এমপি আনোয়ারুল খুন

বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে কি?

ইসমাইল হোসাইন রাসেল
ইসমাইল হোসাইন রাসেল ইসমাইল হোসাইন রাসেল
প্রকাশিত: ০৯:৪১ পিএম, ২৩ মে ২০২৪

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খুন হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম। প্রতিবেশী দেশের একজন এমপির এ হত্যাকাণ্ডে নড়েচড়ে বসেছে ভারতের প্রশাসন। দ্রুত এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনে তৎপরতার কথা জানিয়েছে দেশটির গোয়ান্দা বিভাগ। তবে এ ঘটনায় দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েনের আশঙ্কা দেখছেন না বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের একজন এমপির হত্যাকাণ্ড ভারতের জন্যও উদ্বেগের কারণ। নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নসহ নানান সমীকরণ তৈরি হয়েছে এ ঘটনায়। নিজেদের স্বার্থেই এ ঘটনায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে দেশটি। ফলে কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনো টানাপোড়েন তৈরি হবে না বলে ধারণা তাদের।

গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত ১২ মে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান আনার। প্রথম দিন তিনি তার বন্ধু গোপালের বাসায় থাকেন। পরদিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যান হত্যাকারীরা। বিকেলের দিকে এমপি আনার ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। এরপর আমান তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদ মিলে এমপিকে চাপাতির মুখে জিম্মি করেন। এসময় তারা এমপির কাছে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের কথাও বলেন। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে জাপটে ধরে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করেন।

প্রায় ১০ দিন নিখোঁজ থাকার পর গত বুধবার (২২ মে) আনারের মৃত্যুর বিষয়টি সামনে আসে। নিউটাউনের ওই অভিজাত আবাসনে আসে নিউটাউন থানা পুলিশ। পরে সঞ্জীবা গার্ডেনের (ব্লক ৫৬ বিইউ) ঘর খুলে ভেতরে রক্তের দাগ দেখতে পায়, পাশাপাশি ট্রলিব্যাগ উদ্ধার করা হয়। সেই ব্যাগের মধ্যেও রক্তের দাগ ছিল।

ওই আবাসনের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে পুলিশ জানতে পারে, গত ১৩ মে এই আবাসনে ওঠেন আনোয়ারুল আজীম। তার সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন, যার মধ্যে ছিলেন একজন নারী। এরপর ওইদিনই আনোয়ারুল আবাসনের বাইরে না বেরোলেও বাকিরা বেশ কয়েকবার ওই আবাসনে আসা-যাওয়া করেন। মরদেহ টুকরো টুকরো করে সরানো হয়। এখন পর্যন্ত মরদেহ উদ্ধার হয়নি।

আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। যে ঘটনা ঘটেছে সেটি নিয়ে মনে হয় না সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। এখন কী হয়েছে না হয়েছে সেটি দেখতে হবে। ওই ঘটনার কারণে সম্পর্ক খারাপ হবে সেটি ঠিক হবে না।’

এ ধরনের ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। যে ঘটনা ঘটেছে সেটি নিয়ে মনে হয় না সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। এখন কী হয়েছে না হয়েছে সেটি দেখতে হবে।- ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

‘ঘটনাটি তো তারা (ভারত) ঘটায়নি। এটি তো আন্তর্জাতিকভাবে খবর হয়ে গেছে। আর বেশ নৃশংসভাবে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। ভারতের ইমেজের ব্যাপারেও কিন্তু এটি একটি সংকট। তাই তারা বড় আকারেই এটি দেখবে বলে আমি মনে করি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা এটি সমাধান করতে চাইবে বলেই আমি মনে করি।’

এমপি আনোয়ারুল আজীমের হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, এ হত্যাকাণ্ড দুই রাষ্ট্রের বিষয় নয়। আমরা আমাদের মিশনের মাধ্যমে খোঁজ-খবর রাখছি। মিশন থেকেও কলকাতা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তাধীন, তাই এর বেশি কিছু বলা সমীচীন নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আনোয়ারুল আজীমকে বাংলাদেশিরাই হত্যা করেছে বলে এরই মধ্যে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এখানে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরবে, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর ভারতের কোনো নাগরিকও এখানে জড়িত নন। ফলে সম্পর্কের সংকট হবে বলে মনে হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক ড. আমেনা মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওনার (এমপি আজিম) এটি ব্যক্তিগত সফর ছিল। ব্যক্তিগত সফরে থাকলেও এই পর্যায়ে যখন লোকজন যায় তখন একটা সিকিউরিটির ব্যাপার থাকে। দ্বিতীয়ত, বিষয়টি পুলিশের তদন্তের মধ্যে আছে। যতটুকু আমরা দেখতে পাচ্ছি ভারতের গোয়েন্দারা যথেষ্ট সহযোগিতা করছে। শুধু তাই নয়, আমাদের হাইকমিশনও বিষয়টিতে নজর রেখেছে। আমি গণমাধ্যমে যতটুকু দেখেছি আমাদের বাংলাদেশের ব্যক্তিরাই এটির সঙ্গে জড়িত। বসুন্ধরা এলাকায় ঘটনাটির পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখানে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের ব্যাপার আসবে না।’

ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক আছে এ ঘটনায় সেটিতে প্রভাব পড়ার কোনো অবকাশ নেই। আমরা আশা করি তারা আমাদের এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহায়তা করবে।- সাবেক রাষ্ট্রদূত এ কে এম আতিকুর রহমান

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া কী হবে সেটি হয়তো আইন বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। কিন্তু আমার জানামতে তাদেরও একটি তদন্ত রিপোর্ট আমার কাছে আসবে বলে ধারণা করছি। আমরা দেখেছি আমাদের গোয়েন্দা এবং ভারতের গোয়েন্দারা দুদিক থেকেই তদন্ত করছে। সুতরাং, কী হয় সেটি সামনের দিনগুলোতে বলা যাবে।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত এ কে এম আতিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কূটনৈতিক সম্পর্কটা তো দেশের সঙ্গে দেশের, সমষ্টিগত একটা সম্পর্ক। এটা তো বিচ্ছিন্নভাবে একজন বা দুজনের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। একটা লোক ওখানে গিয়ে মারা গেছে। কিন্তু সেখানে যদি অকারণ কোনো মানুষকে মেরে ফেলে সেটা একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। কিন্তু এখানে তো কারা কীভাবে মেরেছে সেটি ধীরে ধীরে বের হচ্ছে। এই সত্য জিনিসগুলো উদঘাটনের জন্য ভারতের পুলিশ দিন-রাত চেষ্টা করছে।’

‘ওরা তো অস্বীকার করেনি যে কিছু করতে পারব না। বরং তারা তো আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেখানে তাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। এতে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কে কেন বিরূপ প্রভাব পড়বে? ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক আছে এ ঘটনায় সেটিতে প্রভাব পড়ার কোনো অবকাশ নেই। আমরা আশা করি তারা আমাদের এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহায়তা করবে।’

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমপি আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার ঘটনায় আমাদের এবং ভারতের পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা মিলে কাজ করছে। এরই মধ্যে আমরা নিশ্চিত হয়েছি তাকে হত্যা করা হয়েছে। যারা হত্যা করেছে তাদের মুখ থেকে আমরা এগুলো শুনেছি। একজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, এ বিষয়টি আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিষয়টি। আশা করছি খুব অল্প সময়ে আমরা আপনাদের কিছু জানাতে পারবো।’

এদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় খুন করার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলাটি করেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।

অন্যদিকে এ খুনের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে কলকাতার নিউটাউন থানায় আরেকটি হত্যা মামলা করেছে। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার দুজনের নাম প্রকাশ্যে এনেছে কলকাতা পুলিশ। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাও আটক করেছে অন্তত তিনজনকে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সাব্বির আহমেদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, এ ঘটনাটির তদন্ত একটি প্রসিডিউরের মধ্যে দিয়ে যাবে। কারণ ভারত যে তদন্ত করছে এবং যেটা দেখা গেছে বাংলাদেশের কয়েকজনের জড়িত থাকার বিষয়টি দেখলাম। এখন যদি দুই দেশ একে অপরকে সহযোগিতা করে। মূল বিষয় হলো দায়ীদের খুঁজে বের করা। এজন্য দুই দেশের সহযোগিতা ছাড়া সেটি সম্ভব না। কারণ তিনি (এমপি) বাংলাদেশের নাগরিক। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে যারা জড়িত সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। কিন্তু ঘটনাটি ঘটেছে ভারতে। এখন এই দুই দেশ সহযোগিতা করে কাজটি করতে পারে। এই প্রক্রিয়া মেইনটেইন করলে কোনো কূটনৈতিক সমস্যা হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

তিনি আরও বলেন, তদন্ত যতক্ষণ ঠিকমতো হবে, তারাও কিছু তথ্য আমাদের কাছে চাইবে আমরাও তাদের কাছে কিছু তথ্য চাইব। পরস্পরের সহযোগিতা এখানে কাম্য। সেটাই সবাই আশা করবে। এটির ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ নেই। এখানে দুই দেশ সহযোগিতা করেই কাজটা করবে। তাই কোন সংকটের কারণ দেখি না।

আইএইচআর/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।