জনশূন্য চিড়িয়াখানায় উৎফুল্ল প্রাণীরা
নিবিড় পরিচর্যায় সময় পার করছে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানার প্রাণীকুল। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ থাকায় চিড়িয়াখানার ভেতরেও তৈরি হয়েছে বন্য পরিবেশ। চিরচেনা দর্শনার্থীর ভিড়ের বদলে চিড়িয়াখানা এখন প্রাণীকুলের দখলে। তাদের সেবা দিতে চিড়িয়াখানার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ডাক্তাররা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ২০ মার্চ থেকে চিড়িয়াখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই প্রাণীদের দেখভাল করতেই ছুটি মেলেনি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পশু চিকিৎসকদের। তারা নিজ নিজ দায়িত্বে নিয়জিত রয়েছেন। পশু-প্রাণীদের সেবায় চিড়িয়াখানায় ১২ জন কর্মকর্তা, ১৫০ জন কর্মচারী ও পাঁচজন ডাক্তার ২৪ ঘন্টায় চার ধাপে দায়িত্ব পালন করছেন।
দেখা গেছে, দর্শনার্থীদের বিচরণ না থাকায় চিড়িয়াখানায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণীরা নিজেদের মতো থাকতে পারছে, কেউ তাদের বিরক্ত করছে না। সময়মতো সব প্রাণীকুলকে খাবার দেয়া হচ্ছে। সেসব খাবার দলবেধে খেয়ে কেউ বিশ্রাম করছে, কেউ মেতেছে খেলাধূলায়, কেউ আবার নিজের সন্তান নিয়ে ব্যন্ত রয়েছে। যেন বন্যপ্রাণীরা তাদের নিজ আস্তানায় নিজেদের মতো থাকার সুযোগ পেয়েছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ পাওয়ায় প্রাণীদের বাচ্চাগুলো দ্রুত বেড়ে উঠছে। এদিকে নতুন করে প্রজনন হয়েছে জিরাফ, জেব্রা, হরিণ, বানর, ইমু পাখি, বাঘ, হাতিসহ অনেক প্রাণীর। গত দুই মাসে নতুন করে কোনো প্রাণী মারা যায়নি বলেও জানিয়েছেন দায়িত্বরত পশু চিকিৎসকরা।
জানা গেছে, ১৮৬ একর জায়গা ওপর গড়ে ওঠা দেশের সবচেয়ে বড় এই মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসেন হাজারো দর্শনার্থী। চিড়িয়াখানায় রয়েছে মাংসাশী আট প্রজাতির ৩৮টি প্রাণী, ১৯ প্রজাতির বৃহৎ প্রাণী (তৃণভোজী) ২৭১টি, ১৮ প্রজাতির ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ১৯৮টি প্রাণী।
এ ছাড়াও রয়েছে ১০ প্রজাতির সরীসৃপ ৭২টি, ৫৬ প্রজাতির ১ হাজার ১৬২টি পাখি, অ্যাকুরিয়ামে রক্ষিত ১৩৬ প্রজাতির ২ হাজার ৬২৭টি মৎস্য প্রাণী। সব মিলিয়ে রয়েছে ১৩৭টি পশু-পাখির খাঁচা।
সম্প্রতি চিড়িয়াখানায় অনেক প্রাণীর প্রজনন করেছে। গত কয়েক মাস আগে জেব্রা, জিরাফ, ৪০টি ইমু পাখির বাচ্চা, গয়াল, মায়া হরিণ, চিতা হরিণ, ময়ুর, লাভ বার্ড বাচ্চা দিয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রাণীর বাচ্চা বড় হয়ে যাওয়ায় তাদেরকে নতুন সেডে আলাদা করে ছাড়া হয়েছে। নতুন করে বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয়েছে উট, সিংহ, ভাল্লুক, রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বেশ কয়েক প্রজাতির প্রাণী।
চিড়িয়াখানার খাবার দেয়ার কাজে নিয়োজিত কর্মচারীরা বলেন, দীর্ঘদিন চাকরি করলেও চিড়িয়াখানায় এমন পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। কখনো এত দীর্ঘ সময় চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকে না। বরং বন্ধের দিনগুলোতে আরও বেশি দর্শনার্থী হয়ে থাকে।
তারা বলেন, চিড়িয়াখানায় জনমানুষের প্রবেশ না থাকায় প্রাণীরা অনেক শান্তিতে রয়েছে। পেট ভরে খাবার খাচ্ছে আর নিজেদের ইচ্ছামতো সময় পার করছে। কেউ তাদের ও তাদের সন্তানদের বিরক্ত করছে না বলে তারা অনেক অনন্দিত। যেন বন্য প্রাণীকুল বনের মধ্যে রয়েছে। তবে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে কর্মস্থলে পৌঁছাতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান তারা।
জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর মো. নূরুল ইসলাম জানান, টানা বন্ধ থাকায় চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো আগের চাইতে অনেক ভালো রয়েছে। দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ থাকায় বর্তমানে চিড়িয়াখানায় এক ধরনের বন্য পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে খাবার দেয়া হচ্ছে। খাবার খেয়ে নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছে প্রাণীকুল।
তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত অনেক দর্শনার্থী দেখে প্রাণীরা চুপ করে খাঁচার এক কোণে বসে থাকত, চলাফেরাও কম করত। কিন্তু দীর্ঘদিন চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকায় প্রাণীরা খাঁচার সামনে আসছে। সকাল না হতেই ডাকাডাকি করছে। খাওয়াদাওয়াও আগের চেয়ে বেশি করছে। প্রাণীরা আগের মতো আর খাবার নষ্ট করছে না।
কিউরেটর আরও বলেন, চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকলেও নিয়মিত বন্য প্রাণীদের পরিচর্যা করা হচ্ছে। ১২ জন কর্মকর্তা, ১৫০ জন কর্মচারী ও পাঁচজন চিকিৎসক কাজ করছেন। বর্তমানে গরমে বাঘ, সিংহ, ভাল্লুকসহ বড় প্রাণীদের খাচার ভেতরে-বাইরে পানি দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী এসব প্রাণীদের স্যালাইন ও ভিটামিন পানির সঙ্গে খাওনো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এমএইচএম/এমএফ/এমকেএইচ