করোনা : এক মৌসুমেই বাজিমাত লেবুচাষিদের

ফজলুল হক শাওন
ফজলুল হক শাওন ফজলুল হক শাওন , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০২:৫১ পিএম, ০৫ জুন ২০২০

করোনাভাইরাসের মধ্যেও দেশের লেবুচাষিরা লাভবান হয়েছেন। এক মৌসুমেই অনেকের কপাল খুলে গেছে। স্বল্প জমিতে লেবু চাষ করেই লাভবান হয়েছেন অনেকে। তারা বলছেন, করোনা ও রমজানের শুরুতে লেবুর যে দাম পেয়েছেন, এত দাম অতীতে কোনো মৌসুমে পাননি। প্রতি হালি লেবু বাগান থেকেই ২৮-৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন তারা। এখন অবশ্য লেবুর দাম কম হলেও আগে তারা যে চড়া দাম পেয়েছেন তাতে লেবুচাষিরা বেশ খুশি।

এখন পর্যন্ত মহামারি করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। ভিটামিন সি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, আর সে কারণে লেবু খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

তারা বলছেন, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি খেতে হবে। তাই করোনা সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে লেবুর চাহিদা। করোনার কারণে লেবুচাষিদের ঢাকার মার্কেটের জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি। গ্রাম ও আশপাশের শহরের ক্রেতাদের মধ্যে লেবুর অনেক চাহিদা ছিল। লকডাউন থাকার পরও অনেক বেপারী লাভের আশায় সবজির ট্রাকে চড়ে ঢাকায় এসেছেন লেবু বিক্রি করতে। ভালো দামও পেয়েছেন তারা।

jagonews24

লেবু চাষে দেশের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৬ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। লেবু ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। এছাড়া লেবু, মাল্টা ও কমলা চাষের জন্য চারা ও সার বিতরণ করা হচ্ছে বিনামূল্যে।

লেবু চাষ লাভজনক হওয়ায় এ প্রকল্পের সঙ্গে অনেক কৃষক যুক্ত হচ্ছেন। পুরোটাই সরকারি অর্থায়নে। প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)। লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বাড়াতে দেশের সাতটি বিভাগের ৩০টি জেলার ১২৩টি উপজেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানিকৃত লেবুজাতীয় ফলের দাম বেশি হওয়ায় সবার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। এর প্রেক্ষিতে সরকার দেশের লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে দেশে লেবুজাতীয় ফসলের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে, তবে চাহিদার তুলনায় অনেক কম। কিছু পরিমাণ লেবু রফতানিও হচ্ছে।

তারা আরও বলেন, দেশে লেবু, মাল্টা, বাতাবি লেবু, কমলা, এলাচি লেবু, জারা লেবু, কলম্বো লেবু, সাতকোসহ নানা ধরনের লেবুজাতীয় ফল রয়েছে। এসব ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দেশব্যাপী বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা চলছে। এগুলোর প্রসার ও উন্নয়নে সবাইকে আন্তরিক হতেও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাইট্রাস বা লেবুজাতীয় ফলের মধ্যে দেশে মাল্টা, কমলা ও বাতাবি লেবুর চাষের প্রচুর সম্ভাবনাও রয়েছে। বৃষ্টিবহুল ও উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে এ ফল ভালো হয়। লেবুজাতীয় ফলের চাষকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলে সফল হওয়া যাবে বলে অধিদফতরের কর্মকর্তারা মনে করেন।

বগুড়ার ধুনট উপজেলার পীরহাটি গ্রামের লেবু চাষি আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এবার লেবুতে খুব ভালো দাম পেয়েছি। করোনা ও রোজার শুরুতে প্রতি হালি লেবু ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি করেছি। বেপারীরা বাগান থেকে প্রতি ১০০ লেবু নিয়েছে ৫০০-৬০০ টাকায়।

তিনি বলেন, মাত্র ২০ শতক জমিতে লেবুর চাষ করেছি। প্রতি বছর দেড় লাখ টাকার মতো লেবু বিক্রি করা যায়। এবার দুই লাখের কাছাকাছি যাবে। এ পরিমাণ জমিতে অন্য কোনো ফসল করে এত টাকা বিক্রি করা যাবে না। লেবু ছাড়াও প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার কলম বিক্রি করা যায়। এখন অবশ্য লেবুর দাম কম। কারণ বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় ও শ্রাবণ পুরো লেবুর মৌসুম। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি গাছে লেবু ধরছে।

লেবু চাষের বিষয়ে যশোরের ঝিকরগাছার আবুল কাসেম জাগো নিউজকে বলেন, এক বিঘা জমিতে লেবু চাষ করেছি। প্রতিবার এক থেকে দেড় লাখ টাকার লেবু বিক্রি করি। এবার আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার লেবু বিক্রি করতে পারবো। ইতোমধ্যে দুই লাখ টাকার লেবু বিক্রি করেছি।

তিনি বলেন, করোনার কারণে এবার লেবুর চাহিদাও খুব বেশি। এবার বাজারে লেবু নিতে হয়েছে খুব কম। বাগান থেকেই বেপারীরা লেবু নিয়ে গেছে। করোনার প্রথম দিকে প্রতি হালি লেবু বাগান থেকে ২৫-৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এখন অবশ্য দাম কম; এখন প্রতি হালি ৮-১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর কিছু দিন পর এ মৌসুম শেষ হয়ে যাবে।

jagonews24

নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এবার করোনার কারণে আমরা লেবুর ভালো দাম পেয়েছি। ৭ বিঘা জমিতে লেবু চাষ করেছি। করোনাকালের পরিস্থিতিতে গত দুই মাসেই বাগান থেকে লেবু বিক্রি করেছি প্রায় ১৪ লাখ টাকার।

তিনি বলেন, লেবু চাষে তুলনামূলক পানি সেচ তেমন একটা লাগে না। সারসহ পরিচর্যা আর শ্রমিক খরচ খুবই কম। তাই বরেন্দ্র ভূমিতে ক্রমেই বাড়ছে লেবুর বাগান। এ বছর লেবু বিক্রিতে চাষিদের কোনো সমস্যা হয়নি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জমিতে এসেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন লেবু। করোনা ও রোজার সময় প্রতিটি লেবু বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৭ টাকা পর্যন্ত। এখন তুলনামূলক লেবুর দাম কম।

লেবু ও লেবুজাতীয় ফল চাষে দেশের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যে প্রকল্প গ্রহণ করেছে, সে প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ ফারুক আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, লেবু ও লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বাড়াতে দেশের সাতটি বিভাগের ৩০টি জেলার ১২৩টি উপজেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ জন্য আমরা কৃষকদের ট্রেনিং দিচ্ছি। টেনিং করার জন্য সম্মানী বাবদ নগদ টাকা দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া ভালো মানের চারা, সার ও পোকামাকড় দমনের জন্য কীটনাশক দেয়া হচ্ছে বিনামূল্যে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে লেবু ও লেবুজাতীয় ফলের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়বে এই চাষ। তখন লেবু এবং লেবুজাতীয় ফল বিদেশে আমদানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

এফএইচএস/এমএসএইচ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।