নৌকায় চড়ে নাসিরনগরে একদিন
সকালটা বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল। বোঝাই যাচ্ছে দিনটা কাটবে কেমন। তবে অন্য দিনের মত দিনটিও কাটবে এমন কিন্তু নয়। ক’দিন ধরেই ভাবছি- নৌকা ভ্রমণ করব। কিন্তু সুযোগ হয়নি তাই সদ্ব্যবহারও হচ্ছে না। কিন্তু এভাবে আচমকা নৌকা ভ্রমণ হবে তা অদৌ জানা ছিলো না।
20170710123727.jpg)
তখন সকাল আটটা হবে হয়ত। আমি আটটায় কখনো ঘুম থেকে উঠি না। খুব ভোরেই উঠি। সেদিন কী যেন হলো- লম্বা ঘুমে নিমগ্ন ছিলাম। ততক্ষণাৎ আমার ফোনে মৃদু সুরে বেজে উঠল ‘চল হারাই দূর অজানায়’ গানটার থিম। যদিও আমি ফোনে কোন গান রিং টোন হিসেবে সেট করি না। তবে ওই গানটা হয়ত সেদিন রাতে রিং টোন হিসেবে সেট হয়েছিল। তবে একরকম একটা গান সকালে শুনে ঘুম ভাঙা সত্যিই অন্যরকম। ত্রিশ সেকেন্ডের গানটা শুনতে বেশ ভালোই লাগছিল।
20170710123724.jpg)
দু’চার বার শোনার পর মনে হলো- কারো কল আসছে আমার ফোনে। তড়িৎ গতিতে ফোনটা কাছে নিলাম। দেখলাম কামরুল আঙ্কেলের ফোন। রিসিভ করতেই তিনি অফার করলেন নৌকায় চড়ে ভাটি এলাকায় যাওয়ার। নির্দ্বিধায় বললাম, ‘আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাজারে আসতেছি।’ যদি অন্য কেউ অফার করত হয়ত সোজাসাপ্টা হ্যাঁ বলতাম না। যা হোক- নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাজার হয়ে গেলাম নাসিরনগর ডাকাবাংলোর নৌকাঘাট। এসে দেখি এলাকার সব প্রিয়মুখ। সবাই নৌকায় উঠতে ছটফট করছে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে উঠলাম নৌকায়।
20170710123721.jpg)
রোদে ঝলমল করছে লংগনের পানি। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে- যেন মুক্তার চড় ভেসে আছে খানিকটা। রোদের তাপে কেউ কেউ নৌকার ভেতরে আবার কেউ উপরে। আমি রোদ উপেক্ষা করে নৌকার ছাউনির উপরেই বসলাম।
20170710123718.jpg)
নৌকা চলল ভাটির উদ্দেশে। কিন্তু যাত্রীদের মনে উদ্দেশের অভার নেই। কারণ তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মাঝেমাঝে ধমকা হাওয়া যখন গায়ে লাগে; তখন আমি এ অনুভূতিটাকেই স্বর্গসুখ বুঝি। চারপাশে মৃদু ঢেউয়ের খেলা। একেকটা ঢেউ কাছ থেকে যেন ভেসে যাচ্ছে দূর থেকে বহুদূর। হয়তো মিশে গেছে অজানা কোন নদী বা সাগরে। নৌকা যতই সামনে এগোচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য। মনে হচ্ছে- কোনো জাত ফটোগ্রাফার যদি এ রূপের ছবি তুলতো তাহলে পৃথিবীর যেকোন সৌন্দর্যের ছবিকে হার মানাতো। নয়নাভিরাম এ দৃশ্য সত্যিই আমাকে বারবার মুগ্ধ করে। তাই প্রতি বর্ষায় একবার হলেও এ পথ ধরে ছুটে চলি। তবে প্রকৃতিপ্রেমী যে কেউই মুগ্ধ না হয়ে পারবে না সেটা আমি হলফ করে বলতে পারি। কখন যে কান্দি পেরিয়ে ভলাকুট বাজারে আসলাম ঠিক মনে নেই।
20170710123714.jpg)
বাজারে পৌঁছতেই সে এলাকার প্রিয় বন্ধুবর মো. রোবেল মিয়ার আদর-আপ্যায়ন সত্যিই উল্লেখযোগ্য। তবে এই দাবদাহে তার দেওয়া কোমলপানীয় পান করার পর তৃপ্তির ঢেঁকুড়ই দোয়ার শামিল।
20170710123710.jpg)
বলতে গেলে নাসিরনগরে ছয় ঋতুর রূপ ছয় ভাবেই দেখা যায়। ছয় ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে নাসিরনগরের প্রকৃতিও। তার রূপের পসরা মুগ্ধ না করে পারে না আমাকে। পুলকিত করে রাখে এ অঞ্চলের মানুষকেও। নাসিরনগরের প্রকৃতিতে রয়েছে রৌদ্রতাপ গ্রীষ্ম, সজল বর্ষা, স্নেহময়ী শরৎ, সুমঙ্গলা হেমন্ত, ত্যাগব্রতী শীত এবং নন্দের অমৃত বসন্ত। বড় বৈচিত্র্যময় এ নাসিরনগর। আকাশ নদীর সঙ্গে চলে তার মিতালি। এ মিতালি যেন গ্রামের পথ বেয়ে চলে গেছে শহরে। যখন তখন দু’চোখ মেলে তাকালে মনে হয় কোনো শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা ছবি।
20170710123708.jpg)
প্রতিটা ঋতুর সঙ্গে নাসিরনগরের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। যেন ঋতুগুলো আসে নাসিরনগরকে একেক রকমভাবে সাজাতে। সূর্যের কঠিন শাসনে আগমন করে গ্রীষ্ম। পালাবদলে জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে আসে বর্ষা। বর্ষায় চারিদিক পানিতে টইটুম্বুর। আসে ‘ঝর ঝর মুখর বাদল দিন’। গাছের পাতায় টিনের চালে টাপুর-টুপুর একটানা সুর। এভাবেই কেটে যায় ঋতুগুলো।
20170710123705.jpg)
লংগনে বয়ে যায় নাইওরি নাও। মাঝি-মাল্লার মুখে ভাটিয়ালী গান। মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলের দল; যেন শোভা হয়ে আছে লংগনের বুকে। এ চির সবুজ দেশে যেন নাসিরনগর মায়ের বুকে শিশুর মতো।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
এসইউ/জেআইএম