'প্লিজ, স্বজনকে বেওয়ারিশ লাশ না বানাই'
মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রবেশ করেছে ৮১ হাজারের বেশি বাংলাদেশির শরীরে। প্রাণ গেছে প্রায় ১১শ জনের মতো। দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। প্রতিদিন দাফন হচ্ছে ৪০-৪২ জনের মরদেহ।
তবে যেই বাংলাদেশিরা বিশ্বে অতিথিপরায়ণতা ও আন্তরিকতার জন্য বিখ্যাত, এই করোনাকালীন সময়ে তাদের ক্ষেত্রেই ভিন্নরূপ দেখা যাচ্ছে।
করোনায় মারা যাওয়া অনেক রোগীর স্বজন উপস্থিত হননি তাদের মরদেহের পাশে। কবরস্থানে-দাফনে দূরের কথা, হাসপাতালে মরদেহটি নিতে কিংবা দেখতেও যাচ্ছেন না কেউ কেউ। ফোনে মরদেহ সৎকারের নির্দেশনা দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ পরিবারের অসুস্থ স্বজনকে ঘরে রেখে কিংবা বাইরে ফেলে চলে যাচ্ছেন। তবে করোনা মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী এই শহীদদের পাশে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। কখনও অভিভাবক, কখনও স্বজন আবার কখনও সন্তানের ভূমিকা পালন করছেন তারা। বেওয়ারিশের ওয়ারিশ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
শুক্রবার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নির্মম এই বাস্তবতা নিয়ে একটি পোস্ট দেন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) মো. ইমরান আহম্মেদ। তার পোস্টটি নিচে হুবুহু তুলে ধরা হলো।
’করোনার হাত থেকে পালাতে কী না করছি আমরা? কেউ অসুস্থ হলে তার কাছে ঘেঁষি না। মারা গেলে লাশের ত্রিসীমানায় যাই না। দাফন, গোসল বা কবর দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। উল্টো লাশ নিতে, দাফনে বা দাহ করতে বাধা দিচ্ছি। লাশের সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে অমানবিক আচরণ করছি। কিন্তু কেন করছি এমন আচরণ? নিজেকে বাঁচাতে? আসলেই কি বেঁচে থাকব আমরা? চিরদিন? মরবো না কোনোদিন? অমর থাকব?
একবার ভেবে দেখেছি কী, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের যারা করোনা আক্রান্ত বা করোনায় উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের দাফন বা দাহ করেছেন, তাদের কতজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন? মৃত মানুষের থেকে যদি করোনা ছড়াত, তাহলে ওই মানুষগুলো এখনও দিব্যি কাজ করে যাচ্ছে কীভাবে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলল, সরকার বলল মৃত মানুষের থেকে করোনা ছড়ায় না। কিন্তু আমাদের আচরণের বিন্দুমাত্র নড়চড় নাই। বনের বাঘে খায় না,মনের বাঘে খায়।
একটু বুদ্ধি খাটান। হিসাব মেলান। মানুষ মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ওই দেহ থেকে করোনা ছড়ায় না। আর জানেন তো, করোনা সাধারণ ৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বা সাবানের উপস্থিতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। মৃত মানুষের গোসলে কি কি লাগে? গরম পানি, সাবান। করোনা যদি থেকেও থাকে, তা মারতে কি এগুলো যথেষ্ট মনে হয় না? একটা মানুষকে যখন দাহ করা হয়, তখন তাপমাত্রা কত থাকে- অনুভব করতে পারেন? ওই তাপমাত্রায় করোনা বাঁচতে পারে? দাফনের কাপড় না-ই বা পরাল। যদি প্লাস্টিকের ব্যাগে লাশটি ঢুকানো হয়, এরপরও কি করোনা সেখান থেকে বেরোতে পারে? সাধারণ যুক্তিতে কি মনে হয়? হুজুগে দৌড়াবেন, না একটু চিন্তা করে দেখবেন?
আজ যারা গায়ের জোরে লাশের সাথে এমন অমানবিক আচরণ করছেন, স্বজনদের খবর নিচ্ছেন না, তাদের কি কোনোদিন মৃত্যু হবে না? অমর থাকবেন? অথচ এই মানুষগুলো আপনাদের জন্য জীবনে কী না করেছে! কত কষ্ট সহ্য করেছেন। কিন্তু তার বিদায়ে কীভাবে এত অকৃতজ্ঞ হচ্ছেন। এমন অমানবিকতা আল্লাহ সহ্য করবেন? একবারও কি ওই লাশের জায়গায় নিজেকে রেখে ভেবে দেখেছেন? চোখটা বন্ধ করে পাঁচটা মিনিট ভাবুন তো।
যদি আপনি আস্তিক হন, তবে আপনার মৃত্যু সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত -এটা অন্তত বিশ্বাস করেন। অনেক টাকা পয়সা, নিজের হাসপাতাল থাকার পরও অনেকেই মারা গেছেন। টাকা পয়সা-হাসপাতাল-ভেন্টিলেটর করোনা থেকে বাঁচাতে পারেনি। কারণ, মৃত্যু যে বিধাতা করোনাতে লিখেছেন, কে পারবে সেই নিয়ম খণ্ডাতে! আবার হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা না পাওয়া মানুষটাও সুস্থ হয়ে ফিরে আসছেন। আসলে কে বেঁচে থাকবেন, কে মারা যাবেন, সেটি আপনি নির্ধারণ করতে পারবেন না। পালিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না। এই সহজ সত্যটা মেনে নিন। আসুন, লাশের সাথে অমানবিক আচরণ বন্ধ করি। স্বজনের মৃত্যু পরবর্তী কার্যক্রমে অংশ নেই। তাকে দাফন বা দাহে ব্যবস্থা করে দেই। এলাকাবাসী বা প্রতিবেশী যারা আছি, সহযোগিতা করতে না পারি অন্তত বাধা না দেই। দয়া করে স্বজনকে বেওয়ারিশ লাশ না বানাই। প্লিজ!'
এআর/জেডএ