আর কতদিন লিখতে হবে ‘ঢাকার বায়ু আজ খুবই অস্বাস্থ্যকর’

মো. হাসিবুর রহমান
মো. হাসিবুর রহমান মো. হাসিবুর রহমান , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৩৩ এএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩

 

অনলাইন গণমাধ্যমে যেহেতু ‘পাঠক ধরার’ তাড়া থাকে, সে কারণে কিছু কন্টেন্ট প্রতিদিনই দিতে হয়। কাজটি অনেকটা একঘেয়ে হলেও, বাস্তবতা হলো সহজেই প্রতিদিন কিছু পাঠক পাওয়া যায় এসব কন্টেন্ট দিয়ে। এই তাড়া থেকেই প্রতিদিন নামাজের সময়সূচি দেওয়া হয়। দেওয়া হয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস। করোনাকালে দেওয়া হতো প্রতিদিনের করোনা আপডেট আবার রমজানে দেওয়া হয় ইফতার-সাহরির সময়সূচি। একই কারণে হালে দেওয়া হচ্ছে বায়ুদূষণের প্রতিদিনের আপডেট।

জাগো নিউজে প্রতিদিনকার এ কাজের পর্যালোচনায় দিন দুয়েক আগে আমাদের এক সিনিয়র সহকর্মী জানালেন, আমাদের সহকর্মীরা টানা তিন দিন একই রকম শিরোনাম করেছেন। প্রতিদিনই লেখা হয়েছে ‘ঢাকার বায়ু আজ খুবই অস্বাস্থ্যকর’। একেতো প্রতিদিনের একঘেয়ে কন্টেন্ট, তার ওপর যদি শিরোনামও প্রতিদিন এক হতে থাকে, তাহলে সেটি হয়ে পড়ে চূড়ান্ত রকমের দৃষ্টিকটু।

এ পরিস্থিতির পর্যালোচনায় দেখা গেলো, ২১ ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত, টানা ১২ দিন, ঢাকা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহর বা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ুর শহর। তার আগে কয়েক দিন বৃষ্টির কারণে বায়ু মানের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তবে তারও আগে ঢাকা ছিল একই রকমের অস্বাস্থ্যকর। চলমান এ পরিস্থিতির মধ্যে ২২ ডিসেম্বর (শুক্রবার) দূষণ ছাড়িয়ে যায় সব মাত্রা।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-একিউআই) ২২ ডিসেম্বর ঢাকার স্কোর ছিল ৪৪০। আইকিউএয়ার বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক সূচকে একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয়।

আইকিউএয়ার তাদের সূচকের ৪৪০ স্কোরের ব্যাখ্যায় বলেছে, ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে বলা হবে ‘দুর্যোগপূর্ণ’। বায়ু মানের এ স্কোর ছিল চলতি বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ। তারা আরও বলেছে, ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। ২২ ডিসেম্বর বাতাসে যতটা এ বস্তুকণা ছিল, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ডের চেয়ে ৫৫ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যেমন প্রত্যাশিত, আমাদের শহরের বায়ুর মান তারচেয়ে ৫৫ গুণেরও বেশি খারাপ। বাতাসের এ অবস্থা সবার জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও বাতাসের অবস্থা এতটা খারাপ কেন? সমাধান কোন পথে? এর সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো দেয় না। আমাদের কর্তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেন না। এরচেয়ে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন অন্য কারো উপর দায় চাপাতে।

শুক্রবারও একই কাজ করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মোতালিব। গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বায়ুদূষণে উপমহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের একটা ভূমিকা আছে। এখন এই শীতকালে এর অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। এর বাইরে যানবাহন ও কলকারখানার ধোঁয়া আছে। যানবাহন ও ইটের ভাটার দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে। (প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৩)

দায় এড়ানোর পথটি সহজ কিন্তু এর পরিণতি ভয়াবহ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেছেন, ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের পুরাতন গাড়ি ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের প্রধান কারণ। গাড়ি যত পুরাতন হবে, দূষণও তত বেশি হবে। (ডেইলি স্টার, ১৪ অক্টোবর ২০২৩)

প্রশ্ন হলো, ঢাকা শহরে কতগুলো গাড়ি এমন ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন নিয়ে চলছে? এর একটি ধারণা পাওয়া যায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর পরিসংখ্যান থেকে। বিআরটিএ বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকা শহরে নিবন্ধিত এমন অন্তত ৫ লাখ ৬৮ হাজার গাড়ি ছিল যেগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না। অর্থাৎ এ গাড়িগুলো আসলে চলাচলের উপযোগী কি না তা পরীক্ষা করে দেখাই হয়নি। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, আসলে একটি গাড়ি কতটা দূষণ ছড়াচ্ছে তা পরীক্ষা করে দেখার সক্ষমতাই বিআরটিএ’র নেই। বিআরটিএ’র যে যানবাহন নিরীক্ষা কেন্দ্র সেখানে প্রায় সব গাড়িই দেখা হয় ম্যানুয়ালি। কোনো মানুষের পক্ষে যে দূষণের মাত্রা বোঝা সম্ভব নয়, এটি বলাই বাহুল্য।

আমাদের বায়ূদূণের আরেক কারণ হলো যত্রতত্র, যার যেভাবে ইচ্ছা নির্মাণ কর্ম চালিয়ে যাওয়া। রাস্তার পাশেই দেখা যায় বালু ফেলে রাখা হয়েছে। ইট ভাঙা হচ্ছে। সিমেন্ট নামানো-ওঠানো হচ্ছে গাড়ি থেকে। সেগুলো মিক্স করা হচ্ছে। কংক্রিট বানানো হচ্ছে। তাতে আস্তরণ দেওয়া হচ্ছে। নির্মাণ যন্ত্রের ঘর্ষণ, যানবাহনের চাকা আর মানুষের পা হয়ে সিমেন্ট-বালু মিশে যাচ্ছে বাতাসে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কয়েকদিন এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে গণমাধ্যমে অব্যাহত লেখালেখির পর। এরপর গণমাধ্যমও অন্য ইস্যুতে ফোকাস করেছে, সেসব ব্যবস্থাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

দেশজুড়েই শুধু নয়, বিশ্বজুড়েই দূষণের অন্যতম কারিগর কারখানার ধোঁয়া। সে ধোঁয়ায় বাড়তি জ্বালানি জোগাচ্ছে আমাদের ইটভাটাগুলো। পৃথিবীর বহু দেশ থেকেই ইটভাটা বিদায় হলেও আমরা সেসব চালিয়ে যাচ্ছি শিল্প হিসেবেই। ইটভাটার দূষণ এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, এর বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে।

১৩ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সাত দিনের মধ্যে সব অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধের ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও পরিবেশ সচিবকে নির্দেশ দেন। মাঠ পর্যায়ে এসব ব্যবস্থা কার্যকর করার দায়িত্ব পড়ে জেলা প্রশাসকদের ওপর। এরপর বহু সূর্য উদিত হয়ে আবার অস্ত যায়। বহু পূর্ণিমা, অমাবস্যা পেরিয়ে যায়। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় বহু জল গড়ায়। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয় না এসবের বিরুদ্ধে।

ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী ৫ জেলায় ৩১৯টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে বলে হাইকোর্টকে ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জানান স্বয়ং পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল হামিদ। এসব অবৈধ ভাটা বন্ধে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। দূষণ রোধে এমন মোট ৯ দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। তবে আমাদের কর্তারা সেসব থোড়াই কেয়ার করেন।

বাধ্য হয়ে আদালত পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের অনেকের স্ত্রী-সন্তান বিদেশে থাকেন, আপনাদের তো সমস্যা নাই। আমাদের এখানে থাকতে হয়। এই দূষণে আমাদের তো সমস্যা হয়। ( জাগো নিউজ, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।

সমস্যা কি আমাদের আসলেই হয়। হলে সেটি কতটা? এর জবাব মেলে চেস্ট অ্যান্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মির্জা মোহাম্মদ হিরনের এক বক্তব্যে। ডা. মির্জা মোহাম্মদ হিরন জানান, দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রোগী ফুসফুসের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। বায়ু দূষণের কারণে প্রথমে আক্রান্ত হয় ফুসফুস ও শ্বাসনালী।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দেশে বর্তমানে অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। (জাগো নিউজ, ২ মে ২০২৩)

শুরুর কথায় ফিরে যাই।

এসব পরিসখংখ্যান দেখতে দেখতে ছোটকালে শোনা এক গল্প মনে পড়ল। এক নতুন বিয়ে করা জামাই গেছে শ্বশুরবাড়ি, তাদের কোনো এক শোকের দিনে সমবেদনা জানাতে। সেখানে গিয়ে দেখা গেলো যে, তিনি হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার শাশুড়ি জানতে চাইলেন, বাবা তুমি হাসো কেন? জবাবে জামাই বললো, আম্মা আমার মুখই এরকম।

প্রতিদিন একই রকম শিরোনাম কেন, এর ব্যাখ্যায় সিনিয়র সহকর্মীকে জানালাম, ভাই আমাদের বাতাসই এরকম। আমরা বাস করি আগ্নেয়গিরির ছাই-ভস্মের মাঝখানে। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেই। অ্যাজমা-শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হই। টাকা থাকলে এসব রোগের ওষুধ কিনে খাই। না থাকলে রোগে ভুগতে থাকি। আর গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে প্রতিদিন লিখে যাই, ঢাকার বায়ু আজও খুবই অস্বাস্থ্যকর!

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

আমরা বাস করি আগ্নেয়গিরির ছাই-ভস্মের মাঝখানে। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেই। অ্যাজমা-শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হই। টাকা থাকলে এসব রোগের ওষুধ কিনে খাই। না থাকলে রোগে ভুগতে থাকি। আর গণমাধ্যমের কর্মী হিসেবে প্রতিদিন লিখে যাই, ঢাকার বায়ু আজও খুবই অস্বাস্থ্যকর!

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।