ভিডিও EN
  1. Home/
  2. তথ্যপ্রযুক্তি

শিশুর ডিভাইস আসক্তি প্রতিরোধের কার্যকর উপায়

তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৬:২৫ পিএম, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫

ফয়সাল হাবিব

বর্তমান ডিজিটাল যুগে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু শিশুদের জন্য ডিভাইসগুলো আশীর্বাদ নয় বরং অভিশাপ। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যা বাবা-মায়ের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়।

শিশুর ডিভাইস আসক্তির মূলে থাকা মনস্তাত্ত্বিক এবং পরিবেশগত কারণগুলো বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:

ডোপামিন নির্ভরতা
শিশুর ডিভাইস আসক্তির অন্যতম প্রধান মনস্তাত্ত্বিক কারণ মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোনের দ্রুত নিঃসরণ। যখন শিশুরা স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটে কোনো দ্রুত পরিবর্তনশীল গেম খেলে বা আকর্ষণীয় ভিডিও দেখে; তখন মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টার বা পুরস্কার কেন্দ্রে আনন্দের নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিন খুব দ্রুত এবং প্রচুর নিঃসৃত হয়। এই রাসায়নিক নিঃসরণ শিশুকে তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি এবং তীব্র আনন্দের অনুভূতি দেয়। বারবার তীব্র আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা শিশুদের মনে প্রত্যাশা তৈরি করে, তারা স্বাভাবিক খেলাধুলা, বইপড়া বা বাস্তব জীবনের ধীরগতির কার্যকলাপের মধ্যে একই মাত্রার আনন্দ খুঁজে পায় না। ফলে তাদের কাছে বাস্তব জগৎ ক্রমশ নিরস ও আকর্ষণহীন মনে হয়। তারা আরও বেশি সময় ডিভাইসে কাটাতে চায়।

অভিভাবকের নির্লিপ্ততা
অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের কাজের সুবিধার জন্য বা সাময়িকভাবে শিশুকে শান্ত রাখার জন্য ডিভাইসের আশ্রয় নেন। শিশুকে খাওয়ানোর সময় বা দীর্ঘ যাত্রাপথে কান্না থামাতে ডিভাইস তুলে দেন। যা আপাতদৃষ্টিতে অভিভাবককে স্বল্পমেয়াদে স্বস্তি দিলেও মূলত শিশুর মধ্যে ডিভাইস ব্যবহারের নেতিবাচক শর্তাধীন অভ্যাস তৈরি করে। শিশু শিখে যায়, কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বা বোরিং সময় এড়ানোর জন্য ডিভাইস সহজ সমাধান। দীর্ঘমেয়াদে পদ্ধতিটি শিশুর মস্তিষ্কে ডিভাইস আসক্তির বীজ বপন করে। কারণ এটি ডিভাইসের সাথে আরাম ও স্বস্তির অনুভূতিকে যুক্ত করে।

পরিবেশের প্রভাব
শিশুরা চারপাশের পরিবেশ এবং অভিভাবকদের আচরণ অনুকরণ করে। যখন বাবা-মা, ভাই-বোন বা পরিবারের সদস্যরা সারাক্ষণ স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটে ব্যস্ত থাকেন; তখন শিশু ধরে নেয়, ডিভাইসের ব্যবহার স্বাভাবিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। তারা প্রতিনিয়ত দেখছে, কীভাবে বড়রা স্ক্রল করছে বা ফোনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। ফলে সহজেই সেই আচরণ অনুকরণ করতে শুরু করে। ঘরের মধ্যে ডিভাইসের সর্বব্যাপী উপস্থিতিই শিশুদের আসক্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তিশালী পরিবেশগত কারণ হিসেবে কাজ করে।

সহজলভ্যতা
বর্তমানে মোবাইল ফোন বা ট্যাবলেট অত্যন্ত সহজলভ্য। বেশিরভাগ বাড়িতেই একাধিক ডিভাইস থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলোর পাসওয়ার্ড বা প্যাটার্ন লক শিশুর জানা থাকে বা সহজে অনুমান করা যায়। ডিভাইসের এই সহজ অ্যাক্সেস শিশুর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। কোনো কঠিন নিয়ম বা বাধা না থাকলে শিশুরা খুব সহজেই যে কোনো সময় ডিভাইস হাতে তুলে নিতে পারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতে পারে, যা ধীরে ধীরে আসক্তির জন্ম দেয়।

কনটেন্টের ডিজাইন
ডিজিটাল কনটেন্ট, বিশেষ করে শিশুর জন্য তৈরি ভিডিও গেম এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলো অত্যন্ত মনোযোগ-আকর্ষক উপায়ে ডিজাইন করা হয়। কনটেন্টগুলো দ্রুত পরিবর্তনশীল রং, উচ্চশব্দ, তাৎক্ষণিক পুরস্কার এবং লুপে চলতে থাকা ভিডিওর মতো উপাদান ব্যবহার করে। এ ডিজাইন কৌশলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে ব্যবহারকারীর মনোযোগ ধরে রাখা। তাকে ক্রমাগত ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা। এ ধরনের ডিজাইনের শিকার হয়ে শিশুরা স্ব-নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারাতে থাকে। তাদের পক্ষে এ ধরনের ডিভাইস থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যা আসক্তিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

সবশেষে স্ক্রিন ব্যবহারের বিষয়টি লুকানোর চেষ্টা করা একটি গুরুতর সংকেত। শিশুটি যখন গোপনে ডিভাইস ব্যবহার করে, মোবাইল বা ট্যাব নিয়ে অন্য রুমে চলে যায় কিংবা ব্যবহারের সময় বা কী দেখছে সে সম্পর্কে মিথ্যা বলে; তখন তা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করে যে, তার ব্যবহারটি একটি অস্বাস্থ্যকর ও গোপনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি কোনো সাধারণ বদঅভ্যাস নয় বরং একটি আসক্তি। যার জন্য নিজেরই লজ্জা ও অপরাধবোধ কাজ করছে।

>> আসক্তির লক্ষণসমূহ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ব্রেইন অ্যান্ড লাইফ ম্যাগাজিনের মতো বিশ্বস্ত সূত্রগুলো স্ক্রিন আসক্তির বেশ কয়েকটি স্পষ্ট লক্ষণ চিহ্নিত করেছে। লক্ষণগুলো শনাক্ত করতে পারলেই পদক্ষেপ নিতে পারেন।

প্রথমত, স্ক্রিনের পেছনে অত্যধিক সময় ব্যয়। শিশু যখন তার সব অবসর, এমনকি পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়া বা পরিবারের সাথে সময় কাটানোর বেলায়ও ডিভাইস ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেয়; তখনই তা আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সে হয়তো গেম খেলা বা ভিডিও দেখার জন্য রাত জাগতে শুরু করে। যা স্বাভাবিক দৈনন্দিন রুটিন ও ঘুমের চক্রকে সম্পূর্ণভাবে বিঘ্নিত করে।

দ্বিতীয়ত, বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের তুলনায় ডিভাইসকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া একটি বড় ইঙ্গিত। শিশুটি যখন পারিবারিক আড্ডা, সামাজিক অনুষ্ঠান বা বন্ধুদের সাথে খেলাধুলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং ভার্চুয়াল জগতকেই বাস্তবের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে; তখন বুঝতে হবে সে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ডিভাইসটি তার কাছে বন্ধু ও পরিবারের বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়।

তৃতীয়ত, সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলা। স্ক্রিনের সামনে বসলে শিশুর সময়ের কোনো হিসাব থাকে না। তাকে আধা ঘণ্টার জন্য ডিভাইস দিলে সে একটানা কয়েক ঘণ্টা ধরে ব্যবহার করতে থাকে। খাওয়া বা অন্য কোনো জরুরি কাজের কথা সে সম্পূর্ণভাবে ভুলে যায়। এ অবস্থাকে প্রায়ই ‌‘স্ক্রিন টাইম হাইপনোসিস’র সাথে তুলনা করা হয়। যেখানে শিশু চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে সচেতনতা হারিয়ে ফেলে।

চতুর্থত, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। ডিভাইস থেকে দূরে থাকলে বা এটি ফেরত নেওয়ার সময় শিশু অস্বাভাবিক রাগ, বিরক্তি বা উত্তেজনা দেখায়। তার মেজাজ খুব সহজেই খারাপ হয়ে যায়। অল্পতেই রেগে যেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে নিজেকে গৃহকোণে বা নিজের রুমে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে।

পঞ্চমত, পড়ালেখা ও পূর্বের পছন্দের শখের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। যে শিশুটি আগে বই পড়তে, আঁকাআঁকি করতে বা বাইরে খেলতে পছন্দ করতো; সে এখন শুধু ডিভাইস নিয়েই ব্যস্ত। তার একাডেমিক পারফর্মেন্স খারাপ হতে শুরু করে। কারণ পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। স্ক্রিনই একমাত্র বিনোদন ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

>> শিশুর ডিভাইস আসক্তির প্রভাব

শারীরিক স্বাস্থ্য
অতিরিক্ত স্ক্রিন ব্যবহারের ফলে শারীরিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। দীর্ঘসময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকায় চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হতে পারে। বিশেষ করে, কম আলোয় বা খুব কাছ থেকে স্ক্রিন দেখলে চোখের পেশীর ওপর চাপ পড়ে। ফলে শুষ্ক চোখ, ঝাপসা দৃষ্টি এবং শেষমেশ মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা বাড়ে। এ ছাড়া ঘাড় নিচু করে বা সামনের দিকে ঝুঁকে বসে দীর্ঘক্ষণ স্ক্রল করার অভ্যাস ঘাড় ও পিঠে অসহ্য ব্যথা সৃষ্টি করে। এ অস্বাভাবিক ভঙ্গিমা মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক বাঁকে পরিবর্তন আনতে পারে। সবথেকে বড় সমস্যা হলো, স্ক্রিনের সামনে দীর্ঘসময় বসে থাকায় শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা বাড়ে, যা ধীরে ধীরে স্থূলতা বা ওবেসিটির দিকে পরিচালিত করে। শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে ক্যালোরি খরচ হয় না। শরীরের মেটাবলিজম বা বিপাক প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়।

মানসিক স্বাস্থ্য
স্ক্রিন আসক্তি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর নেতিবাচক ছাপ ফেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গেমের ভার্চুয়াল জগতে বেশি সময় কাটানোর ফলে বাস্তব জীবনের মিথস্ক্রিয়া কমে যায়, ফলস্বরূপ ব্যক্তি অতি-উদ্বিগ্নতা এবং বিষণ্নতায় ভোগে। অনলাইন জীবনের সাথে বাস্তব জীবনের তুলনা করার প্রবণতা থেকে জন্ম নেয় আত্মবিশ্বাসের অভাব। গেম বা সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি থেকে দূরে থাকতে না পারার কারণে নিজের ওপর আস্থা হারায়। কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষত গেমিংয়ের ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত উত্তেজনা বা পরাজয়ের হতাশা থেকে আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা দিতে পারে। গুরুতর আসক্তির ক্ষেত্রে, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা বা হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যেতে পারে।

বিকাশগত বাধা
বিশেষ করে শিশুর ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম বিকাশগত পথে বাধা সৃষ্টি করে। শৈশবে স্ক্রিনের প্রতি আসক্তি শিশুদের মানুষের মুখ বা অঙ্গভঙ্গি দেখে শেখার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ফলে তাদের ভাষা শেখায় বিলম্ব দেখা যায়। স্ক্রিনের আলো ও শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গেলে শিশুরা বাস্তব জীবনের খেলাধুলা বা মানুষের সাথে কথা বলায় আগ্রহ হারায়। ফলে সামাজিক মেলামেশায় অনীহা তৈরি হয়। এটি সামাজিক দক্ষতা বিকাশে বড় বাধা। এ ছাড়া দ্রুত পরিবর্তনশীল দৃশ্যাবলি এবং উচ্চ শব্দযুক্ত কনটেন্টে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে শিশুরা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে কোনো কাজে একাগ্রতা ও মনোযোগ দিতে পারে না। যা তাদের পড়াশোনা এবং শেখার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

মস্তিষ্কের গঠনে পরিবর্তন
গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম আক্ষরিক অর্থেই মস্তিষ্কের গঠনে পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষ করে, মস্তিষ্কের সেই অংশটি, যা চিন্তা করা, শেখা, পরিকল্পনা করা এবং স্মৃতিশক্তির জন্য দায়ী; সেই অংশটির ‘গ্রে ম্যাটার’ কমিয়ে দেয়। গ্রে ম্যাটার হলো মস্তিষ্কের সেই অংশ; যেখানে নিউরন বা স্নায়ুকোষের কোষদেহগুলো জমা থাকে। এর সংকোচন বা হ্রাস বুদ্ধিমত্তা এবং জ্ঞানীয় দক্ষতার ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরিবর্তনগুলো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। ফলে শেখার এবং নতুন কিছু মনে রাখার ক্ষমতা কমে যায়।

>> শিশুকে ডিভাইস আসক্তি থেকে রক্ষার কার্যকরী কৌশল

ইন্টারনেট অফ রেখে কনটেন্ট ডাউনলোড
ডিভাইস ব্যবহারের সময় ইন্টারনেট কানেকশন বা ওয়াই-ফাই বন্ধ রাখা একটি অত্যন্ত কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা। শিশুকে ডিভাইস দেওয়ার আগে তার বয়স, মানসিক বিকাশ এবং দেশের সংস্কৃতির উপযোগী শিক্ষামূলক ভিডিও, গল্প বা অ্যাপ আগে থেকে ডাউনলোড করে রাখুন। এর প্রধান সুবিধা হলো, শিশু ইন্টারনেটে ক্রমাগতভাবে স্ক্রল করতে থাকে না এবং ভুলবশত অনুপযোগী বা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তৈরি কনটেন্টে চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে না। এর মাধ্যমে শিশুর স্ক্রিন টাইম একটি নির্দিষ্ট, নিরাপদ ও শিক্ষামূলক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

শিক্ষামূলক অ্যাপকে প্রাধান্য দেওয়া
ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম যেখানে কনটেন্ট পরিবর্তনশীল এবং নিয়ন্ত্রণহীন, তার পরিবর্তে এমন অ্যাপ্লিকেশনগুলোর ব্যবহারকে উৎসাহিত করুন। যা খেলার ছলে শেখার সুযোগ করে দেয়। যে ইন্টারেক্টিভ অ্যাপগুলো শিশুর অক্ষরজ্ঞান, সংখ্যাজ্ঞান বা সৃজনশীলতার মতো দক্ষতা বিকাশে সাহায্য করে। অ্যাপগুলো প্যাসিভ ভিউয়িংয়ের পরিবর্তে সক্রিয় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে, যা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য অনেক বেশি উপকারী।

পাসওয়ার্ড গোপন
আপনার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন বা ট্যাবলেটের পাসওয়ার্ড বা প্যাটার্ন লক শিশুর নাগালের বাইরে রাখুন। শিশুরা অত্যন্ত দ্রুত শেখে এবং একবার যদি তারা ডিভাইসের লক খোলার পদ্ধতি জেনে যায়, তবে তারা যে কোনো সময় ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। যদি কোনোভাবে শিশু পাসওয়ার্ড জেনে যায়, তবে বিলম্ব না করে তা তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তন করুন। কৌশলটি ডিভাইসের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার রোধ করার একটি প্রাথমিক ধাপ।

ইন্টারেক্টিভ স্ক্রিন টাইম
স্ক্রিন টাইমকে ‘প্যাসিভ’ বা নিষ্ক্রিয় রাখা উচিত নয়। শিশু যখন কিছু দেখছে; তখন অভিভাবকের উচিত তার পাশে বসা এবং সেই কনটেন্ট নিয়ে শিশুর সাথে কথা বলা। উদাহরণস্বরূপ, শিশু যদি একটি ভেড়ার ভিডিও দেখে, আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন: ‘ভেড়াটার গায়ের রং কী?’, ‘ওটা কেমন আওয়াজ করছে?’ এ ধরনের আলোচনা শিশুর শেখার প্রক্রিয়াকে গভীর করে, ভাষাগত দক্ষতা বাড়ায় এবং স্ক্রিনের কনটেন্টকে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করতে সাহায্য করে।

নিজস্ব ডিভাইস না দেওয়া
শিশুর জন্য নিজস্ব কোনো মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট বা আইপ্যাড না রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। যদি আপনার শিশু জানতে পারে যে, তার হাতের কাছে সব সময় ব্যক্তিগত ডিভাইস আছে। তবে আসক্তি কমানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ ছাড়া বাইরে কোথাও গেলে শিশুকে সার্বক্ষণিক ডিভাইস দিয়ে শান্ত রাখার অভ্যাস বর্জন করুন। তাকে প্রকৃতি দেখতে, নতুন কিছু আবিষ্কার করতে এবং অন্যান্য শিশুদের সাথে মিশতে উৎসাহ দিন। যা তাদের সামাজিক ও আবেগিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য।

সময় বেঁধে দেওয়া
ডিভাইস ব্যবহারের আগে সুস্পষ্টভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করে দিন। যেমন, ‘তুমি এখন ৩০ মিনিটের জন্য কার্টুন দেখতে পাবে।’ সময় শেষ হলে শিশু কান্নাকাটি বা বায়না করলেও অভিভাবককে অবশ্যই তার সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকতে হবে। একবার নমনীয়তা দেখালে শিশু বুঝে যায় যে, কান্নাকাটি করলে সময় বাড়ানো যায়, যা ভবিষ্যতে আসক্তি আরও বাড়িয়ে তোলে। সময়সীমা সম্পর্কে অটল থাকা শিশুদের সীমানা এবং নিয়ম মানতে শেখায়।

খাওয়ার অভ্যাস
অনেক শিশু স্ক্রিন ছাড়া খেতে চায় না, যা আসক্তির স্পষ্ট লক্ষণ। অভ্যাসটি বদলানোর জন্য ধীরে ধীরে স্ক্রিন ছাড়া খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রথমে এক বেলায় স্ক্রিনসহ খাওয়ালে অন্য বেলায় স্ক্রিন ছাড়া খাওয়ানোর চেষ্টা করুন। শিশুকে নিজের হাতে খাওয়া শেখানো বা খাওয়ার সময় খাবারের গুণাগুণ নিয়ে গল্প করা মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। এটি খাদ্য গ্রহণের সময় মনোযোগ ও পারস্পরিক যোগাযোগের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করে।

বিকল্প কর্মকাণ্ড তৈরি
শিশুকে ডিভাইসের জগৎ থেকে দূরে রাখতে হলে বাস্তব জগতের আকর্ষণীয় বিকল্প দিতে হবে। তাকে বইপড়ার অভ্যাস গড়তে সাহায্য করুন। তার সাথে বিভিন্ন ধরনের ইনডোর বা আউটডোর গেম খেলুন। গান শোনা, ছড়া বলা, বাগান করা বা পার্কে খেলাধুলা করার মতো কাজগুলোতে উৎসাহিত করুন। এমনকি ঘরের ছোট ছোট কাজ যেমন–ফুল গাছে জল দেওয়া বা খেলনা গুছিয়ে রাখার মতো কাজে তাকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করুন, যা তাদের দায়িত্ববোধ এবং সৃজনশীলতা বাড়ায়।

বাবা-মায়ের আসক্তি কমানো
ডিভাইস আসক্তি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এটি। শিশুরা অভিভাবকদের অনুকরণ করে শেখে। যদি বাবা-মায়েরা সারাদিন ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তবে শিশুও সেটাই স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে দেখবে। ডিভাইসের প্রতি তার আগ্রহ বাড়বে। অভিভাবক হিসেবে আপনি যা সন্তানকে শেখাতে চান, তা সবার আগে নিজেকে অনুশীলন করতে হবে। পরিবারের জন্য ‘ফোন ফ্রি’ সময় বা জোন তৈরি করা উচিত।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু
যেসব শিশুর বিকাশে বিশেষ চাহিদা আছে, যেমন–কথা বলতে দেরি হওয়া, চোখে চোখ রেখে তাকানো কম হওয়া বা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া কম থাকা, তাদের ক্ষেত্রে স্ক্রিন টাইমের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর হতে হবে। এ ধরনের শিশুর ক্ষেত্রে স্ক্রিন টাইম শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনাই শ্রেয়। কারণ স্ক্রিন থেকে প্রাপ্ত দ্রুত পরিবর্তনশীল উদ্দীপনা তাদের সংবেদনশীল প্রক্রিয়া এবং ভাষা বিকাশের কেন্দ্রকে আরও ব্যাহত করে। থেরাপির মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতাগুলোকে ম্লান করে দিতে পারে। শিশুর বিকাশের জন্য বাস্তব জগতের, একমুখী এবং ইন্টারেক্টিভ থেরাপিউটিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।

ডিভাইস বা স্ক্রিন কখনোই মানুষের বিকল্প হতে পারে না। শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য তাকে প্রচুর সময় দিন। তার সাথে গুণগত সময় কাটান। প্রযুক্তি বর্জন নয় বরং সুস্থ ও ব্যবহারই লক্ষ্য হওয়া উচিত। সচেতনতাই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি ভয়াবহ নেশার হাত থেকে রক্ষা করতে।

লেখক: প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাঞ্ছারামপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ।

আরও পড়ুন
কেনাকাটায় সাহায্য করবে এআই 
কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য ফেসবুকের ৩ নতুন নির্দেশনা 

এসইউ

আরও পড়ুন