জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’
জনবল সংকটে বঞ্চিত হচ্ছেন অর্ধেক সেবাপ্রত্যাশী
নাগরিকের অধিকার নিশ্চিতে সাত বছরের বেশি সময় ধরে সেবা দিচ্ছে জাতীয় হেল্পলাইন ‘৩৩৩’। নাগরিক সেবা-সংক্রান্ত তথ্য ও অনলাইন সেবা, সেবা সংক্রান্ত অভিযোগ, প্রতিকার এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা প্রতিকারে ভূমিকা রাখছে এ হেল্পলাইন।
সম্প্রতি অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রকল্পের অধীন এ টোল ফ্রি হেল্পলাইনটি। অন্তর্বর্তী সরকার খরচ কমাতে লোকবল প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনবল সংকটে এখন প্রায় অর্ধেক সেবাপ্রত্যাশী বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা তথ্য ও সেবার জন্য হেল্পলাইনে ফোন করেও সাড়া পাচ্ছেন না। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও তারা হেল্পলাইনের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না- জানাতে পারছেন না অভিযোগ, নিতে পারছেন না তথ্য বা সেবা।
এটুআইয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, খরচ কমাতে ৩৩৩-এর কল সেন্টারের জনবল ৬০ থেকে কমিয়ে ২৬ জনে নামানো হয়েছে। তাই গ্রাহকদের কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ১০ হাজার কলের মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজারের মতো কল রেসপন্স (সাড়া) করছেন কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিরা। যথাযথ সেবা নিশ্চিতে জনবল আগের জায়গায় নেওয়া, এমনকি আরও বাড়ানো দরকার।
প্রতিশ্রুত সরকারি সেবা, সেবাদান পদ্ধতি, যোগাযোগ নম্বর ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য প্রাপ্তি এবং সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকারে ৩৩৩ ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নাগরিকদের জন্য কল্যাণকর এ ভূমিকা ফিরিয়ে আনতে সরকারের এ হেল্পলাইনের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল ‘সরকারি তথ্য ও সেবা সব সময়’ স্লোগান নিয়ে চালু হয়েছিল ৩৩৩। সেই হিসেবে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এর সাত বছর পূর্ণ হয়েছে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে ২০১৭ সালের মার্চে দেশের ২৪টি জেলায় ৩৩৩-এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু হয়। শুরুতে সরকারি তথ্য সহায়তাভিত্তিক কল সেন্টার হিসেবেই এটি চলছিল। পরে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা-সংক্রান্ত সেবা এতে যুক্ত হয়।
- আরও পড়ুন
সরকারি সেবা নিয়ে অভিযোগ-দুর্নীতির তথ্য জানাতে নতুন ব্যবস্থা
ঈদের ছুটিতে ৯৯৯-এ ভুয়া কলই ছিল লাখের বেশি
৯৯৯-এ বেড়েছে শিশুদের কল, পড়ার চাপ দিলেও করে ফোন
বর্তমানে সরকারি দপ্তর, যে কোনো ধরনের সেবা ও সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য, নিত্যপণ্যের খুচরা বাজারদর, দাম বেশি নিলে অভিযোগ জানানো এবং টিসিবির পণ্য বিক্রি সম্পর্কে তথ্য, সামাজিক সমস্যা ও যে কোনো সরকারি সেবার বিষয়ে অভিযোগ জানানো, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি সংক্রান্ত সহায়তা বা অনলাইন জিডি সংক্রান্ত তথ্য ও সহযোগিতা, পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ এবং দূষণের বিষয়ে অভিযোগ দাখিল বা তথ্য, ডিজিটাল কমার্স ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন ও ডিবিআইডির সেবা, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ও ডাক্তারের পরামর্শ, ভূমি সংক্রান্ত তথ্য ও সেবা, সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত সহায়তা, নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ক সহায়তা দেওয়া হয় ৩৩৩ হেল্পলাইনের মাধ্যমে।
এটুআইয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘৩৩৩ হচ্ছে একটা জাতীয় কল সেন্টার, এটা সরকারের সব দপ্তরের তথ্য সেবা অভিযোগ নিয়ে কাজ করে। তথ্য ও সেবা দেওয়াই হচ্ছে মূল কাজ। ছয় মাস ধরে আমরা এ কল সেন্টারটি ২৬ জন দিয়ে চালাচ্ছি। এর আগে এ সংখ্যা ছিল ৬০ জন। নতুন সরকার আসার পর আমাদের বাজেট কমে গেছে, তারা আমাদের ২৬ জন রাখার অনুমতি দিয়েছে।’
৩৩৩ নম্বরে এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কল আসে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে আমরা একটা ভয়েস বট বসিয়েছি, সে প্রতিদিন পাঁচ হাজার কলের সাড়া দেয়। সে নাগরিককে ৫-৬টি সেবা নিয়ে তথ্য দেয়। এনআইডি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ভূমিসহ কয়েকটি দপ্তর আলাদা করে কল সেন্টার করলেও ৩৩৩ এ এসব সেবার বিষয়ে ফোন আসে।’
কল সেন্টারে যে ২৬ জন প্রতিনিধি রয়েছেন তাদের কাছে ১০ হাজারের মতো কল আসে। এর মধ্যে তারা গড়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো কল রেসপন্স করতে পারছেন। বাকি কলগুলো পরিত্যক্ত হচ্ছে।- এটুআইয়ের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (৩৩৩) দিদার-ই-কিবরিয়া
‘আমরা তাদের সেবা দেই, কল সেন্টারে যুক্ত করে দেই। প্রতিদিন এখান থেকে এক হাজার কল ভূমির কল সেন্টারে চলে যায়। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হেল্পলাইন ১০৯-তেও যায় প্রায় এক হাজার কল। সাইবার সিকিউরিটির কল সেন্টারের ৪-৫শ কল যায় প্রতিদিন। সব মিলিয়ে আমরা ১৫ হাজারের মতো কল রেসপন্স করতে পারি।’
এটুআইয়ের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট (৩৩৩) দিদার-ই-কিবরিয়া বলেন, ‘কল সেন্টারে যে ২৬ জন প্রতিনিধি রয়েছেন তাদের কাছে ১০ হাজারের মতো কল আসে। এর মধ্যে তারা গড়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো কল রেসপন্স করতে পারছেন। বাকি কলগুলো পরিত্যক্ত হচ্ছে।’
‘আমরা একটি কল ওয়েটিংয়ের সর্বোচ্চ সময় দিয়েছি পাঁচ মিনিটি। এ সময়ের মধ্যে প্রতিনিধি ফোন না ধরলে ফোনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে যাবে। কল সেন্টারের লোকবল ৬০ জন থেকে কমে ২৬ জন হওয়ায় অপেক্ষাজনিত কল পরিত্যক্ত হওয়ার হার অনেক বেড়েছে। গত তিন মাসের হিসাব অনুযায়ী অপেক্ষাজনিত কারণে ৪০ শতাংশ কল পরিত্যক্ত হয়েছে। অর্থাৎ নাগরিকরা কল করে পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পর আমাদের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে পারছে না। যখন জনবল ৬০ জন ছিল, তখন কল পরিত্যক্ত হতো পাঁচ শতাংশ।’
ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট দিদার বলেন, ‘হেল্পলাইনে আসা কলের একটা অংশ ব্লাইন্ড। তারা এসে কোনো বাটনে চাপে না, ৩৩৩ এ কল দিয়ে কিছু শুনে বের হয়ে যায়। ঢুকলো কিন্তু সার্ভিস নিলো না। লোকবল বাড়ানো খুবই জরুরি। তাহলে সেবাটা আমরা যথাযথভাবে দিতে পারবো। কল করে যদি অভিযোগ জানাতে বা তথ্য না পায় তাহলে আর মানুষ কল করবে না। এটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।’
কল সেন্টারের জনবল আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির আওতায় কলসেন্টারের জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ গত বছরের ২৫ জুলাই শেষ হয়। চুক্তির মেয়াদ শেষে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় এবং প্রকল্পের সফটওয়্যার খাতে বাজেট সংকটের কারণে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মহোদয়ের অনুমোদনে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে ২৬ জন এজেন্ট দিয়ে ছয় মাস মেয়াদি একটি নতুন চুক্তি সম্পাদন করা হয়। পরবর্তীতে আন্তঃঅঙ্গ সমন্বয়ের মাধ্যমে সফটওয়্যার খাতে বাজেট বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এটুআই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. রশিদুল মান্নাফ কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা (জনবল সংকট) নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
নানা অর্জনে এগিয়েছে ৩৩৩
এটুআই সংশ্লিষ্টরা জানান, এ পর্যন্ত কল সেন্টারে মোট ১০ কোটি ৯ লাখ বেশি কল গ্রহণ করা হয়েছে। ৩৩ লাখের বেশি নারী ও ৭ লাখ ২২ হাজারের বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কল করেছেন।
করোনা মহামারি ও বন্যার সময়ে ৩৩৩-এর বড় ভূমিকা দেখা গেছে। ২০২০-২১ সালে ১৬ লাখের বেশি মানুষকে এ হেল্পলাইনের মাধ্যমে খাদ্য ও ওষুধ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। গত বছর বন্যার সময় পাঁচ হাজারের বেশি পরিবারকে জরুরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ‘উবার মডেল’র মতো স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে তথ্য পাঠানো ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এ সহায়তা পৌঁছানো হয়েছে।
বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত ১২ হাজার ৮৭৭টির বেশি কল এসেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ হাজার ৫৮২টির বেশি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।
আরএমএম/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম