ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ও লিবরা ইনফিউশনের প্রতিবেদনে কারসাজি!
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস লি. এবং ওষুধ ও রসায়ন খাতের লিবরা ইনফিউশনের অার্থিক প্রতিবেদনে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। ফলে কোম্পানি দুটির আর্থিক প্রতিবেদন তদন্ত করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিএসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস লি. এবং লিবরা ইনফিউশন কোম্পানি দুটি তাদের ২০১৫-২০১৬ হিসাব বছরের অর্ধবার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে শেয়ার প্রতি আয়ে (ইপিএস) অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। এমন খবরে এ দুই কোম্পানির শেয়ার দর অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। তাই এখানে কারসাজি হয়েছে কি-না তদন্ত করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
সূত্রে আরও জানা যায়, এর মধ্যে ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (বিএএস) ৩৩ অনুযায়ী ইপিএস এবং বিএএস-১২ অনুযায়ী বিলম্বিত কর (ডেফার্ড ট্যাক্স) হিসাব করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই এ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে মঙ্গলবার বিএসইসি কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়েছে। অপরদিকে একই ইস্যুতে লিবরা ইনফিউশনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। তাই এ কোম্পানিকেও শিগগিরই কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হবে বলে জানিয়েছে বিএসইসি সূত্র।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, সম্প্রতি প্রকাশিত এ দুই কোম্পানি অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে তারা ইপিএসে অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। এমন খবরে কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরও বেড়েছে। তাই এখানে কোনো কারসাজি হয়েছে কি-না তদন্ত করে দেখা পাবে। তদন্তে কারসাজির প্রমাণ পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস : কোম্পানিটি ২০১৫-২০১৬ হিসাব বছরের অর্ধবার্ষিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন গত ১৭ জানুয়ারি প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছিল দশমিক ২০ টাকা এবং শেয়ার প্রতি নগদ কার্যকর প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) ছিল ৩৫ দশমিক ২৪ টাকা। কিন্তু অর্ধবার্ষিকের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির মুনাফায় উল্লম্ফন ঘটে। এসময় শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১০ দশমিক ৯৯ টাকা। যা এর আগের বছর একই সময়ে ছিল ১ দশমিক শূন্য ৪ টাকা।
অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় কোম্পানিটির ইপিএস ৯৫৭ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে অর্ধবার্ষিকে (জুলাই-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ১০ দশমিক ৭৯ টাকা। যা এর আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ১ দশমিক ৫৬ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় কোম্পানিটির ইপিএস ৫৯২ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু আলোচিত অর্ধবার্ষিকিতে এনওসিএফপিএস হয়েছে (০.৭১) টাকা।
এ প্রসঙ্গে ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে আমাদের পণ্য বিক্রির চুক্তি হয়েছে। তাই অর্ধবার্ষিকীতে আমাদের পণ্য বিক্রয় বেড়েছে। যার প্রভাব ইপিএসে এসেছে।
মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হওয়া সত্ত্বেও এ তথ্য জানানো হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, আমাদের এ চুক্তি কয়েক বছর আগে করা। সে সময় আমরা বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছি। এমনকি গত এজিএমেও এ বিষয়ে আমাদের শেয়ারহোল্ডারদের অবহিত করা হয়েছে।
এদিকে ইপিএসে এমন উল্লম্ফনের খবরে কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৫২ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৩০০ টাকা। পরের প্রত্যেক কার্যদিবস কোম্পানিটির শেয়ারদর ৮-৯ শতাংশ হারে বেড়েছে। আর এতে গত ১২ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার ৭৫৫ দশমিক ৯০ টাকা হয়েছে। এ সময় কোম্পানিটির মোট ৯ কোটি ৫৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার এক লাখ ৫১ হাজার ৪০০টি শেয়ার এক হাজার ৯৭১ বার হাতবদল করে।
উল্লেখ্য, এক কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানির ৫১ শতাংশ শেয়ার সরকারের কাছে, ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে এবং ১৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ শেয়ার সাধারন বিনিয়োগকারীর কাছে রয়েছে। এছাড়া গত ছয় বছর ধরে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ৩০ শতাংশ করে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়ে আসছে।
লিবরা ইনফিউশন : কোম্পানিটি ২০১৫-২০১৬ হিসাব বছরের অর্ধবার্ষিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন গত ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছিল ৭ দশমিক ৬৬ টাকা এবং শেয়ার প্রতি নগদ কার্যকর প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) ছিল (দশমিক ৯০) টাকা। কিন্তু অর্ধবার্ষিকির শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফায় উল্লম্ফন ঘটে। এসময় শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৮ দশমিক ১৪ টাকা। যা এর আগের বছর একই সময়ে ছিল দশমিক ৩০ টাকা।
অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় কোম্পানিটির ইপিএস ২ হাজার ৬১৩ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে অর্ধবার্ষিকে (জুলাই-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ২ দশমিক ৬৯ টাকা। যা এর আগের বছর একই সময়ে ইপিএস ছিল ১ দশমিক ৬৯ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় কোম্পানিটির ইপিএস ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু আলোচিত অর্ধবার্ষিকীতে এনওসিএফপিএস হয়েছে ৪৩ দশমিক ৫০ টাকা।
এ প্রসঙ্গে কোম্পানির বক্তব্য জানতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে ইপিএসে এমন উল্লম্ফনের খবরে কোম্পানিটির শেয়ারদর ৯৪ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ৩০০ টাকা। সর্বশেষ ১০ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ার দর উঠে এসেছে ৫৮২ দশমিক ৫০ টাকায়। এ সময়ে কোম্পানিটির মোট ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকার ৬৩ হাজার ৭২৭টি শেয়ার ৫৭০ বার হাতবদল করে।
এদিকে, আল-আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক কম্পোজিট বিনিয়োগ সুবিধার আওতায় লিবরা ইনফিউশনকে ঋণ দেয়। কিন্তু কোম্পানিটি ব্যাংককে ঋণের কোনো কিস্তিই পরিশোধ করেনি। পরিণতিতে ১৮ আগস্ট ২০১৫ তারিখ পর্যন্ত আসল, মুনাফা ও অন্যান্য চার্জসহ কোম্পানির কাছে আরোপিত কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ৫২ হাজার ৩৩১ টাকা পাওনা রয়েছে ব্যাংকের। তাই এই ঋণের বিপরীতে দেয়া বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংক তার খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ সমন্বয় করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আদালতে কোম্পানিটির করা এক রিটের কারণে বিষয়টি স্থগিত রয়েছে।
উল্লেখ্য, এক কোটি ২৫ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানির ৪৮ দশমিক ২৮ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা ও পরিচালকের কাছে, ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে এবং ৪৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে রয়েছে। এছাড়া গত ছয় বছর ধরে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের ২০ শতাংশ করে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়ে আসছে।
এসআই/বিএ