শহীদ মতিউর পার্ক

এক সময়ের উন্মুক্ত পার্কে ঢুকতে এখন গুনতে হয় টাকা

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০৮:০৮ পিএম, ২৮ নভেম্বর ২০২২
শহীদ মতিউর পার্কে প্রবেশ করতে টিকিট সংগ্রহ করছেন দর্শনার্থীরা-ছবি জাগো নিউজ

রাজধানীর গুলিস্তানের শহীদ মতিউর পার্ক। এর উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে রয়েছে তিনটি গেট। প্রতিটি গেটের সামনে বসানো টেবিল-চেয়ার। সেখানে বিক্রি হচ্ছে টিকিট। দাম ১০ টাকা। টিকিট ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ এই পার্ক আগে সবার জন্য ছিল উন্মুক্ত। যে কেউ বেড়ানোর সুযোগ পেতেন। সকাল-বিকেল খেলাধুলা করতো শিশু-কিশোররা। শুধু তাই নয়, পার্কে এখন বসেছে রাইড। এজন্যও গুনতে হয় আলাদা টাকা। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয়দের অনেকেই পার্কটিতে বেড়ানো বন্ধ করে দিয়েছেন। পথশিশুদের জন্য পার্কে প্রবেশ করা তো এখন স্বপ্ন।

শহীদ মতিউর পার্কটি মূলত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সম্পত্তি। এটি ডিএসসিসির ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। পার্কের একটি বড় অংশে ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ। বর্তমানে পার্কটি ইজারা দেওয়া হয়েছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দর্শনার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ডিএসসিসি একটি সেবা সংস্থা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। নাগরিকদের বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে সেবা দেওয়া সংস্থাটির কাজ। কিন্তু তারা তা না করে পার্কটি ইজারা দিয়েছে। এতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ সংরক্ষিত করেছে ডিএসসিসি। এখন যাদের সাধ্য আছে তারাই পার্কে ঢুকতে পারছেন।

তবে ডিএসসিসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালে ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে শহীদ মতিউর পার্কটির আধুনিকায়ন করা হয়। তখন চারপাশের দেওয়াল সরিয়ে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয় পার্ক। এতে ভাসমান লোকজন পার্কটিতে বিশ্রাম এবং পুকুরে গোসল করতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে পার্কটি তার সৌন্দর্য হারায়। পরে এর চারপাশে লোহার গ্রিল দেওয়া হয়। এছাড়া পার্কটি রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনায় দেওয়া হয় ইজারা।

jagonews24

পার্কের রাইডে চড়তে গুনতে হয় টাকা-ছবি জাগো নিউজ

কিন্তু এই ইজারার মাধ্যমে নগরের মানুষের প্রবেশ কেন সংরক্ষিত করা হয়েছে, তার উত্তর দিতে পারেননি ডিএসসিসি সংশ্লিষ্টরা।

ডিএসসিসির প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, ২০২০ সালের মে মাসে মেয়রের দায়িত্ব নেন শেখ ফজলে নূর তাপস। এরপর তিনি সংস্থাটির রাজস্ব আয় বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। তারই অংশ হিসেবে চলতি বছরের (২০২২ সাল) ১ মার্চ শহীদ মতিউর পার্কটি ২০ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। ইজারা নেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের নেতা মো. অলি উল্লাহ।

পরে তারা পার্কের ভেতর প্রায় ১৫টি রাইড এবং খাবারের দোকান বসান। গত মে মাসে পার্কের বড় একটা অংশে মৌসুমি ফলের আড়তও বসিয়েছিলেন ইজারাদার। এজন্য ডিএসসিসি এক চিঠিতে তাকে সতর্কও করে। এখন দ্বিতীয় মেয়াদে পার্কটি ইজারা নিতে চেষ্টা করছেন অলি উল্লাহ।

jagonews24

টিকিট বিক্রি করতে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে আছেন এক নিরাপত্তাকর্মী

পার্কের অবস্থা দেখতে গত শুক্রবার দুপুর ১২টায় গুলিস্তান যান এই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, টিকিট ছাড়া কাউকে পার্কে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। যারা টিকিট কেটে ঢুকছেন, তারা আবার বিভিন্ন রাইডের জন্য আলাদা টিকিট কাটছেন। কেউ ফুড কোর্টে বসে খাবার খাচ্ছেন। তবে পার্কের অন্য স্থান, বিশেষ করে পুকুর পাড়ে ময়লা-আবর্জনা পরে থাকতে দেখা গেছে। পুকুরের পানিও ধারণ করেছে কালচে রং।

এর মধ্যে দুপুর সাড়ে ১২টায় পার্কের দক্ষিণ গেটে দেখা মিললো নয় বছর বয়সী পথশিশু জাবেরের। সে বিনামূল্যে পার্কে ঢোকার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাকে ঢুকতে দেননি নিরাপত্তাকর্মী ফারুক। গেটে দুই ঘণ্টা অবস্থান করে এমন ৮-৯ জন পথশিশুকে ফিরে যেতে দেখা গেছে।

জাবের জানায়, তারা আগে পার্কে রাতদিন দৌড়াদৌড়ি করতো। কিন্তু এক বছর ধরে টাকা ছাড়া পার্কে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। যেদিন পকেটে টাকা থাকে, সেদিন ঢুকতে বাধা দেয় না।

জাবেরকে পার্কের গেট থেকে ফিরে যেতে হলেও ওয়ারীর বাসিন্দা শামিম তালুকদারের ছেলে-মেয়েকে ফিরে যেতে হয়নি। তারা টিকিট কেটে পার্কে প্রবেশ করেছে। এছাড়া আরও ৫০ টাকা দিয়ে পুকুরে প্যাডেল বোটেও চড়েছে।

jagonews24

পার্কে রয়েছে বিভিন্ন রাইড, যাতে চড়তে লাগে টাকা

আলাপকালে শামিম তালুকদার বলেন, বাচ্চারা সারাদিন ঘরবন্দি থাকে। তাদের জন্য খেলাধুলার পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তাই এই পার্কে বেড়াতে এসেছি। তবে এখানে বিভিন্ন রাইডের ফি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পার্কের চেয়ে বেশি। অথচ সিটি করপোরেশন মালিকানাধীন এই পার্কে প্রবেশ এবং বিভিন্ন রাইডের মূল্য কম হওয়া দরকার ছিল।

শামিম তালুকদারের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন পাশে থাকা আরেক দর্শনার্থী কামাল হোসেন বলেন, সংস্কারের নামে চার বছরের বেশি সময় ধরে শাহবাগের শিশুপার্ক বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আগে সেই পার্কে শিশুদের জন্য নামমাত্র মূল্যে বিভিন্ন রাইড ব্যবহারের সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন শহীদ মতিউর পার্কে যেকোনো রাইডে উঠলেই ৫০ টাকা করে দিতে হবে। এখানে সিটি করপোরেশনের কোনো তত্ত্বাবধান নেই।

জানতে চাইলে ইজারাদার মো. অলি উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, দিনে ২০০-২৫০ জন মানুষ পার্কে ঢোকেন টিকিট কেটে। শুক্রবার দর্শনার্থীদের সংখ্যা আরও বাড়ে। তবে পার্কটি পরিচালনায় যে পরিমাণ খরচ, তা ওঠে না। তাই টিকিট ও রাইডের মূল্য কমানোর সুযোগ নেই। আর ভাসমান লোকজনদের ফ্রিতে পার্কে ঢুকতে দিলে সাধারণ দর্শনার্থীদের বিরক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। ভবিষ্যতে পার্কে দর্শনার্থীদের সংখ্যা আরও বাড়লে টিকিট ও রাইডের মূল্য কমানো হবে।

jagonews24

শহীদ মতিউর পার্কের পুকুর

নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের এমন বাণিজ্যিক কার্যক্রম ঠিক নয়। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, সেবা সংস্থা হিসেবে সিটি করপোরেশনের উচিত নগরের প্রতিটি পার্ক-মাঠ নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা। নৈতিকভাবে কোনো পার্ক বাণিজ্যিক ব্যবহার এবং এতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ সংরক্ষিত করতে পারে না সিটি করপোরেশন। এইধরনের পাবলিক স্পেস ইজারা দিয়ে মানুষের প্রবেশাধিকার ক্ষুণ্ণ করা অন্যায্য।

তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনকে সব সময় জনগণের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করতে হবে। পার্ক ইজারা না দিয়ে নিজস্ব লোকবল দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। এতে নগরের মানুষ সুফল পাবে।

স্থানীয় কাউন্সিলর এনামুল হক বলেন, আগে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। যে কেউ চাইলে ঢুকতে পারতেন। কিন্তু এতে পার্কে অপরাধ, অসামাজিক কাজ বেড়ে যায়। তাই পার্কটি ইজারা দিয়েছে সিটি করপোরেশন। তবে টিকিট কেটে পার্কে ঢুকতে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, পার্কটি সংস্কারের পর তা সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। সেখানে ভাসমান লোকজন বসতি গড়ে তুলেছিল। তাই পার্কটি ইজারা দেওয়া হয়েছে।

এমএমএ/জেডএইচ/এসএইচএস/এমএস

সেবা সংস্থা হিসেবে সিটি করপোরেশনের উচিত নগরের প্রতিটি পার্ক-মাঠ নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা। নৈতিকভাবে কোনো পার্ক বাণিজ্যিক ব্যবহার এবং এতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ সংরক্ষিত করতে পারে না সিটি করপোরেশন। এ ধরনের পাবলিক স্পেস ইজারা দিয়ে মানুষের প্রবেশাধিকার ক্ষুণ্ণ করা অন্যায্য।

সংস্কারের নামে চার বছরের বেশি সময় ধরে শাহবাগের শিশুপার্ক বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আগে ওই পার্কে শিশুদের জন্য নামমাত্র মূল্যে বিভিন্ন রাইড ব্যবহারের সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন শহীদ মতিউর পার্কে যেকোনো রাইডে উঠলেই ৫০ টাকা করে দিতে হবে। এখানে সিটি করপোরেশনের কোনো তত্ত্বাবধান নেই।

দিনে ২০০-২৫০ জন মানুষ পার্কে ঢোকেন টিকিট কেটে। শুক্রবার দর্শনার্থীদের সংখ্যা আরও বাড়ে। তবে পার্কটি পরিচালনায় যে পরিমাণ খরচ, তা ওঠে না। তাই টিকিট ও রাইডের মূল্য কমানোর সুযোগ নেই। ভাসমান লোকজনদের ফ্রি পার্কে ঢুকতে দিলে সাধারণ দর্শনার্থীদের বিরক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। ভবিষ্যতে পার্কে দর্শনার্থীদের সংখ্যা আরও বাড়লে টিকিট ও রাইডের মূল্য কমানো হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।