জয়পুরহাটে হত-দরিদ্রদের ঘরে আলো জ্বালানো লিখন আপা


প্রকাশিত: ০৯:০৫ এএম, ০৮ মার্চ ২০১৬

জয়পুরহাটে স্বাধীনতার ৪৫ বছর বিদ্যুৎ বিহীন অসহায় ও দরিদ্র পরিবারগুলোতে বিনা মূল্যে সৌর বিদ্যুতের আলো জ্বালিয়ে কতগুলো মলিন মুখের নির্জলা প্রশান্তি এনে দিলেন এক অদম্য সংগ্রামী নারী মেফতাহুল জান্নাত লিখন। একইসঙ্গে ওই অসহায় পরিবারের স্কুল গামী শিশু-কিশোরদের রাত্রীকালীন লেখাপড়াসহ তাদের শিক্ষা উপকরণ ও মাতৃস্নেহ দিয়ে এলাকায় সমাজের অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছেন এই মহীয়সী নারী।

থাকব পাশে, বাসব ভালো, দেখাব আলোর পথ’, এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে মেফতাহুল জান্নাত লিখন এগিয়ে চলছেন আগামীর পথে।

জানা গেছে, মেফতাহুল জান্নাত লিখন জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের বানদিঘী গ্রামের অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে। মাত্র সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন তিনি। তারপর বাল্য বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। গরীব আর অসহায়দের জন্য কিছু করার চিন্তা ভাবনা ছিল ছোট বেলা থেকেই। বর্তমানে জয়পুরহাট শহরের ইরাক নগর এলাকায় স্বামী ও এক সন্তানকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার।  

Joypurhat-likhon

অদম্য শক্তির উপর ভর করেই তিনি গড়ে তোলেন সৌর শক্তির একটি প্রতিষ্ঠান। মেঘা সুপার পাওয়ার নামে তার সেই সৌর শক্তির ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি শুধু তার রোজগারের পথই নয়, ব্যবসার পাশাপাশি লাভের একটি অংশ খরচ করে চলেছেন আর্তমানবতার সেবায়। মেফতাহুল জান্নাত তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সৌর শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ বিহীন হত দরিদ্রদের ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর  ধরে যে পরিবারগুলো শুধু অর্থের অভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারেননি এমন দেড় শতাধিক পরিবারকে বিদ্যুতের আওতায় এনেছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে জয়পুরহাট সদর উপজেলার তেঘর রেল-বস্তি, মাস্টার পাড়া, শান্তিনগর গ্রামের ১১ টি পরিবার এবং পাঁচবিবি উপজেলার খাসবাট্টা আদিবাসী পল্লী ও রসুলপুর গ্রামের ১০০টি পরিবারে এখন জ্বলছে লিখনের সৌর শক্তির বিদ্যুৎ।

likhon

অন্যদিকে রাতে এই গরীব পরিবারের যে অসহায় সন্তানরা আলোর অভাবে এতোদিন পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেনি ঠিকমত, সেই শিশু কিশোররাও নৈশকালীন লেখাপড়া করে যাচ্ছেন স্বাভাবিক ভাবে। এখন প্রচণ্ড গরমেও এসব পরিবারগুলোর কোনো কোনোটিতে আবার ঘুরছে সৌরশক্তির বিদ্যুৎ চালিত পাখা। শুধু তাই নয় দরিদ্র শিশু-কিশোরদের প্রতি মাতৃস্নেহ আর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে বিনা মূল্যে দান করেছেন খাতা, কলমসহ আনুষঙ্গিক শিক্ষা সামগ্রী।

তেঘর রেল-বস্তির বেলাল হোসেন, খাসবাট্টা গ্রামের ইউসুফ আলী ও রসুলপুর গ্রামের এনায়েত হোসেন জানান, কত জন প্রতিনিধি ভোটের সময় কত কথা দিয়ে গেছেন, তার হিসাব করা না গেলেও তাদের সেই নির্বাচনী ওয়াদা তারা পূরন করতে পারেননি, কিন্তু লিখন আপা কোনো চেয়ারম্যানও না, কোনো মেম্বারও না, আমাদের মত গরীব মানুষদের বিনা টাকায় সৌর বিদ্যুৎ দিলেন, তা নাহলে আরো ৪৫ বছরেও হয়ত আমাদের ঘরে আলো জ্বলতো না।

একই কারণে মেফতাহুল জান্নাত লিখন শুধু তাদেরই নন, তাদের সন্তানদেরও ‘আপা’। মাস্টার পাড়ার ৯ম শ্রেণির মিনতি রাণী, দানেজপুর আদিবাসী পল্লীর ৯ম শ্রেণির ফাতেমা খাতুন বলেন, এই সব পরিবারের মা বাবাদের মত তাদের সন্তানরাও বলল লিখন আপার জন্য আমরা রাতে পড়তে পারছি।

দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য এমন অকৃপণ ভালোবাসায় মুগ্ধ বিশিষ্ট জনরা। জয়পুরহাট জেলা পরিষদ প্রশাসক এস এম সোলায়মান আলী বিষয়টিকে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেন।

Joypurhat

অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিহীন দীর্ঘ সময় অসহনীয় দূর্ভোগ আর কষ্টে থাকা হতদরিদ্র মানুষগুলো বিনামূল্যে সৌর শক্তির বিদ্যুৎ পেয়ে ভাসছেন আনন্দে। স্বাধীনতার এতোগুলো বছর পর বিদ্যুৎ পাওয়ায় এই ভালোবাসাকে মহান স্বাধীনতার প্রতি উৎসর্গ করেছেন স্বেচ্ছাসেবী এই তরুনী ও অবহেলিত গ্রামবাসী। তাই সৌরশক্তি চালিত এই গ্রামগুলোর তারা নাম দিয়েছেন জয়বাংলা সোলার গ্রাম।

পাঁচবিবি উপজেলার খাসবাট্টা গ্রামের সৌর বিদুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত কেরামত আলী জানান, লিখন আপার অবদানে আমরা পেয়েছি বিদ্যুতের মত অতি প্রয়োজনীয় ও জনগুরুত্বপূর্ন একটি জিনিস।

মেফতাহুল জান্নাত লিখন জানান, ব্যবসায়ীক লাভের একটি অংশ দিয়ে এ যাবত মাত্র দেড়শো পরিবারকে বিদ্যুত সুবিধা দিতে পেরেছি, এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মেঘা সুপার পাওয়ার নামক আমার ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুঃস্থদের সাধ্যমত সহায়তা করে যাচ্ছি। এসময় আজীবন অসহায়দের প্রতি এমন সহায়তা চালিয়ে যাওয়ারও অঙ্গিকার করেন তিনি।

তবে এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস নেই বলে সুস্পস্ট করে তিনি বলেন, সদেচ্ছা থাকলে যে কোনো অবস্থান থেকে মানুষের জন্য কিছু করা যায়।

এফএ/এএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।