টিসিবির পণ্যে ভরসা করোনায় কাজ হারানো মানুষের
রাজধানীর নিউমার্কেট এক নম্বর গেটের পাশেই ভ্যাপসা গরমে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু। লাইনে পেছনের দিকে যারা আছেন, তাদের কেউ ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে; কেউবা রাস্তার আইল্যান্ডে বসেছিলেন।
তুলনামূলক কম খরচে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবির) তেল, চিনি ও মসুর ডাল কিনতে তাদের সবাই লাইনে দাঁড়িয়েছেন। টিসিবির ট্রাকের ওপর থেকে দুজন চিনি ও ডাল পরিমাপ করে পলিথিনে ভরছেন।
আরেকজন কেনা পণ্যের টাকা নিয়ে ক্রেতাদের হাতে পণ্য তুলে দিচ্ছিলেন। লাইন থেকে কিছুক্ষণ পর পর সিরিয়াল ভেঙে দু-চারজনকে পণ্য দেয়াকে কেন্দ্রে করে হৈ চৈ ও হট্টগোল সৃষ্টি হচ্ছিল।
হঠাৎ করে আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। ঝুম বৃষ্টি নামে। টিসিবির পণ্য বিক্রেতারা বিশাল আকারের পলিথিন দিয়ে তড়িঘড়ি করে পুরো ট্রাকের পণ্য ঢেকে ফেলেন। এ সময় লাইন থেকে আওয়াজ আসে- ‘প্লিজ, পণ্য দেয়া বন্ধ করবেন না। দু-তিন ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে রোদে পুড়ছি, এখন বৃষ্টিতে ভিজছি। আমরা পলিথিন উঁচু করে ধরে রাখছি, তবুও আপনারা পণ্য দেন।’ ক্রেতাদের কথা শুনে প্রথমে ইতস্ততবোধ করলেও কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির মধ্যেই পণ্য বিক্রি শুরু করেন বিক্রেতারা।
মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) দুপুর আনুমানিক দেড়টার দিকে এমন চিত্র চোখে পড়ে। মহামারি করোনাকালে অসংখ্য নিম্ন আয়ের মানুষ দু’বেলা খাবারের জন্য টিসিবির পণ্যের ওপর নির্ভরশীল।
টিসিবির ট্রাক থেকে ৬৪০ টাকায় চার লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি চিনি এবং দুই কেজি মসুর ডাল কেনা যায়। এজন্য প্রতিটি ট্রাকের সামনে সকাল থেকে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশু লাইন ধরে অপেক্ষা করেন। সীমিত পরিমাণ মালামাল বিক্রি করায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য না কিনে ফিরে যেতে হয় অনেককে।
টিসিবির লাইনে এক সময় কেবল হত-দরিদ্রদের দেখা যেত। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। আবার কারও কারও ব্যবসা বন্ধ। ফলে আয়-রোজগার না থাকায় চাকরিজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনছেন।
টিসিবির একজন পণ্য বিক্রেতা জানান, তারা ৭০০ লিটার তেল, ৭০০ কেজি চিনি ও ৩০০ কেজি মসুর ডাল বিক্রি করতে এনেছেন। যতক্ষণ পণ্য থাকবে, ততক্ষণ বিক্রি করবেন। চাহিদার তুলনায় পণ্যসামগ্রী কম সরবরাহ হওয়ায় লাইনে থাকা অনেকে খালি হাতে ফিরে যান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মহামারির এ সময়ও একটি সংঘবদ্ধ চক্র ঘুরে-ফিরে নিজেদের লোকজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে টিসিবির পণ্য ক্রয় করছেন। ঘুরে ফিরে লাইনে একই পরিবারের চার-পাঁচজন করে সদস্যকে পণ্য কিনতে দেখা যায়।
ক্রেতাদের অভিযোগ, এ তালিকায় নারী ও পুরুষ উভয়ই রয়েছেন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে নিজেদের পরিবারের সদস্য অথবা ভাড়াটে লোক লাইনে দাঁড় করিয়ে টিসিবির মালামাল কিনে বাইরে বেশি দামে বিক্রি করেন।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা গৃহবধূ সফুরা খাতুন। প্রায় দেড় ঘণ্টা ছাতা মাথায় লাইনে দাঁড়িয়ে। পরিধেয় পোশাক বেশ রুচিশীল।
তিনি জানান, তার স্বামী নিউমার্কেটে ফুটপাতে জুতার ব্যবসা করেন। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেশ ভালোই সংসার চলছিল। কিন্তু দেড় বছর ধরে করোনার কারণে অধিকাংশ সময় মার্কেট বন্ধ থাকায় আয়-রোজগার নেই বললেই চলে। জমানো টাকা ভেঙে কোনোভাবে টিকে আছেন। টিসিবির পণ্য বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে পাওয়া যায় বলে এখান থেকে পণ্য কেনেন।
সাদেক হোসেন নামের এক দিনমজুর জানান, আগের দিন দেরিতে আসায় পণ্য পাননি। এজন্য আজ বেলা ১১টার দিকে এসেছেন। তবুও লাইনে তিনি অনেক লোকজনের পেছনে। সকাল থেকে রোদে পুড়ছেন, এখন বৃষ্টিতে ভিজছেন। তবুও সান্ত্বনা আজ হয়তো খালি হাতে ফিরে যেতে হবে না।
এমইউ/এএএইচ/এমএস