা মহামারি, অর্থ বরাদ্দে স্বল্পতা, নকশা প্রণয়ন, ভূমি অধিগ্রহণ ও ভূমি অবৈধ দখলমুক্ত করতে বিলম্ব এবং সেচখালের ডাইকে বিদ্যমান বৃক্ষ অপসারণের ক্ষেত্রে অনুমোদন লাভে দীর্ঘসূত্রতা; ডাইক পুনর্বাসন ও শক্তিশালীকরণে প্রয়োজনীয় মাটির উৎসের অভাব ইত্যাদি প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত করেছে।

পরিকল্পনায় মোট ২৫৫টি প্যাকেজের মধ্যে পণ্যের ১৭টি ও কার্যের ২৩৮টি প্যাকেজ রয়েছে। কার্যে ২৩৮টি প্যাকেজের মধ্যে ১৯২টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান; ১৮৬টি প্যাকেজের কার্যাদেশ দেওয়া; ৪৩টি প্যাকেজের কাজ সমাপ্ত এবং ১৪৩টি প্যাকেজের বাস্তবায়ন কাজ চলমান।

৪৬টি প্যাকেজের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্যাকেজের ব্যয় প্রাক্কলনের চেয়ে চুক্তিমূল্য অধিক হয়েছে। পিপিএ (২০০৬) ও পিপিআর (২০০৮) অনুসরণে কিছুটা সীমাবদ্ধতা দেখা গেলেও মাঠ বাস্তবতার আলোকে নকশা প্রণয়ন করে প্রকল্পের ভৌত নির্মাণ কাজগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নির্মাণ উপকরণ ও কাজের গুণগতমান নিশ্চিতকরণে কিছু ব্যত্যয় দেখা গেছে। এক্ষেত্রে স্পেসিফিকেশন, ডিজাইন ড্রইং, পরিমাণ ও গুণগতমান ইত্যাদি যাচাইয়ের লক্ষ্যে ফিল্ড টেস্ট, ল্যাবরেটরি টেস্ট রিপোর্ট, প্রত্যয়ন, সনদসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ডকুমেন্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। নির্মাণ কাজের বিভিন্ন ধাপে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভৌত কাজের গুণগতমান নিয়ন্ত্রণে এবং পাউবো কর্তৃক নিজস্ব গুণগতমান নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরি টেস্টের সংখ্যা কম প্রতীয়মান হয়েছে।

প্রকল্পটির মনিটরিং ও পরিদর্শনলব্ধ সুপারিশগুলো রেকর্ডভুক্তকরণ এবং সেগুলো বাস্তবায়নে পাউবো ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কিছুটা ঘাটতি আছে। রাজস্ব খাতে নিয়োজিত স্বল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করায় নিবিড় মনিটরিং ও সুপারভিশনসহ নিয়মিত সভা আয়োজনে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।

প্রকল্পের সবল দিক

সরকারি তহবিলে প্রকল্পটি গ্রহণ, পাউবোর স্থানীয় অফিস, জনবল ও লজিস্টিকস সুবিধা ব্যবহার, স্থানীয় কৃষক সংগঠন ও ঠিকাদারদের মাধ্যমে প্রকল্পের সেচ ব্যবস্থা পরিচালনা; পুরোনো ও নতুন অ্যালাইনমেন্টে প্রকল্প বাস্তবায়ন; প্রাকৃতিক সেচ সুবিধার ব্যবহার; স্থানীয় ও জাতীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পের ভৌত কার্যাদি বাস্তবায়ন এবং এক্সিট প্ল্যান ও টেকসই পরিকল্পনার সংযোজন প্রকল্পটির সবল দিক।

দুর্বল দিক

একাধিক ফসলি মৌসুমের কারণে বছরে মাত্র চার-পাঁচ মাস প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ সম্পাদন করতে বাধ্য হতে হয়। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা, মেয়াদকাল ও ব্যয় প্রাক্কলন নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ স্বল্পতাসহ অর্থ ছাড়ে বিলম্ব ঠিকাদারদের বিল পরিশোধে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়। কৃষকদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সচেতনতার অভাবে সেচ সুবিধা গ্রহণের বিপরীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেচ ফি ও সার্ভিস চার্জ পরিশোধে অনীহা দেখা গেছে। জনবল স্বল্পতার কারণে মনিটরিং ও সুপারভিশনে সীমাবদ্ধতা এবং ভৌত কাজের ডিজাইন ও ড্রইং প্রণয়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সম্পূরক সেচের পানি সরবরাহের মাধ্যমে প্রতিব ছর অতিরিক্ত ধান এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধিকরণের তাগিদ দেখা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, প্রথমে যখন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় তখন সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। প্রকল্পে বরাদ্দও কম ছিল। যে কারণে অগ্রগতি কম ছিল। প্রকল্পটি নেওয়ার আগে ফিজিবিলিটি স্টাডিও করা হয়নি। তবে নতুন করে প্রকল্পের গুরুত্ব ও বরাদ্দও বাড়ছে। আশা করি আগামী দুই বছরেই ‘তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্প শতভাগ বাস্তবায়ন হবে।

এমওএস/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম