অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত ডিজিটাল ভূমি জরিপ, পৌনে ৪ কোটি টাকা গচ্চা

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:১৮ পিএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হলো ডিজিটাল ভূমি জরিপ কাজের একটি প্রকল্প। সাড়ে তিন বছরে ‘ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতিতে হতাশ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি। প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ১২শ ১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। জুন, ২০২৩ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এ অবস্থায় নতুন করে সময় ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। তবে তা না বাড়িয়ে সর্বসম্মতিক্রমে চলতি প্রকল্পের সমাপ্তি ঘোষণা করে নতুন প্রকল্প প্রস্তাব দিতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একে এম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়। সভায় প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে নতুন প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। এতে ব্যয় হওয়া ৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকার পুরোটাই গচ্চা গেলো সরকারের।

সমগ্র বাংলাদেশে দক্ষভাবে জরিপ পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে 'বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে' প্রোগ্রাম মূলত দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে সম্পাদন করা হচ্ছে। এর একটি ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প’ এটা অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্তের পথে।

অপরটি হচ্ছে ‘ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপের মাধ্যমে ৩টি সিটি করপোরেশন, ১টি পৌরসভা এবং ২টি গ্রামীণ উপজেলার ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি স্থাপন প্রকল্প’। দ্বিতীয় প্রকল্পটি দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ৫টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ভূমি মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করছে।

আরও পড়ুন>> চট্টগ্রাম বন্দর/আধুনিক যন্ত্রপাতিতে জাহাজের ওয়েটিং টাইম কমবে ১২ ঘণ্টা

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বিগত সাড়ে তিন বছরে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ০ দশমিক ২৮ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রকল্পের কোনো কার্যক্রম শুরুই করা হয়নি, যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। পিইসি সভার আলোকে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পের কাজ অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করাসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা জুন, ২০২২-এর ১৮.২ নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনায় যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষাপূর্বক নতুন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনে অবিলম্বে পাঠাতে বলা হয়েছে। ডিজিটাল জরিপ কাজ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, আইটি সরঞ্জামাদি সংগ্রহে যাচাই-বাছাই কমিটিতে তথ্য ও যোগাযোগ বিভাগের উপযুক্ত প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেহেতু বিগত সাড়ে তিন বছরে প্রকল্পের কোনো কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়নি এবং প্রকল্প এলাকা ও প্রকল্পের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে কম-বেশি হয়েছে, সেহেতু প্রকল্পের মেয়াদ আরও চার বছর বাড়ানোর প্রস্তাব যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পরিবর্তে ওই মেয়াদে নতুন প্রকল্প নেওয়া সমীচীন বলে মনে করে কমিশন।

সাড়ে তিন বছরে টাকাই ব্যয় করতে পারেনি। প্রকল্পের অগ্রগতিও নেই। নতুন করে প্রকল্পের সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছিল। তাই আমরা সুপারিশ করেছি প্রকল্প সংশোধন না করে নতুন করে নেওয়া হোক। যেহেতু প্রকল্পটি সবুজ পাতায় রয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়িয়ে ওই মেয়াদে নতুন প্রকল্প নেওয়া সমীচীন।- পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একে এম ফজলুল হক

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একে এম ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাড়ে তিন বছরে টাকাই ব্যয় করতে পারেনি। প্রকল্পের অগ্রগতিও নেই। নতুন করে প্রকল্পের সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছিল। আমরা সুপারিশ করেছি প্রকল্প সংশোধন না করে নতুন করে নেওয়া হোক। যেহেতু প্রকল্পটি সবুজ পাতায় রয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়িয়ে ওই মেয়াদে নতুন প্রকল্প নেওয়া সমীচীন।’

আরও পড়ুন>> লেখক তৈরি ও প্রকাশনায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকা চায় বাংলা একাডেমি

পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা যায়, প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অনুদানে মোট ১ হাজার ২১২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫ মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন। মূল প্রকল্পটি ১৪ জুলাই ২০২০ তারিখে একনেক থেকে অনুমোদিত হয়। পরবর্তীসময়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ২ নভেম্বর ২০২১ তারিখে প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে কোড সংশোধন ও আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় প্রস্তাব অনুমোদন করেন। মূল প্রকল্পে আটটি বিভাগে ৬১টি জেলার ৪৭০টি উপজেলায় ২ লাখ ৬০ হাজার ৩৬৯টি জিওডেটিক কন্ট্রোল পিলার স্থাপনসহ পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার ১৪টি উপজেলায় ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ভূমি জরিপ কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বর্তমানে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৫ এর পরিবর্তে জুলাই ২০২০ থেকে জুন ২০২৭ পর্যন্ত নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা যুক্তিসঙ্গত মনে করেনি কমিশন।

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বর্তমানে প্রকল্প বাস্তবায়ন পদ্ধতি আমূল পরিবর্তন করে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবলের পরিবর্তে বেসরকারি ভূমি জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে জরিপ কাজ সম্পাদনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা পরামর্শক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খাতে ব্যয় হবে। বেসরকারি খাতে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে উপযুক্ত জনবল পাওয়া যাবে কি না তার সম্ভাব্যতা বিষয়ে সমীক্ষা প্রয়োজন। প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনায় যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষাপূর্বক নতুন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করে অবিলম্বে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর বিষয়ে সভায় একমত প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন>> কেনার কথা ছিল মরদেহবাহী গাড়ি, কেনা হলো মাইক্রোবাস

প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে জরিপকাজ সম্পাদনের জন্য বহুসংখ্যক যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেহেতু বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সার্ভে কাজ সম্পাদন করা হবে সেহেতু এত যন্ত্রপাতি কেনার যৌক্তিকতা জানতে চায় কমিশন। এত ব্যাপক সংখ্যায় যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা হবে কি না এবং এ বাবদ বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে কি না সে বিষয়ে প্রকল্পে উল্লেখ নেই বলে জানানো হয়।

আমরা প্রকল্পের ফিজিবিলিটি টেস্ট করছি। এর পরে নতুন করে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) সংশোধন করা হবে। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির রিপোর্ট হাতে এলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।- ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর পরিচালক (ভূমি রেকর্ড) মো. মোমিনুর রশীদ

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর জানায়, প্রকল্পের শুরুতে কোভিড- ১৯ অতিমারির কারণে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম যথাসময়ে শুরু করা সম্ভব হয়নি। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের জনবল সংকটের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব, প্রকল্প এলাকা হ্রাস-বৃদ্ধি, প্রকল্পের কার্যক্রম পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে প্রকল্পের প্রথম সংশোধন প্রয়োজন। পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বিষয়ে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করছে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির রিপোর্ট হাতে এলেই নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর পরিচালক (ভূমি রেকর্ড) মো. মোমিনুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রকল্পের ফিজিবিলিটি টেস্ট করছি। এর পরে নতুন করে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) সংশোধন করা হবে। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির রিপোর্ট হাতে এলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর ১৮৮৮ সাল থেকে ম্যানুয়ালি ভূমি রেকর্ড ও জরিপের কাজ পরিচালনা করে আসছে। দেশব্যাপী এ পর্যন্ত দুটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বা সিএস (১৮৮৮- ১৯৪০) ও স্টেট অ্যাকুইজিশন সার্ভে বা এসএ (১৯৫৬-১৯৬৩) কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে রিভিশনাল সার্ভে (আরএস) ১৯৬৫ সাল থেকে শুরু হয়ে এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশ সার্ভে (বিএস) জরিপ কার্যক্রম চলমান। শতবর্ষের পুরোনো ম্যানুয়াল পদ্ধতি অনুসরণে জরিপ করার কারণে মৌজা ম্যাপ নকশা ও রেকর্ড খতিয়ান প্রস্তুতে অনেক বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। ফলে স্বত্বলিপির চূড়ান্ত প্রকাশনা দিতে প্রায় কয়েক দশক লেগে যায় এবং এসব জরিপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ ও রেকর্ডের সংরক্ষণ জটিল হয়ে পড়ে।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সারাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন ও অটোমেশন করতে ভূমি মন্ত্রণালয় বাস্তবায়নাধীন ‘মৌজা ও প্লটভিত্তিক জাতীয় ডিজিটাল তুমি জোনিং’ শীর্ষক প্রকল্প থেকে আরএস জরিপের ডিজিটালাইজড মৌজা ম্যাপ প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় জিওডেটিক সার্ভের মাধ্যমে জিও-রেফারেন্স করা হয়। জিও-রেফারেন্স করা মৌজা ম্যাপ ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন’ শীর্ষক প্রকল্পে সরবরাহ করার লক্ষ্যেই মূলত প্রকল্পটি নেওয়া হয়।

এমওএস/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।