লকডাউনে মাদক-জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন দেবপ্রিয়
মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে যে লকডাউন চলছে তাতে যুব সমাজের মাদক ও জঙ্গি মতবাদে আকৃষ্ট হওয়ার আশঙ্ক রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
এই যুব সমাজকে মাদক ও জঙ্গিবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারকে দ্রুত সামাজিক পর্যায়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশে যেসব বৈষম্য ও বঞ্চনা আছে তা করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে আরও বেশি গুরুতর আকার নেবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই অর্থনীতিবিদ।
শনিবার 'কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহের তৎপরতার কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সরকারের প্রতি সুপারিশ' শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব আশঙ্কার কথা বলেন।
দেবপ্রিয় বলেন, এই মুহুর্তে লকডাউন বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান বলে এর থেকে ভালো কোসো প্রতিষেধক এই মুহুর্তে নেই। সুতরাং সরকারের যে সমস্ত নির্দেশনা আছে যেমন জমায়েত না হওয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কোয়ারেন্টাইনে থাকা এবং চলাচল না করা এগুলোকে আমাদের অবশ্যই মেলে চলতে হবে।
তিনি বলেন, লকডাউনের ফলে যুব সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যার আশঙ্কা রয়েছে। এর একটি সমস্যা হলো মাদক সেবন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্ক তৈরি হয়েছে। আবার বিভিন্নভাবে জঙ্গি মতবাদে আকৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই মাদক সেবন ও জঙ্গি মতবাদে আকৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দূর করার জন্য এখনই সরকারের পক্ষ থেকে যে সমস্ত বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান সামাজিক পর্যায়ে কাজ করে তাদের সঙ্গে যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করছি।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ অবশ্যই বাংলাদেশের টেকশই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করবে, খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ওপর সব থেকে বেশি অভিঘাত আসবে। যে ধরনের বৈষম্য, বঞ্চনা আছে সেগুলো আরও বেশি গুরতর আকার নেবে বলে আমাদের আশঙ্কা।
দেবপ্রিয় বলেন, সরকার যে নীতি কাঠামো ঘোষণা করেছে এবং যে সমস্ত প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তার মধ্যে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ব্যক্তি খাত, সামাজিক আন্দোলন এবং সরকার বহির্ভূত যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার মতো কোনো কাঠামো আমরা এখনও পাইনি। সরকারের নীতি কাঠামোর মধ্যে এদের সংযুক্ত করার প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
এর জন্য একটি জাতীয় কাঠামো গড়ে তোলা সমীচিন হবে। এর ফলে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ আরও জোরদার হবে। এ জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একটি নির্দেশনা আমরা আশা করছি। সেই নির্দেশনা স্থানীয় মাঠ প্রশাসনের কাছ থেকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে অবশ্যই যেতে হবে। যাতে করে তারা আরও দৃঢ়তর কাজ করতে পারেন- বলেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যে সমস্ত কাজ করা হচ্ছে, তা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। সে ক্ষেত্রে যারা তৃণমূল মানুষকে নিয়ে কাজ করে তাদের ব্যবহার করলে সরকার আরও দ্রুততরভাবে এবং কার্যকর ভাবে এসব মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে।
সরকার যে সমস্ত প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তার সম্পর্কে পিছিয়ে পড়া মানুষের ধারণা নেই- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, পিছিয়ে পড়া মানুষের চেতনা বৃদ্ধিতে আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে পারে। যে সমস্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছায়নি তাদের তালিকা করার ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, সরকার মানুষের কাছে অর্থ পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করতে চাচ্ছে। যাদের কাছে সেলফোন আছে, তাদের কাছে সব সময় এই আর্থিক সঞ্চালনের সক্ষমতা নেই। এ ক্ষেত্রে তৃণমূলে আমাদের যে সহযোগী প্রতিষ্ঠান আছে তারা এই আর্থিক লেনদেনের ডিজিটাল স্বাক্ষরতা ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের একটি নির্দেশনা কামনা করছি।
সরকারের সাহায্য সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না- এমন মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, সরকার প্রচুর মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তারপরও আমরা দেখছি বেশ কিছু মানুষ এই সুবিধার বাইরে রয়ে গেছেন, যাতে অপর্যাপ্ত সাহায্যের একটি বৃত্ত তৈরি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র চাওয়া হচ্ছে। যারা ভাসমান মানুষ আছেন তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। ফলে তারা সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ভাসমান মানুষ যারা ফুটপাতে থাকেন, যারা বস্তিতে থাকেন, যারা আজ এখানে কাল ওখানে থাকেন, তাদের কাছে সাহায্য পৌঁছাচ্ছে না। এটি একটি বড় সমস্যা। এরা শহরে বড় একটি সংখ্যা বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। বেদে, কামার, কুমর, যৌনকর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছে বলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে।
বিশেষ শ্রেণির মানুষের সাহায্যের জন্য সৃষ্টি করা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউডেশনকে এই দুর্যোগের সময় প্রতিবন্ধীদের দেখভালের কোনো কার্যকালাপ করতে আমরা দেখছি না। নারী, শিশু থেকে শুরু করে অন্যান্য সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তারাও কোনো কার্যকলাপের মধ্যে যুক্ত আছে বলে আমরা দেখছি না।
দেবপ্রিয় বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্রমান্বয়ে মানুষ বেকার হচ্ছে। সঞ্চয় হারাচ্ছে। সম্পদ বিক্রি করছে। অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। সরকার যে বিভিন্ন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, তাদের অনেকের ক্ষেত্রে এই প্রণোদনা কাজে আসছে না। ১০ টাকা কেজি দরের চালও তারা পান না। তারা লজ্জায় প্রকাশ্যে সামাজিক সাহায্যের মধ্যে যুক্ত হতে পারেন না। নিম্ন মধ্যবিত্তরা এই মুহুর্তে খুবই কষ্টের মধ্যে রয়েছে।
তিনি বলেন, সমস্ত পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের যে সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল তা ভেঙে গেছে। ফলে মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা খুবই সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। আমাদের প্রস্তাব সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত মাঠ পর্যায়ের কৃষকের কাছ থেকে বিশেষ পরিবহনের ব্যবস্থা করে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। সমস্ত ধরনের নিয়ম-নীতি মেনে সম্ভব হলে সেনাবাহীর মাধ্যমে এসব পণ্য ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বেকারত্ব বাড়ছে, এটি ব্যক্তি খাতের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঋণের মাধ্যমে ব্যক্তি খাতের শ্রমিকদের বেতন দেয়া এই মুহুর্তে কোনো সমাধান বলে মনে হচ্ছে না। কারণ প্রতিষ্ঠান যদি আয় না করতে পারে, তারা শুধুমাত্র ঋণের দায়িত্ব নিতে পারছে না। আমরা দেখছি ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রণোদনা পৌঁছানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, এদের তথ্য উপাত্ত সেইভাবে নেই।
অর্থনীতিতে বেশকিছু অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে এমন মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, যারা স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছেন আমরা তাদের সুরক্ষার কথা বলি। কিন্তু সেই সুরক্ষার কথা আমরা যতটা চিকিৎসকদের জন্য বলি, ততখানি যারা প্যারামেডিকেল আছে, যারা নার্স আছেন তাদের জন্য বলি না। আমরা মনে করি সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সঙ্গে যারা সহযোগী হিসেবে আছেন, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি আরও গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। তা না হলে এখানে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় বলেন, সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তা খুবই প্রয়োজনীয়, তবে এই প্রণোদনা যথেষ্ট বলে আমরা মনে করি না।
এই ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আরও যুক্ত হন কোর এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন শাহিনা এবং সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান।
এমএএস/এনএফ/জেআইএম