কখন আসছে করোনার ভ্যাকসিন? জানালেন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে আশার কথা শোনালেন বাংলাদেশি ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদ। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) থেকে পাস করা একজন চিকিৎসক। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের সেন্টার ফর ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। যেখানে তিনি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ গবেষক হিসেবে কাজ করছেন।
করোনাভাইরাস নিয়ে জাগো নিউজের নিয়মিত আয়োজন- বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ বিষয়ক ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি ভ্যাকসিন বিষয়ক নানা তথ্য তুলে ধরেন।
জাগো নিউজের পাঠক ও লাইভের দর্শকদের জন্য ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদের কাছে নানা প্রশ্ন তুলে ধরেন ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা, পরিপাকতন্ত্র এবং লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. বি এম আতিকুজ্জামান।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেতে যাচ্ছে। এ সময় সারা বিশ্বে একটি প্রশ্ন- এই মহামারির ভ্যাকসিন কবে আসবে বাজারে? ভ্যাকসিন কিভাবে কাজ করে, কেমন কার্যকর হবে? এমন নানা প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। যা ডা. বি এম আতিকুজ্জামান বাংলাদেশি ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদের কাছে তুলে ধরেন। অধ্যাপক ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদও এসব প্রশ্নের উত্তরগুলো জাগো নিউজের পাঠক ও দর্শকদের জন্য অত্যন্ত সাবলীল এবং সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন।
ডা. বি এম আতিকুজ্জামান : ভ্যাকসিনটা আসলে কী?
ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদ : ভ্যাকসিন বলতে আমরা এমন একটি প্রোডাক্ট বুঝি, যেটি আমরা গ্রহণ করলে বা আমাদের শরীরে দিলে একটি নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে। সাধারণভাবে এটাকেই আমরা ভ্যাকসিন বলি।
ডা. বি এম আতিকুজ্জামান : একটি ভ্যাকসিন যদি তৈরি করতে হয়, তাহলে সেই ভ্যাকসিনকে কী কী ধাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়?
ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদ : যে ভ্যাকসিন আমরা নেব, সেগুলোর কিছু বেসিক গুণাবলি থাকতেই হবে। যেমন- এটি নিরাপদ হতে হবে। এটা যে কারণে আমি নেব, এই রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাটি যেন ওই রোগের বিরুদ্ধে ডেভেলপ করে। আমারা যখন একটি ভ্যাকসিন বাজারজাত করি, সেটা কতদিন পর্যন্ত তার কার্যকারিতা বহাল থাকবে সেটাও একটা খুব উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। যেমন ধরুন, আমি একটি ভ্যাকসিন বানালাম সেটা যদি ৬ মাস বা একবছর পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধ করে তাহলে সেটাও ভালো জিনিস। কিন্তু আমাকে মনে রাখতে হবে, এক বছর পর পর সেই ভ্যাকসিন নিতে হবে। এমন বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে ভ্যাকসিন তৈরি থেকে শেষ পর্যন্ত ধাপে ধাপে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পর একটি ভ্যাকসিনকে জনস্বার্থে মানুষকে নিতে বলতে পারি।
ডা. বি এম আতিকুজ্জামান : আমরা অনেক ভ্যাকসিন তৈরির ইতিহাস থেকে জানি, আমরা অনেক ভ্যাকসিন তৈরি করতে চাচ্ছি কিন্তু তৈরি করতে পারছি না। সেক্ষেত্রে করোনাভাইরাস একটি নতুন ভাইরাস, এই ভ্যাকসিন তৈরিতে কতদূর আমরা অগ্রসর হতে পেরেছি?
ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদ : রোগজীবাণু আমাদের শরীরে ঢুকে আমাদের রোগাক্রান্ত করে। তারা কিন্তু কম চালাক নয়। অনেক ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া আছে, যারা আমাদের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে তা বাইপাস করে যেতে পারে। যেটাকে বলা হয় ইমিউন ইভেশন। যে কারণে এগুলো খুব জটিল বিষয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সময়ের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করতে হবে। যেই ভ্যাকসিনটি আমাদের এখনই দরকার। তাই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ভ্যাকসিনে আমরা কিভাবে কাজ করি। পরীক্ষাগারে আমারা নানা রকম গবেষণা করে সেই প্যাথলজি এবং জীবাণু সম্পর্কে অনুশীলন করার পর আমরা চিন্তা করি, এই জীবাণুটাকে পরাস্ত কারার জন্য এটার বিরুদ্ধে কিভাবে ইমিউন রেসপন্স তৈরি করতে হবে।
অ্যান্টিবডি যে আমারা তৈরি করব, সেটি কিন্তু একটি মোক্ষম অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হবে। একটি কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করাটাই আসল লক্ষ্য ভ্যাকসিনের। আমরা একটি ভ্যাকসিন এমনভাবে দিতে চাই না যেটি পরবর্তীতে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবে। ভ্যাকসিনটি ধাপে ধাপে পরীক্ষা করতে হয়, আর সেই পরীক্ষা করার সময়টি অনেক লম্বা হয়। কিন্তু যেহেতু আমার এখন সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছি, তবুও একটি নির্দিষ্ট সময় আমাদের লাগবে। আমারা যারা বিজ্ঞানী আছি, তারা পর্দার আড়ালে কাজ করে যাচ্ছি। প্রাথমিক কাজটি হয়ে গিয়েছে।
খবরের কাগজে এসেছে অক্সফোর্ডের এক্সটাজেনেকাস নতুন নাম এজেডই ১২২ তারা এটি মানব শরীরে চেষ্টা করে দেখেছে ইমিউন রেসপন্স করতে পারে এবং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। সেটা কতটুকু রোগ প্রতিরোধ করে সেটা পরবর্তী ধাপে জানা যাবে।
এরপরে ক্যানসাইনো বলে একটি চাইনিজ কোম্পানি একটি ভ্যাকসিন ট্রায়াল করেছে। সেখানে দেখা দিয়েছে, ভ্যাকসিনটি প্রাথমিকভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরী অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং এটি টিসেল রেসপন্স তৈরি হয় এটা আশার কথা।
একটা জনসন অ্যান্ড জনসন এবং একটা মার্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে। আমেরিকাতে মর্ডালেরা নামের একটি কোম্পানি, ম্যাসেঞ্জার আরএনএ ১২৭৩ নামের একটি কোম্পানি তাদের ভ্যাকসিন নিয়ে আশাবাদী। নোভা ভ্যাক্স নামের কোম্পানি তারা মাঠে নেমেছে, আমার একজন কলিগ (সহকর্মী) এটার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়া আরও কতগুলো ভ্যাকসিন আছে, যা পুরনো আদলে তৈরি করার চেষ্টা চলছে অর্থাৎ করোনাভাইরাসটিকে মেরে ফেলে সেই মরা জীবাণুটা আমাদের শরীরের ঢুকিয়ে দিয়ে একটা ভ্যাকসিনের যে চেষ্টা চলছে রুহানি ইনিস্টিটিউশন ফর বায়োলোজিক্যাল প্রোডাক্ট এবং সাইনোফা কোম্পানির সহায়তায় ফেজ-১ ট্রায়াল হয়েছে।
ঠিক এই মুহূর্তে ১০০-এর অধিক প্রোডাক্ট আমাদের হাতে ছিল, যেগুলো আমারা বিজ্ঞানী হিসেবে ট্রায়াল দিতে পেরেছি, পারছি। একটি প্রোডাক্ট মানব শরীরে যাওয়ার আগেই অনেক দীর্ঘ কাজ থাকে।
শুধু একটি ভ্যাকসিন প্রোডাক্ট পেয়ে গেলেই হচ্ছে না, একটি ভ্যাকসিন যখন একজন রোগীকে দেয়া হয় তার আগে নিশ্চিত হতে হয়। ঘরের বাড়ির রান্না করা আর বিয়ের বাড়ির রান্না করা এক জিনিস নয়। আমি ১০ জন বা ১০০ জন মানুষের জন্য ডোজ তৈরি করতে পারছি, কিন্তু এটা যখন কমার্শিয়াল পর্যায়ে নেয়া হবে সেখানে টেকনোলজি ট্রান্সফার করতে কিন্তু প্রচুর সময় ও অর্থের প্রয়োজন হয়। যারা ট্রায়াল দেয়, তাদের মধ্যে শতকরা ১০ শতাংশ ভ্যাকসিন বাজারে আসতে পারে। তারপরও আমারা আশাবাদী।
ডা. বি এম আতিকুজ্জামান : ভ্যাকসিনটা আসতে আসলে কত সময় লাগতে পারে?
ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদ : অনেকের মতে ১৮ মাস লাগার কথা এর মধ্যে তিন মাস বাদ দিচ্ছি। কেউ কিন্তু বসে নেই। তবে আমরা যেহেতু বিশেষ অবস্থার মধ্যে আছি, সেহেতু আমারা ধারণা করে নিচ্ছি সামনে মৌসুমের আগে আমারা একটা দুইটা ভ্যাকসিন বাজার পেয়ে যাব খুব তাড়াতাড়ি। এই রোগটি আমাদের অর্থনীতিকে যেভাবে বিপর্যস্ত করেছে, সেই প্রেক্ষাপটে হয়তোবা বাজারজাত হয়ে যাবে।
ডা. বি এম আতিকুজ্জামান : ভ্যাকসিনের ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা কি আছে, যা বাজারে এসেছে কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে ঠিকমতো কাজ করছে না?
ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদ : একটা ভ্যাকসিনের দুটো কার্যকারিতা থাকে। একটি হচ্ছে- জীবাণুটি শরীরের ঢোকামাত্র সেটা বিনাশ হয়ে যাবে। আরেকটি হচ্ছে- ভ্যাকসিনটি একটি ইমিউনিটি তৈরি করে যেটা ভাইরাসটার কার্যকারিতা কমিয়ে আনতে পারে। যে কারণে আমাদের আগে জানতে হবে ফেইলইউরের ডেফিনিশনটা কী?
ডা. বি এম আতিকুজ্জামান : ভ্যাকসিন সাপ্লাই চেইনের বিষয়ে জানতে চাই, বাংলাদেশে এই ভ্যাকসিন পৌঁছাতে কত সময় লাগতে পারে?
ডা. রেজওয়ানুল ওয়াহিদ : বিশ্বে আমি যদি নিরাপদ থাকি, কিন্তু অন্যরা যদি অনিরাপদ হয় তাহলে আমার নিরাপদ থাকাটা কার্যকরী না। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যদি করোনাভাইরাসের প্রকোপ থাকে তাহলে কিন্তু আমি আমেরিকাতে বসে নিশ্চিন্ত হতে পারব না। কারণ আমারা সবাই গ্লোবালি কানেক্টেড। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যদি যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়, তাহলে শুধু আমি নিরাপদ থেকে লাভ নেই। তবে যেহেতু এতগুলো একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়, তাই আমাদের প্রায়োরিটি বেস কাজ করতে হবে। যাদের প্রয়োজন, যারা বেশি ভুগছেন তাদের প্রাধান্য দিতে হবে আগে।
তাই আমরা যেন আতঙ্কিত না হই। সার্বিক সুস্বাস্থ্য আমাদের রক্ষা করতে পারে। আর আমরা যেন এটা সবসময় মেনে চলি, এটাই আমাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত।
আলোচনার শেষাংশে এসে ডা. বি এম আতিকুজ্জামান বলেন, করোনা সংক্রমণের কোন প্রকৃত ওষুধ কিন্তু এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথে আমরা রয়েছি। আমরা জানি, যেটি আমাদের প্রিভেন্ট করে সেটি হলো সোশ্যাল আইসোলেশন বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। আমাদের প্রত্যেকের বাইরে গেলে মাস্ক পড়তে হবে। বাংলাদেশ খুব জনবহুল দেশ, এখানে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মেনে চলা খুব সহজ না। সামনেই বাংলাদেশে সবকিছু খুলে দেয়া হচ্ছে, সে সময় অনেকেই হয়তোবা রীতিনীতি মানবেনও না। কিন্তু প্রতিরোধ করতে ইফেক্টিব উপায়- সবার মাস্ক পড়া নিশ্চিত করা, দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া। আমরা আশাবাদী।
এএস/এফআর/এমএস