৩০০ বছরের পুরোনো কালাচাঁদের মেলায় একদিন
বিলকিস নাহার মিতু
বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ মেলা। মেলায় যেমন বাহারি জিনিস দেখতে পাওয়া যায়; তেমনই অনেক জ্ঞানও অর্জন হয়। একেক মেলা আবার একেক পরিচয় বহন করে। তেমনই একটি মেলা বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলায় প্রতি বছরই আয়োজিত হয়। প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো এই মেলাকে ‘তক্কা বাড়ির মেলা’, ‘কালাচাঁনের মেলা’ বা ‘কালাচাঁদ আওলিয়ার মেলা’ বলে লোকে চেনে।
একবার এক বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করে শুনেছিলাম কালাচাঁদ আওলিয়ার কাহিনি। তিনিও শুনেছেন তাদের বড়দের থেকে। পানগুছি নদীতে একটা ঝুড়ির মধ্যে ভাসতে ভাসতে এসেছেন কালাচাঁদ। তারপর কাজী বাড়ির বটগাছের নিচে তার আশ্রয় হয় এবং সেখানেই তিনি তার জীবদ্দশা পার করেছেন। লোকমুখে প্রচলিত যে, তিনি নাকি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সুন্দরবনের বাঘের পিঠে ঘুরে বেড়াতেন।
এ ছাড়া আরও শোনা যায়, একবার এক লোক কালাঁচাদকে শীতার্ত দেখে তার গায়ের চাঁদরটি দিয়ে দেয়। কিন্তু কালাচাঁদ সেটিকে তার সামনে রাখা জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে ফেলেন। এ অবস্থা দেখে সেই লোক আফসোস করলে তাকে আবারও সেই চাদর অক্ষত অবস্থায় আগুন থেকে তুলে ফেরৎ দেন। এ রকম নানা গল্প আছে তাকে ঘিরে। কিন্তু তার অন্য কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।

একপর্যায়ে কালাচাঁদ নিজের কবর নিজেই খুঁড়ে জ্যান্ত কবর নেন। তার কবরকে কেন্দ্র করেই মাজার নির্মিত হয়। মাজারের চার কোণায় ৩টি করে ১২টি পিলার দেওয়া। মাজারের সামনে আছে মসজিদ। পাশেই ৩০০ বছরের পুরোনো কালের সাক্ষী বটগাছ। এরপর থেকে তার অনেক ভক্ত তৈরি হয়। পরে প্রতি বছর এখানে ডিসেম্বরের ৮ তারিখ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত মেলা চলে। ১০-১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে ভরমেলা। অনেক বাউল-ফকিরেরা মাজারের চারপাশে বসে গান-বাজনা করেন। ভক্তরা মোমবাতি জ্বালিয়ে দোয়া-দরুদ করেন। আবার অনেকে মানত করে টাকা দেন মাজারে।
ছোটবেলায় ২-৩ বার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এরপর আর মেলায় যাওয়া হয়নি। ভাবলাম এ বছর মেলায় যাবো। কিন্তু পরীক্ষার কারণে সময়মতো আসা হয়নি। পরীক্ষা শেষে ১৩ ডিসেম্বর পৌঁছলাম মোরেলগঞ্জে আপুর বাসায়। আপু আর ২ ভাগ্নিসহ পরিচিত এক ছোটভাইকে নিয়ে মেলা পরিদর্শনে ঢুকলাম। গেটের বাইরেই সারি সারি ফার্নিচারের দোকান। মন্ডা-মিঠাই, গজা, ভেলপুরি, ফুচকার দোকান।

আরও পড়ুন
যশোরে ঘুরতে গেলে যা যা দেখবেন
সমুদ্রের ডাক আর নোনাজলের স্মৃতি
মেলার গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই রাস্তার দুপাশে ঘিরে আছে নানা জিনিসের দোকান। মাটির তৈরি পুতুলসহ, হাঁড়ি-পাতিল, ফল ইত্যাদি জিনিস। আছে কাঠের ডিজাইনে নাম খোদাই করা। তার পাশে ৩-৪ ধরনের নাগর দোলা ও বাচ্চাদের ট্রেন। ভূতের বাক্স আছে। তাছাড়া চানাচুর-বুট ভাজা আর পাপড়, জিলাপি, বাতাসার দোকান তো আছেই।
সামনে এগোতে চোখে পড়লো প্লাস্টিকের ছাতা, হারিকেন; যাতে লাইট জ্বলে। ঝিলিমিলি বেলুন, গ্যাস বেলুন, ছোট ছোট খেলনা ফার্নিচার আর মেয়েদের যাবতীয় জুয়েলারি, কসমেটিকস সুসজ্জিত আছে। ছেলেদের শার্ট-প্যান্টের দোকানও দেখতে পেলাম। বড় ভাগ্নি একটা ব্যাগ কিনলো। ছোট ভাগ্নি যা দেখে, তা-ই কিনতে চায়।

এদিকে আমার পরিচিত ছোটভাই গোলাম রাসুল আমাদের মেলা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে আর ছবি তুলে দিচ্ছে। স্টিলের গামলা, বাটি, মগ, খুন্তিসহ কাঠের বেলুন-পিঁড়ি, হামানদিস্তা সবই এ মেলায় দেখতে পেলাম। আমি ছোটবেলায় পছন্দের খেলনা গাড়ি টমটম দেখে লোভ সামলাতে না পেরে কিনলাম নিজের জন্য।
দুপুরে মেলায় গিয়েছি বলে ভিড় কম ছিল। তবে ভরমেলার দিনগুলোয় ভিড় বেশি হয়। সব দোকান ঘোরা শেষে বের হয়ে আসার পথে ভাগ্নিরা আর ছোটভাই নাগরদোলায় চড়লো। এরপর বাসায় ফিরে আসার পর বিকেলে আমি বান্ধবী রাফিয়াকে নিয়ে আবার মেলায় গেছি। ২০২২ সালের পর ওর সাথে আর দেখা হয়নি। সঙ্গে ওর ছোট বোনকেও নিয়ে এলো।

ওদের নিয়ে আবারও মেলাটাকে পরিদর্শন করলাম। মেলায় ফুচকাগুলো ভালো লাগলো না দেখতে। তাই কয়টা বাতাসা কিনে সবাই মিলে একটু খেলাম। আসার পথে রাফিয়া আবার পাপড় কিনে দিলো। আমি তাইফের জন্য লিচু নিয়ে চলে এলাম বাসার দিকে। অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও লোক আসে কালাচাঁদের মাজার দেখতে এবং ইতিহাস জানতে। এটি মোরেলগঞ্জবাসীদের জন্য অত্যন্ত গর্বের।
লেখক: অনার্স ৩য় বর্ষ, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।
এসইউ