বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫
সংকটকালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার
প্রতি বছর ১০ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এই দিনটি কেবল মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয় না, বরং মানবিক সংকটের গভীরে প্রবেশ করে নীতিগত ব্যর্থতাগুলোকে সামনে আনে। ২০২৫ সালের জন্য নির্ধারিত প্রতিপাদ্য—“সেবায় প্রবেশাধিকার: বিপর্যয় ও জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য” (Access to services – mental health in catastrophes and emergencies)—একটি গভীর ও সময়োপযোগী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা মহামারির মতো মারাত্মক সংকটের সময় মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অত্যাবশ্যকতা অনস্বীকার্য হলেও, এটি প্রায়শই গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণের মাধ্যমে মূলত সেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতাকেই চিহ্নিত করতে চেয়েছে। একদিকে সংস্থাটি বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট মানসিক ট্রমা মোকাবিলায় জরুরি প্রয়োজনের কথা স্বীকার করে, অন্যদিকে যথাযথ ও সময়োপযোগী মনোসামাজিক সহায়তা সরবরাহে রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে থাকে। এই নীরবতার অভিশাপ ছিন্ন করা আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বড় মানবিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বিপর্যয় ও জরুরি অবস্থাগুলো সর্বদা দুটি সমান্তরাল সংকট সৃষ্টি করে। প্রথমত, ক্ষয়ক্ষতি, প্রিয়জন হারানো, স্থানচ্যুতি, এবং জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তার কারণে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, সেই চরম মুহূর্তে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ও সামাজিক কাঠামো নিজেই ভেঙে পড়ে অথবা মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। খাদ্য, পানি, এবং আশ্রয়ের মতো মৌলিক মানবিক সেবার ভিড়ে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রায়শই ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ চাহিদা হিসেবে দেখা হয়। অথচ, মানসিক সুস্থতা ব্যতিরেকে কোনো পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টেকসই হতে পারে না।
মানসিক স্বাস্থ্য হলো মানবিক মর্যাদা, পুনর্গঠন ও স্থিতিস্থাপকতার (Resilience) কেন্দ্রবিন্দু। একে উপেক্ষা করার অর্থ হলো, সমাজের নীরব ক্ষতগুলোকে অনন্তকালের জন্য রক্তাক্ত রেখে দেওয়া। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫ আমাদের সেই নীরব ক্ষতগুলোকেই দৃশ্যমান করে তুলছে—এবং আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে, যেন “সংকটকালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার” সবার জন্য একটি নিশ্চিত বাস্তবতা হয়ে ওঠে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) – ২০২৪ এর তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ সময়েই বিশ্বের প্রায় ১.১ বিলিয়ন মানুষ কোনো না কোনো মানসিক ব্যাধিতে ভুগছেন, যার মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। কিন্তু যুদ্ধ, সংঘাত, বা বড় ধরনের দুর্যোগের অভিজ্ঞতা পাওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার একলাফে বহু গুণ বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন (২২ শতাংশ) গুরুতর মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD), দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতা, এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডার।
এই বিশাল পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যার খেলা নয়; এটি লক্ষ লক্ষ জীবনের কথা বলে, যারা বিপর্যয়ের মানসিক ধাক্কা সামলাতে না পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না। এর ফলস্বরূপ সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা দুর্বল হয়। এ কারণেই WHO জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক সহায়তা-কে মৌলিক মানবিক সেবার অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
প্রয়োজনের তীব্রতা সত্ত্বেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ব্যবধান মারাত্মক। উন্নত দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বাজেট এবং জনবল তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ২০২৪-এর একটি উদ্বেগজনক তথ্য হলো, বিশ্বের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ কোনো কার্যকর চিকিৎসা পান না।
জরুরি পরিস্থিতিতে এই অসমতা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। যখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয় এবং রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায়, তখন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী ও মনোবিজ্ঞানীগণ নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন বা এলাকা ত্যাগ করেন। ফলস্বরূপ, ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রায়শই বাজেট বা প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে বাদ দেওয়া হয়।
এই দ্বিমুখী সংকটের চূড়ান্ত ফলস্বরূপ, জনগণের মানসিক চাহিদা যখন সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায়, ঠিক তখনই সেবার সক্ষমতা তলানিতে ঠেকে। এই পরিস্থিতি কেবল স্বাস্থ্যের দিক থেকে নয়, মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর প্রশ্ন তোলে এবং মানবিক সংকটের গভীরতা বাড়িয়ে তোলে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এই বৈশ্বিক বাস্তবতার এক সুস্পষ্ট প্রতিফলন। ভৌগোলিকভাবে দেশটি বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায়, প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন এবং ক্রমবর্ধমান তাপপ্রবাহ মানুষের জীবন ও জীবিকায় ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। এই বিপর্যয়গুলো কেবল ভৌত ক্ষতি করে না, মানুষের মানসিক স্থিতিশীলতাকেও চরমভাবে ব্যাহত করে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের হার সাধারণ জনগণের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি। এই মানুষগুলোর অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতা, ঘুমের সমস্যা, এবং তীব্র আতঙ্ক নিয়ে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এর ফলে তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জরুরি চাহিদা আরও বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের জটিলতা আরও বাড়িয়েছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর উপস্থিতি। ২০১৭ সালের গণহত্যা, ধর্ষণ, এবং স্থানচ্যুতির তীব্র ট্রমা থেকে সৃষ্ট পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) উদ্বেগ ও হতাশার প্রাদুর্ভাব এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে অত্যন্ত উচ্চ।
Joint Data Center (২০২৪)-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রোহিঙ্গা প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং কিশোরদের প্রায় ৫০ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। ভয়াবহ তথ্য হলো, এদের মধ্যে ৫ শতাংশেরও কম আনুষ্ঠানিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পান।
এই বিশাল ব্যবধান সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, জরুরি অবস্থায় ট্রমা-ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার কতটা অপ্রতুল এবং মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে এই সেবাকে কী পরিমাণে অবহেলা করা হয়েছে। এটি কেবল স্বাস্থ্য সংকট নয়, বরং মানবিক ট্র্যাজেডির এক নীরব চিত্র।
অন্যদিকে, দেশের স্বাস্থ্যখাতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনও অত্যন্ত দুর্বল। WHO-SEARO (২০২৪)-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের বিপরীতে মাত্র ০.২ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক। এই জনবলের তীব্র অভাব এবং সেবার বিকেন্দ্রীকরণের ব্যর্থতার কারণে দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় বা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বিশেষায়িত সেবা প্রায় অনুপস্থিত।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, মানসিক সমস্যার জন্য চিকিৎসা নিতে আগ্রহী মানুষেরা মূলত কলঙ্কবোধ (Stigma), আর্থিক অসুবিধা, এবং সেবার অপ্রাপ্যতার কারণে চিকিৎসা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের জরিপে দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ মানুষ গুরুতর মানসিক উদ্বেগে ভুগছিলেন, যা প্রমাণ করে যে, সংকটকালে জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা কতটা তীব্র।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ (যেমন: কমিউনিটি-ভিত্তিক কাউন্সেলিং, মোবাইল ক্লিনিক) দেখা গেলেও, এগুলো অত্যন্ত সীমিত পরিসরে পরিচালিত হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন কাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। এই প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতিই বিপর্যয়কালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকারকে এক মারাত্মক মানবিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যকর করার জন্য বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা প্রদান করা হয়েছে। WHO ও ইউনিসেফের প্রস্তাবিত “লেয়ার্ড কেয়ার মডেল” অনুযায়ী, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা একটি পিরামিড আকারের কাঠামোতে একাধিক স্তরে প্রদান করা উচিত। এই মডেলের সবচেয়ে নিচের এবং বিস্তৃত ভিত্তিস্তরটি হলো ব্যাপক সামাজিক সমর্থন, নিরাপত্তা ও মৌলিক মানসিক প্রাথমিক চিকিৎসা (Psychological First Aid), যা অ-বিশেষজ্ঞ ভলান্টিয়াররাও দিতে পারেন। তার উপরের স্তরে থাকে প্রশিক্ষিত সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী বা কমিউনিটি ভলানটিয়ারদের মাধ্যমে সরবরাহকৃত সংক্ষিপ্ত মনোসামাজিক চিকিৎসা। আর পিরামিডের একেবারে শীর্ষে থাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের মাধ্যমে গুরুতর রোগীদের বিশেষায়িত চিকিৎসা।
এই মডেলের মূল ভিত্তি হলো ‘টাস্ক-শেয়ারিং’ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি বিশেষায়িত জনবলের তীব্র অভাব মেটাতে সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী ও কমিউনিটি কর্মীদের নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রাথমিক মানসিক সেবা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার ওপর জোর দেয় (WHO ২০২৫; PAHO, ২০২৪)। এই কৌশল নিশ্চিত করে যে, চরম জরুরি পরিস্থিতিতেও যেন প্রতিটি স্তরের চাহিদাকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করা যায়। এভাবে সেবার প্রবেশাধিকারের একটি কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি হয়, যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রুত এবং যথাযথ মানসিক সহায়তা প্রদান সম্ভব।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা একীভূত করার প্রচেষ্টা এবং মোবাইল ইউনিটের মাধ্যমে কাউন্সেলিং-এর মতো উদ্যোগ এই লেয়ার্ড কেয়ার মডেলের বাস্তবায়ন। এটি বিশেষভাবে জরুরি, কারণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষায়িত জনবল প্রায় অনুপস্থিত। তবে, এই উদ্যোগগুলোর পরিধি ব্যাপক করার পাশাপাশি তদারকি ও মাননিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়া অপরিহার্য। কার্যকরভাবে সেবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হলে এই সীমিত উদ্যোগগুলোকে একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন কাঠামোর সাথে যুক্ত করতে হবে, যাতে বিপর্যয়ের সময় এবং তার পরেও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নিরবচ্ছিন্ন থাকে।
জলবায়ু পরিবর্তন মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক-এর তথ্য মতে, ২০২৪ সালে তীব্র গরম ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল প্রায় $১.৮ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল ক্ষতির প্রভাব কেবল অর্থনৈতিক নয়, মানুষের মানসিক স্থিতিশীলতাকেও গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে।
তাপপ্রবাহ, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, এবং জীবিকা বা ফসলের ক্ষতিজনিত চাপ সরাসরি মানুষের মানসিক স্থিতিস্থাপকতাকে ভেঙে দিচ্ছে। জলবায়ুজনিত ট্রমা, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা এবং স্থানচ্যুতির ভয়—এগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের একটি নতুন অথচ দ্রুত ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ।
তাই, এখন মানসিক স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু অভিযোজন নীতিকে অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা আবশ্যক। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় যত উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, যদি ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যের পুনর্বাসন না হয়, তবে অভিযোজন বা স্থিতিস্থাপকতা (Resilience) অর্জন করা অসম্ভব হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে জলবায়ু কর্মপরিকল্পনার কেন্দ্রে আনতে হবে।
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য—"সেবায় প্রবেশাধিকার: বিপর্যয় ও জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য"—কে বাস্তবে রূপ দিতে হলে কিছু জরুরি ও কাঠামোগত নীতিগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে পাঁচটি অপরিহার্য নীতিগত সংস্কার অপরিহার্য:
১. মানসিক স্বাস্থ্যকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মূল স্রোতে আনা: মানসিক স্বাস্থ্যকে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অংশ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে। এর জন্য সুস্পষ্ট বাজেট ও কর্মপরিকল্পনা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে বিপর্যয় শুরু হওয়ার মুহূর্ত থেকেই মনোসামাজিক সহায়তাকে ত্রাণের মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২. সেবার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ ও জনবল তৈরি: প্রাথমিক ও কমিউনিটি পর্যায়ে সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসিক সেবার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে হবে। এর মাধ্যমে 'টাস্ক-শেয়ারিং' পদ্ধতি কার্যকর হবে এবং বিশেষজ্ঞ সেবার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাথমিক সহায়তা নিশ্চিত করা যাবে।
৩. দূরবর্তী ও নমনীয় সেবা ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ: টেলি-হেলথ, মোবাইল ক্লিনিক ও অনলাইন কাউন্সেলিং-এর মতো নমনীয় ও দূরবর্তী সেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। এই ব্যবস্থাগুলো জরুরি অবস্থায়ও পরিষেবা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে পারে এবং দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বা স্থানচ্যুত জনগোষ্ঠীর কাছে সহজে পৌঁছাতে পারে।
৪. জলবায়ু অভিযোজন নীতিতে মানসিক স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তিকরণ: জলবায়ু অভিযোজন বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নির্দিষ্ট উপাদান সংযোজন করা জরুরি। পরিবেশগত সংকট, ফসলের ক্ষতি বা স্থানচ্যুতির মতো ঘটনার মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রশমিত করতে এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা (Resilience) তৈরি করতে এটি একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ।
৫. শক্তিশালী জাতীয় তথ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা: সেবার প্রবেশাধিকার, গুণমান ও ফলাফল (Outcomes) ট্র্যাকিং করার জন্য একটি শক্তিশালী জাতীয় তথ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই তথ্য-কাঠামো নীতিনির্ধারকদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবং সেবার কার্যকারিতা মূল্যায়নে সহায়তা করবে।
মানসিক স্বাস্থ্য কেবল বিপর্যয়ের পরবর্তী ‘সান্ত্বনা’ নয়, এটি জাতীয় পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের পূর্বশর্ত। যখন কোনো শিশু ট্রমার কারণে স্কুলে যেতে ভয় পায়, যখন একজন নারী অতীতের সহিংসতার স্মৃতি থেকে মুক্তি পান না, বা একজন কৃষক ক্ষতির হতাশায় কাজের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন—তখন মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অভাব কেবল ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, তা সমাজে দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতা তৈরি করে।
এই বছরের প্রতিপাদ্য একটি সুস্পষ্ট আহ্বান: সহানুভূতিকে কার্যকর ও টেকসই নীতিতে রূপান্তর করা। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বে এখন সময় এসেছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার, যাতে বিপর্যয়ের সময় পরিষেবা ভেঙে না পড়ে বরং আরও শক্তিশালী হয়।
মানসিক স্বাস্থ্য হলো মানবিক মর্যাদা, পুনর্গঠন ও স্থিতিস্থাপকতার (Resilience) কেন্দ্রবিন্দু। একে উপেক্ষা করার অর্থ হলো, সমাজের নীরব ক্ষতগুলোকে অনন্তকালের জন্য রক্তাক্ত রেখে দেওয়া। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫ আমাদের সেই নীরব ক্ষতগুলোকেই দৃশ্যমান করে তুলছে—এবং আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে, যেন “সংকটকালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার” সবার জন্য একটি নিশ্চিত বাস্তবতা হয়ে ওঠে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/এএসএম
টাইমলাইন
- ০৮:৩৬ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ দুর্যোগে মানসিক স্বাস্থ্য: দ্রুত সেবা ও সচেতনতার ওপর বিশেষ জোর
- ০৮:০৯ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ আশ্বাসে আশান্বিত হতেন মাইলস্টোনে আহতদের স্বজনরা
- ০৭:২৪ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ পরীক্ষায় খারাপ ফল করায় আত্মহননের প্রবণতা বাড়ছে, করণীয় কী
- ০৭:০৯ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ সাইকিয়াট্রিক নার্সদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ জরুরি
- ০৫:৫৪ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট নিয়োগ
- ০৪:৪৪ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ মানসিক রোগী মানেই বলে ‘পাগল’, চিকিৎসার বাইরে ৯২ শতাংশ
- ০৩:৪৬ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ ইন্টারনেট আসক্তিতে বাড়ছে তরুণদের মানসিক চাপ
- ০৩:৩৯ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ শিশুর ইন্টারনেট আসক্তি মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিতে হবে পরিবারকেই
- ০১:৫৪ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ দুর্যোগের সময় একজন সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলর খুবই জরুরি
- ১২:২৫ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ আইনে শাস্তির বিধান থাকায় আত্মহত্যার বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না
- ১১:৫৫ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ লাইক আর ফলোয়ার নির্ভর সুখের বিপরীত চিত্র
- ১০:৫৭ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ ‘মানসিক বিপর্যয়ে’ পাবনা মানসিক হাসপাতাল
- ১০:১৩ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ পড়ালেখার ধরন বদলে যাওয়ায় মানসিক চাপে শিশু শিক্ষার্থীরা
- ০৯:৫৩ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ সংকটকালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার
- ০৮:৪৫ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ দুর্যোগ পরিস্থিতিতে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক রোগে আক্রান্ত হন
- ০৮:৩০ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২৫ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস আজ
- ১০:০৬ পিএম, ০৯ অক্টোবর ২০২৫ মানসিক রোগীদের ৯২ শতাংশই চিকিৎসার বাইরে, প্রধান অন্তরায় লজ্জা
- ০৪:৩০ পিএম, ০৯ অক্টোবর ২০২৫ বছরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০-৬০ লাখ মানুষ
- ১১:০৭ এএম, ০৯ অক্টোবর ২০২৫ যে কোনো বিপর্যয়ে মনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি
- ০৯:৪৪ এএম, ০৮ অক্টোবর ২০২৫ গাছ কমাতে পারে আপনার মানসিক চাপ
- ০৫:২৯ পিএম, ০৭ অক্টোবর ২০২৫ ব্যক্তিত্বজনিত মানসিক সমস্যা হতে পারে শৈশবের ট্রমা থেকে
- ০৭:১৮ পিএম, ০৬ অক্টোবর ২০২৫ বুলিরা কেন বুলিং করে
- ০৫:০৬ পিএম, ০২ অক্টোবর ২০২৫ অতিরিক্ত রাগ কীসের লক্ষণ