রাস্তায়-মার্কেটে ‘ঈদের ভিড়ে’ চিড়েচ্যাপ্টা ‘স্বাস্থ্যবিধি’
রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা শওকত আলী (৭০) গত জানুয়ারিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। করোনার সংক্রমণে তার ৬০ শতাংশ ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাসপাতালের ওয়ার্ড, কেবিন ও আইসিইউতে মাসের অধিক সময় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে প্রাণে বাঁচেন। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে স্মৃতিভ্রম, বুক ধড়ফড় করা, পা ফুলে যাওয়াসহ নানা সমস্যা ঝেঁকে বসেছে তার শরীরে।
একজন নিউরোলজিস্ট বিশেষজ্ঞের পরামর্শে তিনি আজ শনিবার (১০ এপ্রিল ) হার্টের ইসিজি ও ইকোকার্ডিওগ্রাম পরীক্ষা করাতে ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে যান। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় ফেরার পথে লকডাউনের মধ্যেও মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ঢাকা কলেজ, নিউমার্কেট ওভারব্রিজ, গাউছিয়া, চাঁদনিচক, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে রাস্তায় অসংখ্য যানবাহন ও মানুষের ভিড় দেখে হতবাক বনে যান।
কারো মুখে মাস্ক আছে তো, কারো মুখে নেই, সামাজিক দূরত্ব তো দূরের কথা, গায়ে গা ঘেঁষে মানুষ কেনাকাটা করছে। অবস্থাদৃষ্টে তার মনে হয়েছে যেন ঈদের আগে চাঁদরাত। এছাড়াও সরকার ঘোষিত সাত দিনের ‘কঠোর বিধিনিষেধ’-এর আজ যে ষষ্ঠ দিন চলছে তা দেখে ঘুণাক্ষরে বোঝার উপায় নেই।
দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ছেলেকে বললেন, মানুষ করোনার ভয়াবহতাকে তোয়াক্কাই করছে না। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিলেও তা কাজে আসছে না। আল্লাহ জানেন দেশে করোনা পরিস্থিতি আরও না জানি কত ভয়াবহ হয়! তার মতো ভুক্তভোগী না হলে করোনা যে কত ভয়াবহ তা কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
এ দীর্ঘশ্বাস করোনা আক্রান্ত শওকত আলীর একার নয়, তার মতো ভুক্তভোগী অনেক রোগীসহ সচেতন মানুষের প্রশ্ন- মানুষকে করোনার ভয়াবহতা বোঝাতে আর কত সংক্রমণ ও মৃত্যু হতে হবে?
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) আয়োজিত করোনা পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিএসএমএমইউ’র করোনা ইউনিট ও কেবিনে সাত হাজারেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। সেখানে প্রায় সাড়ে চার হাজার রোগী ভর্তি হন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় সাড়ে ৫০০ রোগীর। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন সাড়ে তিন হাজার রোগী।
যেসব রোগী রিলিজ পেয়েছেন তাদের পোস্ট-কোভিড ফলোআপ চিকিৎসার সময় দেখা গেছে, রোগীভেদে অনেকেই শ্বাস নিতে কষ্ট, শুকনো কফ, ইনসোমনিয়া (ঘুমের ব্যাঘাত), মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা, অবসাদগ্রস্ত, দুর্বলতা, বুক ধড়ফড় করা, ভার্টিগো (মাথা ঘুরানো) ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে ল্যাবএইড হাসপাতালের নিউরোলজি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আশরাফ আলী বলেন, করোনার ভয়াবহতা অধিকাংশ মানুষ উপলব্ধিই করতে পারছেন না। করোনায় এত মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যু হতে দেখেও হুশ হচ্ছে না মানুষের। গরীব মানুষ মনে করছে, করোনা তাদের রোগ নয়। মধ্যবিত্তরাও করোনাকে তোয়াক্কা না করে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলাফেরা করছেন।
তিনি জানান, কোভিড পরবর্তী সময়ে স্মৃতিভ্রমসহ নানা জটিলতা নিয়ে রোগীরা আসছেন। তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা গ্রহণ করতে হচ্ছে বলে তিনি জানান।
করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দেশের চলমান করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুরোধে দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউন পালনসহ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, ১৪ এপ্রিল থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে সাত দিনের ‘কঠোর লকডাউন’ পালিত হবে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর হোসেন বলেন, দেশের মানুষকে সার্বক্ষণিক মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পুরোপুরি উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে সংক্রমণ ও মৃত্যু রোধ করা যাবে না।
ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বর্তমানে সাত দিনের ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ চলাকালে মার্কেট ও শপিংমল সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকছে। করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ পরিস্থিতিতেও স্বাস্থ্যবিধি না মেনে হাজার হাজার মানুষ মার্কেটে যাচ্ছে। ১৪ এপ্রিল থেকে সরকার কঠোর লকডাউন ঘোষণা করছে এবং এরপর সেই লকডাউন আরও বাড়তে পারে মনে করে মানুষ ঈদকে সামনে রেখে শপিং করছেন। কিন্তু এ সময় স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না বেশিরভাগই, যা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এমইউ/এআরএ/এএসএম