মে শেষে করোনা আক্রান্ত এক লাখ, মৃত্যু এক হাজার হতে পারে
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে সারাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন। চলমান পরিস্থিতি কতদিন অব্যাহত থাকবে, আগামী দিনগুলোতে আরও কত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হবে এবং এ রোগে কত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হবে, এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে দিন-রাত ঘুরপাক খাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে করোনা বিস্তারের এক ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণে রোগ তত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সর্বনিম্ন ৫০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ হতে পারে। এই সময়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা হতে পারে ৮০০ থেকে ১ হাজার।
গত ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গৃহীত কার্যক্রম পর্যালোচনা ও পরবর্তী করণীয় বিষয়ে সভার কার্যবিবরণীতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ এই ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণের তথ্য তুলে ধরেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক জানান, করোনাভাইরাসে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এমন খারাপ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সর্বোচ্চ সক্ষমতা অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে এসব সিনারিও মডেলিংয়ে অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনা ও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- লকডাউন, জনসচেতনতা ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চিকিৎসা নির্দেশনা অনুসারে আক্রান্তদের মধ্যে ২০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে সেবার প্রয়োজন পড়ে বলে তিনি জানান।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সম্পর্কিত নিয়মিত অনলাইন হেলথ বুলেটিনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ৪৬২। করোনা মোট ১৫৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
গত ২১ এপ্রিলের ওই সভায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) জানান, সারাদেশে করোনা রোগীদের হাসপাতাল সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের একটি ম্যাপিং সম্পন্ন করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বর্তমানে সরকারিভাবে ৬ হাজার শয্যা প্রস্তুত আছে। এর ধারাবাহিকতায় সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সারাদেশে মোট ২০ হাজার শয্যা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিদেশে অবস্থানরত সব বাংলাদেশিকে চিকিৎসা প্রদানের জন্য সেখানে অবস্থিত দূতাবাস ও মিশনের সাহায্যে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে প্রবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তারা যেন এ দুর্যোগময় সময়ে সেখানে অবস্থান করতে পারেন। এ ছাড়া বিদেশ থেকে যারা ফিরছেন তাদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের টেলিমেডিসিন সার্ভিস প্রদানের জন্য একটি গাইডলাইন খুব জরুরি। এ জন্য একটি প্রাক্টিসিং গাইডলাইন থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মত দেন।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, 'করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আমাদের দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে প্রথম থেকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করায় পরিস্থিতি এখনও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আছে। তিনি বলেন, ঘরে বসে করোনা চিকিৎসা পাওয়া যায়, এরকম একটি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রণয়ন করে সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তিনি জানান, রোগ বিস্তার প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মডেল ও চিকিৎসার জন্য চীন, দক্ষিণ কোরিয়ার মডেল গ্রহণ করতে পারি। তবে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনে প্রতি সপ্তাহে প্রক্ষেপণ হালনাগাদ করতে হবে।
জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক বলেন, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যার প্রক্ষেপণটি যথাযথভাবে প্রণয়ন করে প্রস্তুতি ও রিচার্জ প্লানিং করা প্রয়োজন। বেসরকারি খাতকে সরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে পুলিশ ও দেশের সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিন-রাত নিরলসভাবে পরিশ্রম করছে এবং এজন্য এখন অনেকটা ভালো আছি। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন এবং লকডাউন কার্যকর করার ক্ষেত্রে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এই মুহূর্তে কোনো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশে ঢুকতে দেয়া যাবে না। অনেক ডাক্তার-নার্স ভয়ে আছেন। স্বাস্থ্যসেবার মান আরও বৃদ্ধি করার জন্য চিকিৎসকদের আরও আন্তরিক হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব বলেন, সংক্রমণ ঠেকাতে এবং সচেতনতা নিশ্চিত করার জন্য পাড়া-মহল্লায় মাইকিং কার্যক্রম অব্যাহত আছে। সুযোগ পেলে লোকজন একত্রিত হচ্ছেন। গ্রামে প্রচার সচেতনতার জন্য ৬০ লাখ আনসার সদস্য কাজ করছেন। তিনি জানান, নতুন করে রোহিঙ্গাদের আগমন কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা হচ্ছে।
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বর্ধিত খাদ্য সহায়তার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং জানান যে, মে পর্যন্ত খাদ্য সহায়তার জন্য যথেষ্ট খাদ্য মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া তিনি চিকিৎসক-নার্সদের বিভিন্ন দলে প্রথম লাইন, দ্বিতীয় লাইন ও তৃতীয় লাইনে বিভক্ত করার পরামর্শ দেন।
সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জানান, সশস্ত্রবাহিনী বিভাগকে বিদেশফেরত নাগরিকদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছে। প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদান করবে। এ ছাড়া রোজার সময়ে টিভিতে আলোচ্য বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে চিকিৎসকদের পরামর্শ প্রচারের অনুরোধ জানান তিনি।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, ক্রমান্বয়ে হোম কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ৬ জেলা (করোনাবিহীন) আংশিক লকডাউন প্রত্যাহার করা যেতে পারে। আর যদি সম্পূর্ণ লকডাউনে যেতে হয় তাহলে মানুষের সম্পূর্ণ খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে ব্যাপক রিসোর্সের প্রয়োজন হবে। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ নেত্রকোনা জেলা ধান কাটার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ১২ হাজার শ্রমিক পাঠানো হয়েছে। তিনি এরকম আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা নিয়মিত করে পরিস্থিতি পর্যালোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ডিজিএফআই মহাপরিচালক বলেন, করানোভাইরাস প্রতিরোধে শুধু চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জনগণের ঘরে অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য আরও এক সপ্তাহ লকডাউন বাড়ানো যেতে পারে। হাসপাতালগুলোতে সব রকমের চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার প্রদত্ত খাদ্য সহায়তা আরও সম্প্রসারণ প্রয়োজন, যাতে জনগণের নিকট পৌঁছায়। যে সমস্ত এলাকায় পাকা ধান কাটার কার্যক্রম শুরু হয়েছে ওই সমস্ত এলাকায় ধান কাটার শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি সমন্বয় জোরদার করা যেতে পারে। তাছাড়া সংসদ সদস্যরা যদি নিজ এলাকায় করোনাসহ অন্যান্য কার্যক্রম সমন্বয় করেন তাহলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ অনেক সহজ হবে বলে মতামত দেন তিনি।
ওই সভায় বিস্তারিত আলোচনার পর কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তা হলো :-
>> এ ধরনের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা নিয়মিত, প্রতি সপ্তাহে একবার করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
>> স্বাস্থ্য অধিদফতর, রোগ তত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় করোনার বিস্তার বিষয়ে প্রক্ষেপণ করবেন এবং নীতিনির্ধারকদের অবহিত করবেন।
>> স্বাস্থ্য অধিদফতর করোনা চিকিৎসার জন্য প্রণীত প্রটোকলের ভিত্তিতে একটি টেলিমেডিসিন গাইডলাইন প্রণয়ন করবে। রোগীদের ঘরে বসে চিকিৎসা প্রদানের যে সুবিধা বর্তমানে রয়েছে, তা স্বাস্থ্য অধিদফতর সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করবে।
>> যেসব এলাকায় করোনার প্রাদুর্ভাব বেশি সেসব এলাকায় লকডাউন ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান গ্রহণ করবেন। যেসব হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে সেগুলোতে চিকিৎসার সব সুবিধা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা ও খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।
এমইউ/জেডএ/জেআইএম