রাষ্ট্র কিছুই হারায়নি, শুধু আমরা হারিয়েছি একজন মানবিক স্যারকে
সিলেটে একনামে পরিচিত ছিলেন গরীবের ডাক্তার হিসেবে। কোনো দরিদ্র, অসহায় মানুষ তার কাছ থেকে ফিরে আসতেন না। অসহায় মানুষ দেখলে চিকিৎসা দিয়ে নিতেন না কোনো অর্থ। বরং, উল্টো নিজের পকেট থেকে সহায়তা দিতেন।
এমন একজন মানবদরদী ডাক্তারকেই কি না অকালেই রাষ্ট্রের অবহেলার শিকার হয়ে পরপারে চলে যেতে হলো! করোনাভাইরাসের সঙ্গে সামনে থেকে যারা লড়াই করবেন, সেই ডাক্তারদেরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি রাষ্ট্র। বরং, আক্রান্ত হওয়ার পরও রাষ্ট্রের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
রাষ্ট্রের কাছ থেকে যে অবহেলার স্বীকার হয়েছেন ডাক্তার মঈন উদ্দিন, সেটা উঠে এসেছে তার এক ছাত্র, সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিক্যাল কলেজের এক আবাসিক ডাক্তার ফয়জুর রহমানের স্ট্যটাস থেকে। মেডিক্যাল পাশ করার পর ডাক্তার মঈন উদ্দিনের অধীনেই ইন্টার্নি করেছিলেন ডাক্তার ফয়জুর রহমান।
আজ সকালে ঢাকার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে করোনার কাছে হেরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেলের আবাসিক ডাক্তার ফয়জুর রহমান স্ট্যাটাসটি দেন। যা রীতিমত ভাইরাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সহস্র্রাধিক শেয়ারও হয়েছে।
জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো ডাক্তার মঈন উদ্দিনকে নিয়ে লেখা তার ছাত্র ডাক্তার ফয়জুর রহমানের সেই ফেসবুক স্ট্যাটাসটি-
‘স্মৃতি খুব কষ্টের, মঈন স্যারের ইন্টার্ন ছিলাম, ইন্টার্নশিপ শেষ হলে স্যার যে হাসপাতালে চেম্বার করতেন ঐ হাসপাতালে ডিউটি ডক্টর ছিলাম। একদিন রাত ২টায় এক রোগী ভর্তি হলো প্রচন্ড খিঁচুনি নিয়ে। রিসিভ করেই স্যারকে ফোন দিলাম, স্যার ফোন ধরেই বললেন, ‘ফজলুর আমিতো প্রায় বাসায় চলে আসছি,ম্যানেজ করতে পারবা না? আমি আমতা আমতা করে বললাম, স্যার ডায়াজিপাম দিয়েছি,রোগীটা খারাপ, এখনও খিঁচুনি হচ্ছে। দেখে গেলে ভালো হত স্যার। স্যার ওভার ফোনে কি কি করতে হবে কিছুক্ষণ বললেন, তারপর হঠাৎ বলে বসলেন ঠিক আছে ফজলুর তুমি ফোন রাখ, আমি আসছি।
দশ মিনিটের ভিতরে স্যার চলে আসলেন। এসেই বললেন, যেহেতু ডায়াজিপাম দিয়ে ফেলেছো- এখন আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নেক্সট স্টেপে যেতে হবে, স্যার ১৫ মিনিট রোগীর পাশে অপেক্ষা করলেন তারপর বললেন, এখন ফসফেন লোডিং শুরু করো।
রোগীটা গরীব ছিল স্যার নিজে থেকে যাবতীয় পরীক্ষার ৫০% কমানোর জন্য স্লিপে সাইন করলেন। পরে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন শোন, ‘পার্টি গরীব, আমার ভিজিট তোলার দরকার নাই, ফ্রী করে দিও। আর সকালে পেশেন্ট স্টেবল হলে ওসমানীতে রেফার্ড করে দিও, আজ আমার ইউনিটে ভর্তি আছে, এখানে এরা হসপিটালের বিল দিতে পারবে না।’
এই ছিলেন আমাদের মঈন স্যার।
আসুন মেডিসিনে এফসিপিএস ও কার্ডিওলজিতে এমডি করা এই ডাক্তারকে আমাদের রাষ্ট্র কি দিয়েছে দেখি, করোনাতে আক্রান্ত হয়ে স্যার যখন শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন সিলেটে, এক সময় ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্যে স্যার এই রাষ্ট্রের কাছে একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, রাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে স্যার এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না, আমার সদাহাস্যেজ্বল স্যার তারপর অনুনয় করে রাষ্ট্রের কাছে একটি আইসিউ অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, রাষ্ট্র কর্ণপাতই করেনি।
অবশেষে স্যার নিজ উদ্যোগে একটি সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সে কুর্মিটোলা হাসপাতালে রেফার হলেন এবং আজ সকালে রাষ্ট্রকে সকল দায়ভার থেকে মুক্তি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
নাহ, রাষ্ট্র কিছুই হারায়নি শুধু আমরা চিকিৎসকরা হারিয়েছি এফসিপিএস ও এমডি কমপ্লিট করা মানবিক একজন স্যারকে।’
আইএইচএস/