সবকিছু নিয়ে সরকার জনগণের পাশে আছে : প্রধানমন্ত্রী
করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সংকটে সবকিছু নিয়ে সরকার জনগণের পাশে আছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
রোববার (২৯ মার্চ) বিকেলে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে এক অনির্ধারিত অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় এ কথা জানান।
অনুষ্ঠানে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে সহায়তা করতে সশস্ত্র বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের সমপরিমাণ বেতনের অর্থ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেয়া হয়। একই সঙ্গে দেশের খ্যাতনামা কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থ সহায়তা দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার মুখ্য সচিবের কাছে অনুদানের চেক হস্তান্তর করেন।
অতীতের বিভিন্ন মহামারির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শত বছর পরপর এমন একটা মহামারি পৃথিবীতে আসে। অতীতে যেহেতু প্রযুক্তির ব্যবহার এতো ছিল না, কাজেই কোন দেশে, কোন অঞ্চলে, কোথায় কী ধরনের ঘটনা ঘটেছে তা জানার সুযোগ ছিল না। বর্তমানে বিশ্বটা গ্লোবাল ভিলেজ হয়ে গেছে, কোথাও একটা ঘটনা ঘটলে আমরা গণমাধ্যমের কারণে সব ঘটনাই জানতে পারি।
‘চীনের উহানে যখনই এই ঘটনা ঘটেছিল তখনই আমরা সেখান থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে এনেছি। তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল। আমরা শুধু তাদের কোয়ারেন্টাইনে রেখেই ক্ষ্যান্ত হইনি, সাথে সাথে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন করা, এটা প্রতিরোধে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, তা একটার পর একটা নিয়েছি। বিশেষ করে আমরা দেশের মানুষকে সচেতন রাখতে চেষ্টা করছি। পাশাপাশি আমাদের উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয়, মানুষ যেন আর্থিকভাবে কষ্টে না পড়ে সেই দিকটাও সচেতন থেকেছি। প্রতিটি পদক্ষেপ অন্তত পরিকল্পিতভাবেভাবে, যখন যেটা প্রয়োজন হয়েছে সেটাই নিয়েছি। বলতে গেলে জানুয়ারি মাস থেকেই আমাদের পদক্ষেপগুলো চলছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা পর্যায় যখন আসলো তখন আমরা সবাইকে ছুটি দিয়েছি। কিন্তু ছুটি মানে এই না সবাই কাজ ছেড়ে ঘরে বসে থাকবে। যারা কাজ করতে পারবে, ঘরে বসেই কাজ করবে। কিন্তু মানুষের সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ এটা মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারা দেশে কিছু বিদেশি চলে এলো, প্রবাসীরা আসার ফলে, এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিল। কোনো কোনো জায়গায় দেখা দিল, তা আমরা সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ নিয়েছি। এর বিস্তার ঠেকাতে আমরা সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছি এবং সেটা অব্যাহত রাখছি। সবাইকে বলব, ঘর থেকে বের হয়ে ঘুরে বেড়াবেন, এটা তো হয় না।
প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের দেয়া অনুদান সরাসরি গ্রহণ করতে না পারায় প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমি ভিডিও কনফারেন্সে আছি, আমার পক্ষ থেকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি তা গ্রহণ করছেন। এটা আমার কাছে খারাপও লাগছে, কারণ আপনাদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করতে পারলাম না। কারণ এটার আরেকটা কারণ হচ্ছে আমি নিজেই যদি না মানি তাহলে অপরকে মানতে বলব কীভাবে? যেহেতু সবাইকে বলছি দূরত্ব বজায় রাখতে, ঘরে থাকতে।
সরকারপ্রধান বলেন, আমরা এই সময়টাও পার করতে পারব। আমাদের শিল্প কারখানার মালিক-শ্রমিকরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে কাজ চালাতে পারবেন। কিন্তু সেখানে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ যারা কাজ করবেন, তাদের সুরক্ষিত রেখেই চালাতে হবে।
‘সবার কাছে আহ্বান, আপনারা মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। সৃষ্টিকর্তাই পারেন। কারণ আমরা দেখি যে শত বছর পরে এই ধরনের মহামারি আসে। কাজেই একমাত্র নিজেরা সুরক্ষিত থাকা, আশেপাশে যারা অছেন তাদের সুরক্ষিত রাখা এবং সেই সাথে সাথে মানুষের ক্ষতি যত কম হয়, ক্ষতি যেন একেবারেই না হয় সেটার জন্য ব্যবস্থা নেয়া, তা আমাদের নিতে হবে।’
তিনি বলেন, খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর, সাধারণ নিম্নবিত্ত, অনেকেই আছেন, তাদের ব্যবস্থা এমন না যে তারা অনেক কিছু জমিয়ে রাখতে পারবেন, দিনের পর দিন চলতে পারবেন। কর্মসংস্থান থাকার ফলে তারা খেয়ে-পরে চলতে পারলেও কিন্তু বর্তমানে এই অবস্থায় তারা সত্যিই খুব কষ্টে আছেন। ইতোমধ্যে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে খাদ্যশস্য আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। তা পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে। পাশাপাশি ভিজিএফসহ যেসব আর্থিক সহায়তা আমরা দিয়ে থাকি তা অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সড়ক ও নৌপরিবহন যেহেতু বন্ধ, তাই তাদের শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছেন না। তারা ঘরে বসা। খাবার কিনে মজুত করার মতো অবস্থা তাদের নেই। এই শ্রেণির মানুষের কথাও আমাদের চিন্তা করতে হবে। তাদের তালিকা করে, আমাদের খাদ্যশস্য যা যা প্রয়োজন তা পৌঁছে দিতে হবে।
‘করোনাভাইরাসের আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার ও নার্সদেরও সুরক্ষিত করা দরকার। সেই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। এরই মধ্যে আমরা সরকারিভাবে কাজ করছি। আবার কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সহযোগিতা করছেন, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিচ্ছেন। হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট সকলকেও সুরক্ষার প্রয়োজনীয় পোশাক দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেয়া একান্তভাবে জরুরি। প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত খাদ্য সামগ্রী থেকে শুরু করে যা যা প্রয়োজন তা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। আমাদের তালিকা তৈরি করা আছে, আরও তালিকা করা দরকার। কারণ মানুষকে ঘরে আটকে রাখলেই হবে না, তাদের খাদ্য ও জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা আমাদের করে দিতে হবে।
এই সংকটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একদিনের বেতন দেয়ায় এবং বিত্তবানরাও একইভাবে এগিয়ে আসায় ধন্যবাদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা বিজয়ী জাতি যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো সাহস ও শক্তি আমাদের আছে, আমি বিশ্বাস করি। এই অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য সকলকে প্রস্তুত হতে হবে। যাতে করে দেশের প্রতিটি জনগণকে আমরা সুরক্ষিত রাখতে পারি।
‘অনেক দেশ আমাদের কাছে সহযোগিতা চাচ্ছে। আমরা সেই সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কৃষকদের ফসল ফলাতে হবে। পাশাপাশি অনেকই গ্রামে চলে গেছেন, তাদের যার যেখানে যতটুকু জমি আছি, এতটুকু জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। যে যা পারেন ফসল ফলাবেন। কারণ বিশ্বব্যাপী যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ব্যাপকভাবে খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে। আমাদের সুবিধা হলো, বাংলাদেশের মাটি উর্বর, মানুষ কর্মঠ। মাটি ও মানুষ মিলে যদি পরিশ্রম করতে পারি তাহলে আমরা নিজেদের খাদ্যের পাশাপাশি অন্যকেও সহযোগিতা করতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো আমরা খোলা রাখার ব্যবস্থা করেছি। যাতে ওষুধ উৎপাদনটা থাকে। পাশাপাশি পিপিই যা দরকার তা উৎপাদন শুরু হয়েছে। আরও উৎপাদন করা দরকার। আমাদের কাছ থেকে যারা সহযোগিতা চেয়েছে তাদেরও সহযোগিতা করতে পারব। তার সক্ষমতা আমাদের আছে। মানবিক কারণেই আমরা করব। নিজেদের পাশাপাশি অন্য দেশেরও যদি প্রয়োজন হয়, আমরা সেদিকে দৃষ্টি দেব।
‘বাঙালি কখনো হারেনি। আমরা হারবো না। এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে সবাইকে চলতে হবে। শুধু নিজেকে একটু সুরক্ষিত রাখতে হবে, অপরকেও সুরক্ষিত রাখতে হবে।’
এইউএ/এইচএ/এমকেএইচ/এমএস