২০ মাসের শিশুকে রেখে করোনা আইসিইউতে ডিউটি করা এক নার্সের গল্প
‘২০ মাস বয়সী দুধের শিশুসন্তান মেয়েটিসহ দুই সন্তানকে স্বামীর কাছে রেখে প্রথমদিন রাতে যখন হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ডিউটিতে যাচ্ছিলাম, তখন অজানা আশঙ্কা ও ভয়ে বুক ধুকধুক করছিল। বারবার চোখের সামনে সন্তানদের চেহারা ভেসে আসছিল। আইসিইউতে মুমূর্ষু রোগীর সেবা করতে গিয়ে আমিও আক্রান্ত হলে, আমার কিছু হয়ে গেলে ওদের কী হবে! তবুও কর্তব্য পালনে ব্রত হয়ে সামনে এগিয়ে যাই। আইসিইউতে ডিউটি করার জন্য বিশেষ ধরনের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পা থেকে মাথা পর্যন্ত) এন-৯৫ মাস্ক ও চোখে গ্লাস পরার পর কোনোভাবেই শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছিলাম না।’
‘২০০১ সাল থেকে অ্যাজমা রোগী হওয়ায় এমনিতেই শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা ছিল। তাই পিপিই ও মাস্ক পরে আইসিইউতে প্রবেশ করি। ভেতরে প্রবেশ করে ফুল স্পিডে এয়ারকন্ডিশন চালিয়ে দেই। তবুও পিপিই ও এন-৯৫মাস্ক পরে ডিউডিতে অভ্যস্ত না হওয়ায় গরমে লাগছিল। তিন ঘণ্টা ডিউটির কথা থাকলেও প্রথমদিন দুই ঘণ্টা ডিউটি করে বাইরে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হই। তবে পরের দিন থেকে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে যাই।’
‘আইসিইউতে ডিউটি করার সময় খুব কাছে থেকে করোনা রোগীদের প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ছটফট করতে দেখেছি। চোখের সামনে মৃত্যুও দেখেছি। সাত দিন ডিউটি শেষে আইসোলেশনে এসেছি। জানি না আমি নিজেই করোনা আক্রান্ত কি-না। এখন দিন গুনছি কবে ১৪ দিন শেষে সন্তানদের কাছে যেতে পারব।’
রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ডিউটি করা সাহসী নার্স সাবিনা আক্তার (ছদ্মনাম) এভাবেই করোনা রোগীদের আইসিইউতে ডিউটি করার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলেন।
শনিবার সকালে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘গত সাত দিনে তিনি আইসিইউতে তিনজন করোনা রোগীকে খুব কাছে থেকে (ক্লোজ কন্টাক্ট) চিকিৎসা দিয়েছেন। তিনজনের একজনের মৃত্যু হয়। যে একজনের মৃত্যু হয় তিনি প্রথম দুদিন আইসিইউতে থাকলেও তার ভেন্টিলেটর সাপোর্ট প্রয়োজন হয়নি। ওই সময় উনার স্ত্রী সহায়তা করেছেন। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে ভেন্টিলেটর মেশিনে দেয়ার পর থেকে তাদের সার্বক্ষণিক রোগীর পাশে থেকে প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর নল দিয়ে খাওয়ানো, টিউবে সাকসেশন দেয়া, প্রেসার কমে গেলে প্রেসার বৃদ্ধির জন্য যে ওষুধগুলো দেয়া হয় সেগুলো সিরিঞ্জ পাম্প নামক যন্ত্র দিয়ে দেয়া, সে যন্ত্র ঠিকমতো চলছে কি-না, ওষুধ শেষ কি-না ইত্যাদি নিবিড়ভাবে মনিটর করতে হয়। এ সময় কর্তব্যরত নার্সরা তিন ঘণ্টা করে ডিউটি ভাগ করে সার্বক্ষণিক পাশে ছিলেন। এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা তাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন।’
ওই নার্স জানান, করোনা আক্রান্ত জটিল রোগীদের প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়। তবে তিনি যে হাসপাতালে ডিউটি করেছেন সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের সরবরাহ থাকায় একজন রোগীকে ১৫ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা থাকায় রোগীদের সেবাদান সম্ভব হচ্ছে।
আইসিইউতে চিকিৎসাধীন একজন পুরুষ রোগীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাতের বেলা রোগীকে আইসিইউতে আনা হয়। রোগীর চেতনা ছিল। পরদিন দুপুরে আইসিইউর ভেতর তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হলে তিনি দৌড়ে বেরিয়ে নার্সেস ডিউটি স্টেশনে এসে একটি বেডে শুয়ে ছটফট করতে থাকেন। ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের করোনা পজিটিভ এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’
খবর পেয়ে তার স্ত্রী দৌড়ে আসেন। স্ত্রীকে পাশে পেয়ে তিনি কিছুটা সুস্থতা বোধ করছেন বলে জানালে চিকিৎসকরা তার স্ত্রীকে কিছুক্ষণ পাশে থাকার অনুমতি দেন।
সাতদিন ডিউটি শেষ করে ওই নার্স এখন ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। কোয়ারেন্টাইন শেষ না হলে তিনি স্বামী-সন্তানদের কাছে যেতে পারছেন না।
এখনও হাসপাতালে বসে স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। ২০ মাস বয়সী সন্তানটি যখন মা বলে ডেকে ওঠে তখন বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কিন্তু এ মুহূর্তে কাছে গেলেই সংক্রমিত হতে পারে-এ আশঙ্কায় বুকে পাথর বেঁধে অপেক্ষা করছেন।
শিশুসন্তানকে ফেলে আইসিইউতে ডিউটি করার জন্য তার মোটেও খারাপ লাগেনি। বরং পেশাদার নার্স হিসেবে মুমূর্ষু রোগীর সেবা করতে পেরে নিজেকে গর্বিত বলে মনে করেন কোয়ারেন্টাইনে থাকা এই সাহসী নার্স।
এমইউ/এসআর/জেআইএম