কেনার কথা ছিল মরদেহবাহী গাড়ি, কেনা হলো মাইক্রোবাস

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৪৭ এএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪
মাইক্রোবাস/সংগৃহীত

হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য প্রকল্পের আওতায় একটি মরদেহবাহী গাড়ি কেনার অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) স্পষ্টভাবে নির্দেশনা ছিল মরদেহ পরিবহনের জন্য একটি গাড়ি কিনতে হবে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, কেনা হয়েছে একটি মাইক্রোবাস। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পরিদর্শন শেষে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলেছে।

‘গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন’ প্রকল্পের আওতায় এমনটি ঘটেছে। আইএমইডির পরিচালক খলিল আহমেদ চলমান প্রকল্প যাচাইয়ে ২০২৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।

আইএমইডি জানায়, ডিপিপি যেভাবে অনুমোদন করা হয়েছে সেভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। মরদেহবাহী গাড়ির জায়গায় মাইক্রোবাস কেনা যায় না। বিষয়টির নিষ্পত্তি প্রয়োজন। সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ ও সংশোধন নির্দেশিকা জুন ২০২২ এর অনুচ্ছেদ ৪.১.৪ এর বিধান মোতাবেক পোস্ট ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল (Post Facto Approval) দেওয়া যাবে না। ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি সুরাহা করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি।

আরও পড়ুন>> হাসপাতাল নির্মাণে ৩৩ লাখ টাকা সম্মানী ভাতা আবদার, কমিশনের বাগড়া

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিপিপিবহির্ভূত কোনো কাজ বাস্তবায়ন করতে হলে ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। ডিপিপিতে নির্দেশনা মরদেহবাহী গাড়ি কিনতে হবে, এখানে মাইক্রোবাস কেনার সুযোগ নেই। তাই আমাদের সুপারিশ সংশ্লিষ্টদের পাঠিয়েছি। ৩০ জানুয়ারির মধ্যে এ বিষয়ে আইএমইডিকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।’

আইএমইডি পর্যবেক্ষণ প্রকল্পটি ২০১৮ সালে একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয় ৯২৪ কোটি টাকা, যার পুরোটাই সরকারি অর্থায়ন। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয় ফেব্রুয়ারি ২০১৮ থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত। পরবর্তীসময়ে প্রকল্পটি একবার সংশোধন করে ব্যয় ধরা হয় ৮৩৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা এবং সমাপ্তির জন্য নির্ধারণ করা হয় জুন ২০২২। পরে আরও দুবার ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়ে সমাপ্তির জন্য নির্ধারণ করা হয় জুন ২০২৪ পর্যন্ত। বর্তমানে প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৯৩ দশমিক ০৩ শতাংশ।

প্রকল্পে ব্যবহৃত পণ্য/উপকরণ

এমএস রড, বালি, সিমেন্ট, স্টোনচিপস, ইট ইত্যাদি। সব পণ্যের গুণগতমান যাচাই করা হচ্ছে না বলে উঠে এসেছে আইএমইডি প্রতিবেদনে। প্রকল্পে ব্যবহৃত ইট ও খোয়া টেস্টের জন্য গালাই করে ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন>> প্রচলিত কাজেও প্রশিক্ষণ-পরামর্শক রাখার প্রস্তাব, ব্যয় ৩৪২ কোটি

আইএমইডি প্রতিবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের যুগ্মসচিব (পরিকল্পনা অধিশাখা) ড. সৈয়দা সালমা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এখানে মাত্র জয়েন করেছি। বিষয়টি এখনো জানি না।’

হাসপাতাল ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজ

আইএমইডি সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখতে পায়, হাসপাতালের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজ শেষ। অর্থাৎ, ভবনের আট তলা থেকে ১৫ তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে নবম তলায় ডায়ালাইসিস রুমের ক্যাডডোরের প্লাস্টার ফিনিশিং দেওয়া হয়নি। ১২ তলায় মেডিসিন ওয়ার্ডের প্লাম্বিং ফিটিংস ঠিকভাবে জোড়া না লাগার কারণে পানি চুইয়ে পড়ছে এবং ভবনে ড্যাম পড়ে যাচ্ছে। ছাদের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে শ্যাওলা পড়েছে। অনেক জায়গায় থাই জানালাগুলো ঠিকভাবে না লাগার কারণে বাইরে থেকে বৃষ্টির পানি রুমে প্রবেশ করছে। জানালার লকগুলো ঠিকাদারের মাধ্যমে পরিবর্তন করে নেওয়া দরকার।

একাডেমিক ভবনের কাজ

ভবনটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর উদ্বোধন করলেও ফিনিশিংসহ অনেক কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। কাজগুলো জরুরিভিত্তিতে করা প্রয়োজন। নিচতলায় বেশ কিছু কাঠের চৌকাঠের পুরুত্ব পরিমাপ করে স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পাওয়া যায়নি। সেগুলো স্তূপ করে রাখা হয়েছে।

মরদেহবাহী গাড়ির নির্দেশনা, কেনা হলো মাইক্রোবাস!
মরদেহবাহী গাড়ি

দায়িত্বরত প্রকৌশলী আইএমইডিকে জানান, এগুলো রিজেক্ট করা হয়েছে। ঠিকাদার সরিয়ে নেবেন। তবে কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো মালামাল বাতিল করা হলে অবশ্যই তাতে লাল রং দিয়ে ক্রস চিহ্ন দিতে হয়। ভবিষ্যতে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ভবনের ইলেকট্রিকসহ লিফট-জেনারেটরের কাজ আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

মহিলা হোস্টোলের কাজ

আইএমইডি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভবনের ভৌত কাজ প্রায় ৮৫ শতাংশ সম্পন্ন। কাজের গতি আরও ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। ভবনটির সামনে কিছু কোম্পানির পাইপ স্তূপাকারে রাখা আছে। এগুলো ভবনে ব্যবহার করা হবে। হাতিম কোম্পানির প্রায় ৯০ শতাংশ পাইপ এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাইপগুলোর জরুরি ল্যাব টেস্ট করা প্রয়োজন। এছাড়া ভবনের সামনে গাঁথুনির জন্য স্তূপাকারে অনেক ইট রাখা আছে। আপাতভাবে ইটগুলোর প্রায় ২০ শতাংশ নিম্নমানের বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী বলেন, এগুলো গ্রেডিং করা হয়নি। গ্রেডিং করে নিম্নমানেরগুলো অপসারণ করা হবে। ইটের গুণগতমান নিশ্চিতের জন্য সিলগালা করে ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুন>> দ্রুত এগোচ্ছে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর কাজ, ২০২৪ সালেই উদ্বোধন

ড্রোন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে দেখা যায়, প্রায় ২০ ফুটের মতো বাউন্ডারি ওয়াল দেওয়া হয়নি। জানা যায়, স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী তাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ওয়াল তৈরির কাজে বাধা দিচ্ছেন। কিন্তু হাসপাতালের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে এ বাউন্ডারি ওয়ালের প্রয়োজন। তাই স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় বাউন্ডারি ওয়ালটি করে নিতে হবে।

কর্মচারীদের কোয়ার্টারের কাজ

এখানে প্রতিটি রুম ৮০০ বর্গফুট ধরা আছে। ভবনের কাজের অগ্রগতি ৪৫ শতাংশ। জানা যায়, বাবর অ্যাসোসিয়েটস ও নূরানী কনস্ট্রাকশন জেভিতে কাজটি করে যাচ্ছে। কাজের গতি খুব ধীর। অধিক লোকবল নিয়োগ করা না হলে কাজটি জুন ২০২৪ এর মধ্যে সমাপ্ত হবে না।

শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন (গাজীপুর) প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদন দেয় একনেক। মূল প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯২৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় সাত তলা হাসপাতাল ভবনকে ১৫ তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ, কলেজের একাডেমিক ভবন ও শিক্ষার্থীদের জন্য ডরমিটরি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল। জুন ২০২১ সালে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। পরে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সাল নাগাদ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্পের ব্যয় কমে ৮৩৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।

এমওএস/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।