১৬ মাঝিমাল্লার ভাগ্যে কী ঘটেছে জানে না পরিবার, নির্বিকার নৌ-পুলিশ
নিখোঁজ জেলেদের কয়েকজন
- বারবার লোকসানে পড়া আলী আকবর সাগরে গিয়ে বোটসহ নিজেই নিখোঁজ
- পূর্বশত্রুতার জেরেও হানাহানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা পরিবারের
- জিডির ৫ দিনেও অগ্রগতির খবর জানেন না পুলিশ সুপারও
জীবিকার সন্ধানে তারা গিয়েছিলেন গহীন সাগরে মাছ ধরতে। কিন্তু বিধি বাম। গত ১৩ সেপ্টেম্বর মাছ শিকারে যাত্রার দিন থেকেই বোটসহ নিরুদ্দেশ ১৬ মাঝিমাল্লা। কারও পরিবারে দুই সন্তান, কারও চার। কারও পরিবারে নিখোঁজ ব্যক্তিই একমাত্র উপার্জনক্ষম। ১৭ দিন খোঁজ না পেয়ে গভীর উৎকণ্ঠায় পরিবারগুলো। নৌ-পুলিশও নির্বিকার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘটনার ১১ দিন পর ২৪ সেপ্টেম্বর পুলিশের শরণাপন্ন হয় নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলো। ওইদিন চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাট নৌ-থানায় নিখোঁজ বোট মালিকের স্ত্রী বাদী হয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু জিডির পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই নৌ-পুলিশের। ১৬টি জীবনের কী হলো, কোথায় গেলো, তাদের কপালে সলিল সমাধিই জুটলো কি না- কোনো তথ্যই নেই নৌ-পুলিশের কাছে। অগ্রগতির খবর জানেন না নৌ-পুলিশ চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান পুলিশ সুপার আ ফ ম নিজাম উদ্দিনও।
সদরঘাট নৌ-থানার জিডি সূত্রে জানা যায়, মাঝিমাল্লাসহ বোট মালিক আলী আকবর নিজে ‘এফবি খাজা আজমীর’ নিয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে নগরীর বাকলিয়া থানাধীন নতুন ফিশারি ঘাট থেকে মাছ শিকারে বঙ্গোপসাগরে রওয়ানা দেন। ওই রাতে সবশেষ পৌনে ১০টার দিকে স্ত্রী সেলিনা আকতারের সঙ্গে কথা হয় আলী আকবরের। এরপর থেকে আর কথা হয়নি। সাগরে যাওয়া অন্য মাঝিমাল্লাদের মোবাইল নম্বরও বন্ধ।
সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে এফবি খাজা আজমীর বোটটির মালিকের স্ত্রী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই।-চট্টগ্রাম সদরঘাট নৌ-থানার উপ-পরিদর্শক মো. আরিফ
নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- বোট মালিক আলী আকবর (৪৯), মাঝি আবু তাহের (৬৯), জেলে মো. রুবেল (২৭), আমির হোসাইন (২৭), মোহাম্মদ জামাল (৪৯), মোহাম্মদ ইসাক (৩৩), জামাল আহমদ (৩৪), মোহাম্মদ হেলাল (৩৫), শেফায়ত উল্লাহ (৩৯), জয়নাল আবেদীন জইন্যা (৫০), মোহাম্মদ এহছান (৩৮), আবদুল মন্নান (৩৮), মোহাম্মাদ ছালাউদ্দিন (৩৮)। অন্য তিনজনের নাম এখনো জানা যায়নি।
আরও পড়ুন
সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে ১৭ দিন ধরে নিখোঁজ ১৬ মাঝিমাল্লা
মা ইলিশ রক্ষায় শুরু হচ্ছে ২২ দিনের বিশেষ অভিযান, মাঠে নৌ পুলিশ
ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। বোট মালিক আলী আকবর কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার কোনাখালী বাজার পাড়া গ্রামের আবদুল আজিজের ছেলে। পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ এলাকার একটি বাসায়। নিজের বোট হলেও বিগত সময়ে প্রায় প্রতি ট্রিপেই গুনেছিলেন লোকসান। সবশেষ সাগরে যাওয়ার আগে বোটের মিস্ত্রি অসুস্থ হয়ে পড়েন। যে কারণে মাঝিমাল্লার সঙ্গে নিজেই প্রথমবারের মতো বোটে মাছ শিকারে রওয়ানা দেন।
আলী আকবরের স্ত্রী সেলিনা আকতার বলেন, ‘গত ১৭ দিন ধরে আমার স্বামীর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। বোটের মিস্ত্রি অসুস্থ ছিল। তাছাড়া বিগত সময়ে প্রায়ই বোটে লোকসান হয়েছে। বোটে চুরি হতো। এতে প্রায় প্রতি ট্রিপে লোকসান গুনতে হতো। সবমিলিয়ে এবার প্রথমবারের মতো বোটে মাছ শিকারে সাগরে গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘বোটটি নিয়েও একটি পক্ষের সঙ্গে মামলা-মোকাদ্দমা ছিল। পিবিআই তদন্তে তাদের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পরে আদালতের আদেশে বোটটি আমরা পেয়েছিলাম। বোট নিয়ে যাদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা ছিল তারা গত বছর গ্রামের বাড়ি থেকে চট্টগ্রামে আসার পথে কক্সবাজারে আমাদের ওপর হামলা করেছিল।’
‘ওই ঘটনায় আমরা কক্সবাজার থানায় জিডিও করেছিলাম। আমার সন্দেহ হচ্ছে, প্রতিপক্ষের লোকজন পূর্বশত্রুতার কারণে আমাদের বোটে হামলাও করতে পারে। তাছাড়া বোটসহ আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর গত ২৪ সেপ্টেম্বর নৌ-থানায় জিডি করেছি। তারা এখনো বিষয়টি সুরাহা করতে পারেনি।’ বলেন আকবরের স্ত্রী।
আলী আকবরের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। এক ছেলে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে, ছোট ছেলে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের ছোট ছেলে আহাদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আব্বুর সঙ্গে ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শেষ কথা হয়। এরপর আর কথা হয়নি। পরদিন যখন কল করি তখন ফোন বন্ধ। মনে করেছিলাম, ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরে যোগাযোগ করে সঙ্গে যাওয়া লোকজনের মোবাইল নম্বর নিয়ে ফোন করি। তাদের নম্বরও বন্ধ পাই। আমি ১৩ জনের তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি।’
নিখোঁজ হওয়াদের মধ্যে রয়েছেন জামাল আহমদ। জামালের মা বুলবুল আকতার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ছেলে জামাল ১৭ দিন আগে সাগরে গেছে। সাগরে যাওয়ার পর থেকে কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। মারা গেছে কী বেঁচে আছে, জানতে পারছি না। আমার ছেলের সংসারে দুটি শিশুসন্তান। জামালসহ আমাদের গ্রামের ছয়জন গেছে। বোটের তাহের মাঝির বাড়িও আমাদের গ্রামে। কেউ এক সন্তানের জনক, কেউ দুই সন্তানের জনক। প্রায় সবাই যুবক।’
নিখোঁজ রুবেলের বোন কামরুন্নাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ভাই ১৯ দিন হয়েছে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। এরপর থেকে খবর পাচ্ছি না। রুবেলসহ আমাদের গ্রামের ছয়জন আলী আকবর কোম্পানির বোটে সাগরে গিয়েছিল। যাওয়ার দিন থেকে কারও খবর পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে বলছে, তাদের বোটটি ডাকাতের কবলে পড়েছিল। ডাকাতরা তাদের গুম করে ফেলেছে। কেউ বলছে, তাদের ধরে বার্মা (মিয়ানমার) নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা সেখানে খবর নিতে লোক পাঠিয়েছি।’ রুবেলের একমাত্র সন্তানের বয়স আজই (২৯ সেপ্টেম্বর) এক বছর এক মাস পার হয়েছে বলে জানান কামরুন্নাহার।
সেলিনা আকতারের দায়ের করা জিডিটি তদন্ত করছেন চট্টগ্রাম সদরঘাট নৌ-থানার উপ-পরিদর্শক মো. আরিফ। কথা হলে সোমবার বিকেলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে এফবি খাজা আজমীর বোটটির মালিকের স্ত্রী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই।’
তাহলে ১৬টি জীবনের কী হবে? কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েছেন তারা, নাকি কোনো অপরাধমূলক ঘটনার শিকার পুরো বোটের সবাই। নদীতে পুলিশিং দায়িত্ব পালন করে নৌ-পুলিশ। জানতে চাইলে নৌ-পুলিশ চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান পুলিশ সুপার আ ফ ম নিজাম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৬ মাঝিমাল্লা নিয়ে নিখোঁজ বোটের বিষয়ে হওয়া জিডির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।’ পরে বলেন, সদরঘাট নৌ-থাকার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে।’ তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে জানালে এসপি বলেন, ‘তাহলে আপাতত ওটাই আপডেট তথ্য’।
এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএফএ/এএসএম