চেয়ারম্যান জাকিরের ‘গাড়ি ফাঁদ’, প্রবাসী শফিকুলের খোয়া ৫ কোটি

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৫ এএম, ০৬ অক্টোবর ২০২২

শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বেড়ে উঠেছেন কুয়েতে। পড়ালেখা শেষে সেদেশেই শুরু করেন ব্যবসা। কয়েক বছরে ব্যবসায় ভালো লাভ হয় তার। এরপর কুয়েতেই বিয়ে করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে তার। করোনার সময় শফিকুল দেশে আসেন। গাড়ি কিনতে গিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি শোরুমে পরিচয় হয় কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মাইনকারচরের ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের সঙ্গে। জাকিরের লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে শেষ পর্যন্ত পাঁচ কোটি টাকা খোয়ান শফিকুল। তার মতো ফাঁদে পা দিয়ে কোটি কোটি টাকা খোয়ানোর তালিকায় আছেন সংসদ সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তা, ইউপি মেম্বার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী।

তিন শতাধিক ভুক্তভোগীর হাজার কোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ গ্রেফতার জাকিরের বিরুদ্ধে। রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা ও সুলভমূল্যে গাড়ি কেনাবেচার নামে ভয়ংকর প্রতারণার অভিযোগে গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে কুমিল্লা জেলার মেঘনা থানা এলাকা থেকে জাকিরকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ।

প্রতারণার টাকায় তিনি গ্রামে আলিশান বাড়ি বানিয়েছেন। ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন পেতে একজনকে উপহার দেন প্রাডো গাড়ি। নির্বাচনে বিপুল টাকা খরচ করে হন চেয়ারম্যান। ঢাকায় রয়েছে ফ্ল্যাট-প্লট ও গাড়ি। ছেলেকে পাঠিয়েছেন আমেরিকায়। আগামী নভেম্বরে তারও আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, জাকিরের মোট গাড়ি ২০-২৫টি। সেসব গাড়িই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে দেখাতেন। কয়েকজন এমপি ও প্রশাসনের লোকদের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন। তবে তাদের কাছে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে মাসিক কিস্তির টাকা ঠিকই পরিশোধ করতেন।

যেভাবে ফাঁদে পা দেন প্রবাসী শফিকুল
জাকির পোর্ট থেকে সস্তায় গাড়ির কেনার প্রস্তাব দেন শফিকুলকে। সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে প্রতিটি ২৮ লাখ ও ২৬ লাখ করে ১৩টি গাড়ি কেনেন। গাড়িগুলো জাকির নিজের কাছে রেখে শফিকুলকে ভাড়া হিসেবে গাড়িপ্রতি মাসে ৬৫ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই হিসাবে ১৩টি গাড়ির জন্য প্রতি মাসে ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

শফিকুল জাগো নিউজকে বলেন, ১৯৯২ সালে যুদ্ধের সময় আমার প্রায় সব ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর করোনা এসে ব্যাপক ক্ষতি করে। এর মধ্যে দেশে এলে জাকিরের কাছে ধরা খাই পাঁচ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে খারাপ অবস্থায় আছি। ছোটবেলা থেকেই আমি কুয়েতে থাকি। তিন বছর আগে করোনার সময় কুয়েত থেকে দেশে আসি। এরপর গাড়ি কেনার জন্য ধানমন্ডির একটি শোরুমে যাই। সেখানে দেখা হয় জাকির চেয়ারম্যানের সঙ্গে। তার ভিজিটং কার্ড দেখিয়ে আমাকে বলেন, তিনি পোর্ট থেকে গাড়ি বের করে আনতে পারেন।

‘তার সঙ্গে পরিচয়ের পরদিন দেখা করতে আমার বাসায় চলে এলেন। গাড়ি দেখালেন। প্রথমে তার কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকা করে দুটি গাড়ি কিনলাম ৫৬ লাখ টাকায়। এরপর গাড়ির কাগজপত্র (দলিলপত্র) নিয়ে বাসায় এলাম। কিন্তু গাড়ির নাম ট্রান্সফার কীভাবে করে তা আমি বুঝতে পারিনি।’

শফিকুল বলেন, একবার জাকির তার গ্রামের বাড়িতে আমাকে দাওয়াত দিলেন। গিয়ে দেখি তার ভাঙা বাড়ি-ঘর। বাড়ির পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করছিলেন জাকির। মসজিদের ছাদ ঢালাইয়ের জন্য নিজের পকেট থেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। তার কথাবার্তা শুনে খুব ভালো লেগেছিল। এরপর আরও ৫২ লাখ টাকা দিয়ে নতুন দুটি গাড়ি কিনি তার কাছ থেকে।

আরও পড়ুন>> গ্রেফতার জাকির চেয়ারম্যানের তথ্যে ২০ মাইক্রোবাস উদ্ধার

‘জাকিরের মাছ ও গরুর খামারে বিনিয়োগ করেছিলাম দুই কোটি টাকা। সেখান থেকে মাসে ৬০ হাজার করে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোনো টাকা না দিয়ে আমার পাঁচ কোটি টাকা গায়েব করে দেন চেয়ারম্যান জাকির। এছাড়া ১৩টি গাড়ির ভাড়া বাবদ পাওনা ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। দেড় বছর আগে দেশে এসে ট্যাক্স দেওয়ার জন্য গাড়ির কাগজপত্র চেয়েছিলাম। তখন ১১টি গাড়ির কাগজ দেন আমাকে। এরপর উকিলের কাছে কাগজপত্র দেওয়ার পরে উকিল জানালেন একটা গাড়িও আমার নামে নেই, অর্থাৎ সব গাড়ি জাকিরের নামে।’

ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারসহ তিনজনের খোয়া ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা
ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান প্যানেল চেয়ারম্যান মো. বাতেন মেম্বার জাগো নিউজকে বলেন, গাড়ি ব্যবসার কথা বলে এলাকার বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন জাকির চেয়ারম্যান। আমি নিজে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। আমার মতো সাতজন মেম্বার ১৩ লাখ করে টাকা দেন। এছাড়া সৌদি প্রবাসী আমার বেয়াই জালাল, আমি নিজে ও আমার এক ভাই সোহরাওয়ার্দীসহ তিনজনের কাছ থেকে নিয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ।

জাকিরের দেওয়া তথ্যে উদ্ধার করা মাইক্রোবাস

জাকির চেয়ারম্যান পারিবারিকভাবে রাজনীতি করতেন কি না জানতে চাইলে বাতেন মেম্বার বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে তাকে দেখিনি, তাকে চিনিও না, জানতামও না। ইউপি নির্বাচনের এক বছর আগে থেকে তার সঙ্গে পরিচয়। তাকে ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি এবং আমাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তাকে সভাপতি বানানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। থানা ও জেলা কমিটি তাকে ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি বানিয়েছে। থানা-জেলা কমিটি মনে করলে তাকে বহিষ্কার করতে পারে।

বাদ যাননি পুলিশ সদস্যও
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, আমার নামে তিনটি গাড়ি কেনা ছিল ৪৮ লাখ ৯০ হাজার টাকায়। গাড়ি কেনার প্রথম তিন মাস গাড়ি প্রতি ৬০ হাজার করে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন জাকির।

২০১৮ সালে চাকরি থেকে অবসরে যান এই পুলিশ সদস্য। ৪৮ লাখ টাকা তার পেনশন, জমি বিক্রি এবং স্ত্রীর আত্মীয়ের কাছ থেকে আনা টাকা বলে জানান।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে জাকিরের সঙ্গে পরিচয়। এরপর খোঁজ নিয়ে দেখি, আমাদের বেশকিছু পুলিশ সদস্য জাকিরের সঙ্গে গাড়ি ব্যবসা করছেন। জাকির নিজের মুখেই বেশকিছু পুলিশ কর্মকর্তার কথা বলেছিলেন।

জাকিরের প্রতারণার শিকারদের একজন মুন্সিগঞ্জের মো. সায়েম। ১৫ লাখ টাকায় দোকান বিক্রি করে সেই টাকায় গাড়ি কিনে জাকিরের হাতে তুলি দিয়েছিলেন। চুক্তি ছিল এই গাড়ি ভাড়া খাটিয়ে মাসিক ৭০ হাজার টাকা দেবেন জাকির। কিন্তু প্রথম মাসের ভাড়া দিয়ে সায়েমকে আর কোনো টাকা দেননি। শেষ পর্যন্ত নিজের গাড়িও ফেরত পাননি সায়েম।

সায়েম বলেন, এক বছর ভাড়া দেয়নি। টাকার জন্য চাপ দিলে সাড়ে সাত লাখ টাকার একটা চেক ধরিয়ে দেন। বাকি টাকা চাইলে মামলার হুমকি দিতেন।

একই গাড়ি প্রতারক জাকির ২৫ জনের কাছে বিক্রি করেছেন উল্লেখ করে সায়েম বলেন, পুলিশ প্রশাসন ও কয়েকজন সংসদ সদস্যও এই জাকির চেয়ারম্যানের ক্লায়েন্ট। তাদের দেখেই আমরা সাধারণ মানুষ আস্থার সঙ্গে রেন্ট-এ কার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলাম।

আরেকজন প্রতারণার শিকার মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি এলাকার সোহেল মোল্লা। তিনি বলেন, পুলিশের অনেক এসআই, ওসি দেখে আমি আস্থা পাই। বেশি মুনাফার লোভে সেখানে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দুটি গাড়ি কিনি। গাড়ি কেনার পর কয়েক দফায় সাড়ে সাত লাখ টাকা আমি পেয়েছি। বাকি টাকা আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে আর দেয়নি।

প্রতারণার শিকার আরেক ব্যক্তি মাসুম মোল্লা। তিনি রাজধানীর চাঁদনীচকে থ্রি-পিসের ব্যবসায়ী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ১৫ লাখ টাকায় একটা হায়েস গাড়ি কিনে রেন্ট-এ কারের ব্যবসায় চুক্তি করি মাসিক ৭০ হাজার টাকায়। এক বছরে মাত্র এক মাসের টাকা দিয়েছিলেন। এরপর টাকাও নেই, গাড়িও নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়েন্দা তেজগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. শাহাদাত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, চেয়ারম্যান জাকির হোসেন রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। এছাড়া জাকিরকে গ্রেফতারের কথা জানতে পেরে পাঁচ কোটি টাকা খোয়ানো কুয়েত প্রবাসী শফিকুল ইসলাম চৌধুরীসহ এমন একাধিক ভুক্তভোগী আমাদের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। সেগুলোও যাচাই-বাছাই চলছে। আত্মসাৎ করা টাকা জাকির কীভাবে, কোথায় খরচ করেছেন, কী কী সম্পদ গড়েছেন সব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এছাড়া তার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদেরও গ্রেফতার করা হবে।

প্রতারণা সম্পর্কে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, জাকির চেয়ারম্যান পোর্ট থেকে স্বল্প দামে গাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে টাকা নেন। কেনা গাড়ি রেন্ট-এ-কারের মাধ্যমে মাসিক ভাড়ায় পরিচালনা করতে একই গাড়ি দেখিয়ে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে চুক্তি করতেন।

‘একই রেজিস্ট্রেশন নম্বর সম্বলিত গাড়ি একাধিক জাল দলিলের মাধ্যমে বিক্রি করতেন জাকির। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে শুধু ইঞ্জিন নম্বর দিয়েই মাসিক কিস্তি পরিশোধের ভিত্তিতে চুক্তি করতেন। কিছুদিন পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ করার পর কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিতেন। এভাবে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।’

টিটি/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।