বজ্রপাত প্রতিরোধে ‘গচ্চা’ প্রকল্প

রায়হান আহমেদ
রায়হান আহমেদ রায়হান আহমেদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৩৯ পিএম, ২৭ মে ২০২৪
তালগাছের পর লাগানো হচ্ছে বজ্রনিরোধক দণ্ড, এরও কার্যকারিতা সীমিত

বজ্রপাত প্রতিরোধে কার্যকর কোনো প্রকল্প নিতে পারছে না দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে এক কোটি তাল গাছ রোপণ প্রকল্পে শত কোটি টাকা খরচ করেছে তারা। ওই প্রকল্প বাতিলের পর এবার ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে। এর আওতায় বসানো হবে বজ্রনিরোধক দণ্ড (লাইটনিং অ্যারেস্টার), বানানো হবে আশ্রয়কেন্দ্র।

এসব প্রকল্পকে ‘পয়সা রোজগারের প্রকল্প’ বলে মন্তব্য করেছেন ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক গওহর নাঈম ওয়ারা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৪০৭ জনের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈরী আবহাওয়ার পাশাপাশি এ বছর গরমের তীব্রতায় বজ্রপাতের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। গাছপালা কেটে ফেলা, বিশেষ করে খোলা মাঠে উঁচু গাছ ধ্বংস করে ফেলা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া এবং অসচেতনতার কারণে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। বজ্রপাত এমন এক দুর্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটাকে সুনির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রাখার মতো প্রযুক্তি আমাদের এখনো নেই।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্লেষক ও চেঞ্জ দ্য ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, কয়েকদিন আগে যে তাপপ্রবাহ ছিল তা ম্যাপিং করে চিহ্নিত করা হচ্ছিল। বজ্রপাতের জন্য এভাবে গত ১০ বছরে কোথায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, সেই এলাকা খুঁজে সেখানে সবাইকে সচেতন ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে।

জাকির হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে উন্নত প্রযুক্তির অভাবে এখনো রিয়েল টাইমে মানুষকে জানানো যাচ্ছে না আধাঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পর এখানে বজ্রপাতের শঙ্কা আছে। এই অ্যালার্ট দ্রুত দিতে হবে। আমাদের এ সমস্যা বছর বছর আরও বেড়ে যাবে। যদি সমাধান না করতে পারি, তাহলে বর্ষা মৌসুমে কৃষককে মাঠে যেতে না দিয়ে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের জীবনের তো দাম রয়েছে। এটি প্রশাসনকে উপলব্ধি করতে হবে।’

আরও পড়ুন

ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক গওহর নাঈম ওয়ারা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বজ্রপাতে মৃতদের অধিকাংশই গরিব। আমাদের প্রশাসন গরিব মানুষের মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি ভাবে না। তাদের সেই সচেতনতা নেই। খেটে খাওয়া মানুষ মরলে তাদের সমস্যা নেই। এটিই মৃত্যু না কমার সবচেয়ে বড় কারণ। মরে যাওয়ার পর খোঁজ খবরও নেওয়া হয় না। বজ্রপাত প্রতিরোধে সমাধান প্রকল্পে এখানে মূল ভিকটিম যারা বা যে শ্রেণির মানুষ বেশি মারা যাচ্ছে, তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে।’

নেই কার্যকর প্রকল্প

দেশে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা আগের চেয়ে কমলেও বজ্রপাতের মতো আকস্মিক দুর্যোগে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করেন। এরপর বজ্রপাত প্রতিরোধ ও মানুষের জীবন বাঁচাতে সারাদেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক কোটি তাল গাছের চারা রোপণের পরিকল্পনা হাতে নেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। এরমধ্যে সারাদেশে ৩৮ লাখ চারা রোপণের পর দেখা যায়, তা এক বছরের মধ্যেই অযত্নে অবহেলায় মারা যায়। এ প্রকল্পে খরচ হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

২০২২ সালের ১১ মে তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে তালগাছ প্রকল্প বাতিলের কথা জানান। তিনি বলেন, একটি তালগাছ বড় হতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ বছর। এত সময় ধরে অপেক্ষার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

ওই প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার পর বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবার ১ হাজার ৩২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে। এর আওতায় দেশের ১৫টি জেলায় ৬ হাজার ৭৯৩টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন ও ৩ হাজার ৩৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করবে সরকার।

বর্তমান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান গত ১১ ফেব্রুয়ারি এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় সংসদকে জানান, গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের অধিক বজ্রপাতপ্রবণ ১৫টি জেলায় ৩৩৫টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া দেশের অধিক বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলায় বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট প্রাণহানি রোধে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৬ হাজার ৭৯৩টি বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

এসব দণ্ড বজ্রনিরোধে কী ভূমিকা রাখছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। এমনকি খোদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরই বজ্রনিরোধক দণ্ডের সুফল নিয়ে সন্দিহান। তাই বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে ‘লিফলেট বিলি’তেই আস্থা রাখছেন অধিদপ্তরের কর্তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, লাইটনিং অ্যারেস্টার (বজ্রনিরোধক দণ্ড) যে ডিভাইস আছে, এগুলোর রেডিয়েন্স খুব একটা বেশি নয়। ১০০-২০০ মিটার। সে হিসেবে সারাদেশে কয়েক লাখ বসাতে হবে। তাই মানুষ সচেতন না হলে বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানো যাবে না। এজন্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে লিফলেট বিলি ও উপজেলা-জেলা লেভেলে সচেতনা বৃদ্ধির জন্য জানিয়েছি।

পয়সা রোজগারের প্রকল্প

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নাঈম ওয়ারা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই যে প্রকল্প নিচ্ছে, এগুলো হলো পয়সা রোজগারের প্রকল্প। মানুষকে বাঁচানোর প্রকল্প নয়। দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে না। আশ্রয়কেন্দ্র করে মৃত্যু ঠেকানো যাবে না। কৃষক সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে। তাই কৃষকের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করতে হবে কীভাবে বজ্রপাত থেকে বাঁচা যায়। সেই সঙ্গে বড় গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। হাওর অঞ্চলে শেল্টার জোন তৈরি করা দরকার। যেন লক্ষণ দেখেই কৃষকরা অবস্থান করতে পারেন।’

আরও পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ গবেষণা প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের পরিচালক ড. শহিদুল ইসলাম জাগো নিউউজকে বলেন, ‘যে কোনো সংকট মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হয়। আমাদের সেভাবে নেওয়া হয় না। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যায়, তাহলে তো হবে না। এখন প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। বড় বড় প্রকল্পের সঙ্গে সহজ বিষয় হলো, সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে লো-কস্ট প্রজেক্টে। সেটি হলো জনগণকে কড়া মনিটরিংয়ে রাখা। বজ্রপাতের একটা ফিক্সড টাইম থাকে। আমাদের দেশে বজ্রপাতগুলো স্বাভাবিকভাবে দুপুরের পর হয়। সেসময় সচেতনতা খুবই জরুরি।’

‘আরেকটি বিষয় হলো পূর্বাভাস দেওয়া। এটি সবচেয়ে জরুরি। লক্ষণ দেখা দিলেই মানুষকে সরে যেতে বাধ্য করতে হবে। সেজন্য প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে ইউনিয়ন প্রশাসন পর্যায়ে যারা আছে, তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। কর্মসূচি নিতে হবে। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।’

যা বলছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর

বজ্রপাত মোকাবিলায় দেশে যে কার্যকর পদক্ষেপ নেই সে কথা উঠে এসেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমানের বক্তব্যে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার বিষয়টা বৈজ্ঞানিকভাবে যুক্তিযুক্ত নয়। এটি বড় হতে লাগে ৩০ থেকে ৪০ বছর। শুধু গাছ লাগিয়ে বজ্রপাত রোধ করা যাবে না। তাই এই প্রকল্পের কাজ আর হচ্ছে না।’
বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন, ‘অনেকগুলো লাগানো হয়েছে। কিছু জায়গায় সচল রয়েছে। আবার কিছু জায়গায় অচল হয়ে পড়েছে। কয়টি জেলায় বর্তমানে বজ্রনিরোধক যন্ত্র আছে সে তথ্য এখন আমার জানা নেই।’

বজ্রপাতের পূর্বাভাস প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা পূর্বাভাসটা দ্রুত দিতে পারছি না। যে লোকটা মাঠে গিয়ে কাজ করে, আমি মনে করি, তাকে তো নোটিশ করার দরকার নেই। কালো মেঘ, বিদ্যুৎ চমকানো দেখলে তার চলে যাওয়ার কথা। মানুষ যদি নিজে সচেতন না হয়ে মাছ ধরতে যায়, কাজ করতে যায়, তাহলে তো সমস্যা। দেখা গেছে, হাওর এলাকায় বেশি মৃত্যু হচ্ছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে না। লাইটনিং অ্যারেস্টার থাকলেও সেটি অনেক দূর কাভার করে না। তাই মানুষের সচেতনতা বেশি প্রয়োজন। বিদ্যুৎ চমকানো দেখলেই নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে হবে।’

আরও পড়ুন

মৃত্যুর সংখ্যায় গরমিল

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ মে পর্যন্ত মারা গেছেন ৫৬ জন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৩ জন। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে সিলেট জেলায়, ১০ জন।
তবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম বলছে, শুধু এপ্রিল ও মে মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত মোট ৩৮ দিনে দেশে বজ্রপাতে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৩৫ জন কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত।

এ বিষয়ে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের দেওয়া মৃত্যুর হিসাব ভুল। প্রতিদিনই দেশের জাতীয় গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর খবর। আমরা গণমাধ্যম থেকে যাচাই-বাছাই করে তথ্য নিয়ে থাকি। মন্ত্রণালয় শুধু ডিসি অফিস থেকে পাওয়া তথ্য দিচ্ছে। তারা মানুষকে সচেতন করছে না।’

আরএএস/এমএইচআর/এমএমএআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।